হলুদ পোড়া গল্পের বিষয়বস্তু ও নামকরণ

হলুদ পোড়া গল্পের বিষয়বস্তু ও নামকরণ | Holud Pora Golper Bishoybostu O Namkoron 

হলুদ পোড়া গল্পের বিষয়বস্তু ও নামকরণ
হলুদ পোড়া গল্পের বিষয়বস্তু ও নামকরণ

হলুদ পোড়া গল্পের বিষয়বস্তু

কোনো এক বছর কার্তিক মাসের মধ্যভাগে মাত্র তিনদিনের ব্যবধানে গ্রামে দুটো খুন হয়ে যায়। গ্রামের দক্ষিণ অংশে ঘোষদের মজা পুকুরের ধারে জনহীন জায়গায় একটা মরা গজারি গাছের তলায় বলাই চক্রবর্তীকে মরে পড়ে থাকতে দেখা যায়। মধ্যবয়সি জোয়ান পুরুষ বলাই চক্রবর্তীর মাথা ফেটে আটচির হয়ে গেছিল, সম্ভবত লাঠির আঘাতে।

অন্যদিকে ষোলো-সতেরো বছরের রোগা স্বভাবভীরু শুভ্রা ছিল গ্রামের আর দশটি সাধারণ মেয়ের মতোই। বাচ্চা হবে বলে দেড় বছর পরে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি আসে মাসখানেক আগে। গ্রামের শেষ সন্ধ্যাবাতিটি যখন জ্বালা হয়েছে, সেরকম সময়ে বাড়ির পিছনের ডোবার ঘাটে কেউ বা কারা তাকে গলা টিপে মেরে রেখে গিয়েছিল।

বলাই চক্রবর্তীর অপমৃত্যু গ্রামের মানুষদের কাছে অপ্রত্যাশিত না হলেও শুভ্রার পরিণতির জন্য তারা কেউই প্রস্তুত ছিল না। গ্রামে কুড়ি-তিরিশ বছর কেউ জখম পর্যন্ত হয়নি, তাই দুটো খুনের মধ্যে কোনো যোগাযোগ আছে কি না তা গ্রামের লোকেরা ভাবতে থাকে। কিন্তু নিহত দুটি চরিত্রের মধ্যে কোনো যোগসূত্রও কারোর কাছে স্পষ্ট ছিল না। ফলে কল্পনাগুলি গুজবের বেশি কিছু হয়ে উঠতে পারে না।

বলাই চক্রবর্তীর উত্তরাধিকারী হিসেবে তার ভাইপো নবীন, সম্পত্