হলুদ পোড়া গল্পের নামকরণ ও বিষয়বস্তু | Holud Pora Golper namkoron O Bishoybostu

‘হলুদ পোড়া’ গল্পের নামকরণ
নামকরণের রীতি: সাহিত্যে নামকরণের যে একটা বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে- তা বলাই বাহুল্য। নামহীন সৃষ্টি অনেকটা মস্তিষ্কহীন মানবদেহের মতো। তবে সাহিত্যসৃষ্টিতে শিরোনাম নির্বাচনে বঙ্গসাহিত্যের ‘ত্রয়ী বন্দ্যোপাধ্যায়’-এর অন্যতম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈশিষ্ট্য হল, নামকরণের ক্ষেত্রে তিনি গতানুগতিক প্রথা ভেঙেছেন বারংবার। ‘দিবারাত্রির কাব্য’, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’, ‘প্রাগৈতিহাসিক’, ‘সরীসৃপ’ ইত্যাদি অজস্র নাম তাঁর ছকভাঙার সাক্ষী। পাঠ্য গল্প ‘হলুদ পোড়া’ নামটিও তেমনিই এক ইঙ্গিতবাহী। কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের কাছে অসম্ভব যুক্তিবাদী মনও কীভাবে দুর্বল হতে হতে চুরমার হয়ে ভেঙে পড়ে তা গল্পে এক আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক পট নির্মাণ করে লেখক বুঝিয়ে দিয়েছেন। পটভূমির সেই ব্যঞ্জনাই ‘হলুদ পোড়া’ শিরোনামে প্রকাশিত।
কাহিনির নির্মাণ: ‘হলুদ পোড়া’ গল্পপাঠে দ্যাখা যায়, গল্পের শুরু থেকেই একটানা গল্প বলার পরিবর্তে লেখক মন দিয়েছেন অলৌকিক পরিবেশ সৃষ্টিতে। মজা পুকুর, মরা গজারি গাছ, বাড়ির পিছনে ডোবা, বাড়ির পূর্ব কোণের তেঁতুল গাছ, দমকা হাওয়া, আগাছার জঙ্গল, জলে ডুবে থাকা তালগাছের গুঁড়ি, প্রকাণ্ড বাঁশঝাড়, প্যাঁচার ডাক, কলাবাগান, ভর সন্ধ্যাবেলা- এইসব উপকরণ একত্র করে পাঠককে থেকে থেকেই শিহরিত করেছেন লেখক। আর এই রোমহর্ষক পরিবেশকে আরও রহস্য-রোমাঞ্চে ভরিয়ে তুলেছে ঝাড়ফুঁক ও তন্ত্রমন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু প্রতীক ও টোটেমের ব্যবহার।
নবীনের স্ত্রী দামিনী অসুস্থ হলে কুঞ্জ গুনিন এসেই নিশ্চিত হয়ে যায় ভর সাঁঝে তাকে ভর করেছে প্রেতাত্মা। শুরু হয় গুণপনা। মালসার আগুনে পুড়তে দেওয়া হয় শুকনো পাতা, শিকড়। দামিনীর এলোচুল দাওয়ার খুঁটিতে বেঁধে দেওয়া হয় শক্ত করে। তারপর একটি কাঁচা হলুদ পুড়িয়ে দামিনী নাকের কাছে ধরতেই আত্মা আত্মপরিচয় দেয়। পরবর্তীকালে ধীরেনের – বিকারগ্রস্ততার কালেও হলুদ পোড়ারই প্রয়োগ ঘটে। দামিনী ও ধীরেন – অর্থাৎ, শুভ্রা ও বলাই চক্রবর্তী উভয়ের স্বীকারোক্তিতেই অনুঘটকের কাজ – করতে দেখা যায় এই হলুদ পোড়াকেই।
নামকরণের সার্থকতা বিচার: গল্পে পোড়া হলুদ আসলে একটি প্রতীক। তা – লোকবিশ্বাস-সংস্কারের যথোপযুক্ত একটি উপকরণ। সংস্কারকে সত্য, বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতেই কুঞ্জ গুনিন এই উপকরণকে ব্যবহার করেছে জাদুদণ্ডের মতো। যাতে বশীভূত হয়েছে ধীরেনের মতো ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে বিএসসি পাস করা শিক্ষকের শিক্ষাদীক্ষা, যুক্তিবাদ, আধুনিকতাও। অন্যদিকে অপঘাতে নিহত বলাই চক্রবর্তীর ভাইপো-বউ দামিনী হয়তো বলাই খুড়োর রহস্যমৃত্যুর পর তার বাড়িতে এসে থাকাটা মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। তার ক্রমবর্ধমান মানসিক চাপ হিস্টিরিয়ার মোড়কে ৪ আত্মবিস্মৃতি বা গল্পে বর্ণিত বিকারগ্রস্ততার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। ৪ গুনিনের রোমাঞ্চ জাগানো গুণপনা, গ্রামবাসীর বদ্ধমূল সংস্কারের কাছে ধীরে ধীরে চাপা পড়ে গিয়েছিল কৈলাস ডাক্তার বা ধীরেনের প্রতিবাদ। আর পরিণতিতে বোন শুভ্রার অপমৃত্যু, দামিনীকে ভর করে শুভ্রার প্রেতাত্মার আত্মপরিচয়জ্ঞাপন ইত্যাদি নানাবিধ ঘটনা এবং রটনার চাপে পড়ে শুভ্রার দাদা ধীরেন মানসিক বিকলনের শিকার হয়ে পড়েছে। অন্ধ সংস্কারের কাছে নতি স্বীকার করেছে বিজ্ঞান- জয় হয়েছে কুঞ্জ মাঝির হলুদ পোড়ার ক্ষমতার।
কিন্তু মনে রাখতে হবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গল্পে সংস্কারকে সমর্থন করেননি, বরং ‘হলুদ পোড়া’ নামটি আসলে পুথিগত শিক্ষায় শিক্ষিত, ডিগ্রিধারী অথচ দুর্বলচিত্ত মানুষদের প্রতি ঘোষিত একটি বিদ্রুপ, যা বিজ্ঞানমনস্ক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিবাদকেই তুলে ধরে আর এখানেই ও ‘হলুদ পোড়া’ শিরোনামটির ব্যঞ্জনা সার্থকতা পায়।
‘হলুদ পোড়া’ গল্পের বিষয়বস্তু
কথাকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিরচিত ‘হলুদ পোড়া’ গল্পটির সূচনায় এক অদ্ভুত নাটকীয়তা পরিলক্ষিত হয়। দু-দুটো অপমৃত্যুর ভয়াবহ আতঙ্ক দিয়ে গল্পের শুরু। কোনো এক বছরের কার্তিক মাসের মাঝামাঝি সময়ে তিন দিন আগে পরে এক নাম না জানা গ্রামে দু-দুটো খুনের ঘটনা ঘটে। নিহতদের মধ্যে একজন হলেন মাঝবয়সী জোয়ান মদ্দ পুরুষ বলাই চক্রবর্তী, অন্যজন ষোলো-সতেরো বছরের একটি রোগা, ভীরু এবং গর্ভবতী মেয়ে শুভ্রা। স্বভাব চরিত্রের দোষত্রুটির কারণে বলাই চক্রবর্তীর অপমৃত্যু গ্রামে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও গ্রামবাসীকে বিস্মিত করেনি, কারণ তার এই পরিণতি যেন প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু বছর দেড়েক পূর্বে বিয়ে হয়ে শ্বশুরঘরে যাওয়া ঘরোয়া গৃহস্থ বাড়ির যে মেয়েটি মাত্র কদিন আগে বাপের ঘরে এসেছিল সন্তান জন্ম দিতে- তার রহস্যমৃত্যু জনমনে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। একই গ্রামের একজন পুরুষ এবং একজন নারীর এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড, তা-ও আবার মাত্র তিন দিনের তফাতে- গ্রামবাসীর মনে ক্রমাগত সন্দেহ বাড়িয়ে দেয়। সত্যিই কি কোনো যোগাযোগ আছে ঘটনা দুটির মধ্যে? এমনই গুঞ্জন ওঠে কিন্তু উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের অভাবে যাবতীয় কল্পনা, অনুমান মাথা তুলতে না তুলতেই মুষড়ে পড়ে।
বলাই চক্রবর্তীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির দায়ভার গ্রহণে শহরের চল্লিশ টাকা মাইনের চাকরি ছেড়ে গ্রামে অবতীর্ণ হয় বলাইয়ের ভাইপো নবীন ও তার পরিবার। কাকার খুনের রহস্য উদ্ঘাটনে পঞ্চাশ টাকা রিওয়ার্ড ঘোষণা করতেও দ্যাখা যায় তাকে। সকলে যখন সেই রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যস্ত তখন হঠাৎই একদিন ভর সন্ধ্যাবেলা নবীনের স্ত্রী দামিনী ঘোরতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। স্ত্রীয়ের অসুখ সারাতে ডাক পড়ে একইসঙ্গে চিকিৎসক এবং ওঝার। কুঞ্জ ওঝার গুণপনাতেই দামিনীর শরীরে ভর করা প্রেতাত্মা শুভ্রা স্বীকার করে তার অপমৃত্যুর কারণ আর কেউ নয়, স্বয়ং বলাই খুড়ো-সে-ই তাকে খুন করেছে।
বিস্মিত, ভীত, হতবাক গ্রামবাসীর মনের সংশয় দূর করতে বুড়ো ঘোষালের প্রদত্ত ব্যাখ্যাকেই সহজ কথায় বুঝিয়ে দেয় কুঞ্জ গুনিন। সে বলে অশরীরী বলাই, শুভ্রাকে খুন করেছে অন্য কোনো দেহধারীর মধ্যস্থতায়। অর্থাৎ কাউকে ভর করে তার হাত দিয়েই শ্রভ্রাকে খুন করেছে। দামিনীর মতো সে-ও হয়তো প্রেতাত্মার ভরমুক্ত হলে সব ভুলে গিয়েছে। এই দিনের ঘটনার যাবতীয় বৃত্তান্ত ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে গ্রামের সর্বত্র। শুভ্রার দাদা ধীরেনের কানেও বিষয়টি পৌঁছোয়।
ধীরেন পেশায় স্কুলশিক্ষক। সে ফিজিক্স অনার্স নিয়ে বিএসসি পাস করা শিক্ষিত ব্যক্তি। যুক্তিবাদী তার মন। সমাজগঠনের আদর্শে একসময় সে গ্রামোন্নয়নের ব্রত নিয়েছিল। সংসারব্রতের চাপে আজকাল হয়তো সে কিছুটা হতোদ্যম হয়ে পড়েছে। উক্ত দিনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ধীরেন টের পায় গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে থাকা শুভ্রার অপমৃত্যুর গুজব তার পরিবার ও সমাজজীবনে বদল এনেছে। পথেঘাটে পথচারীর কৌতূহলী চাহনি, স্কুল যাওয়ার পথে পুরোহিত মহাশয়ের নানাবিধ আচার-রীতি পালনের পরামর্শ- এমনকি স্কুলের পরিবেশও তাকে ঘিরে বদলে যায়। শ্রেণিকক্ষে ছাত্রদের ফিসফাস, সর্বত্র জিজ্ঞাসু দৃষ্টিভঙ্গি- সর্বক্ষণ তার মনে হতে থাকে, সে যেন স্কুলে উপস্থিত হওয়া কোনো বিশিষ্ট অভ্যাগত। সেক্রেটারির নির্দেশে হেডমাস্টার হঠাৎই তাকে ডেকে একমাসের ছুটি দিয়ে দেন। একথা শুনে প্রথমে সে আহত হলেও বাড়ি ফিরতে ফিরতে ধীরেন বোঝে ছেলেদের পড়ানোর ক্ষমতা সত্যিই তার এই মুহূর্তে নেই। তার দেহে-মনেও বিস্তর বদল তাকে প্রতিনিয়ত পীড়িত করতে থাকে। তার যুক্তিবাদী বিজ্ঞানচর্চিত মন ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে আসে। ধীরেনের বাড়িতে তার সংস্কারগ্রস্ত স্ত্রী শান্তি অশরীরীর আক্রমণ রোধে বাঁশ পুড়িয়ে ঘাটের পথে ফেলে রাখতে চাইলেও সে প্রতিবাদ করে না। ছেলেমেয়েদের ভূত সংক্রান্ত আলাপ সে চুপ করে শোনে। কোনো এক হেমন্তের সন্ধ্যারাত্রিতে বোন শুভ্রার কলঙ্কিত প্রেতাত্মার আত্মশুদ্ধিতে সে মন্ত্রপুত বাঁশ ডিঙিয়ে এগিয়ে যায়। সে জানে জীবিতের সঙ্গে মৃতের সংযোগস্থাপনের প্রশস্ত সময় এই ভর সন্ধ্যাকাল। বিজ্ঞানসচেতন, যুক্তিবাদী ধীরেন পরাজিত হয় গ্রাম্য অন্ধ-সংস্কারের কাছে। ধীরেন ফিরে আসার পর শান্তি, স্বামীর অস্বাভাবিক আচরণ দেখে আর্তনাদ করে ওঠে কারণ ধীরেন তখন অশরীরীর আয়ত্তাধীন। আবারও ডাক পড়ে কুঞ্জর। তার মন্ত্রের জোরে, হলুদ পোড়ার গন্ধে ধীরেনের দেহধারী প্রেতাত্মা বলে ওঠে-সে বলাই চক্রবর্তী। সে-ই শুভ্রাকে খুন করেছে।
আরও পড়ুন- ছুটি গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তর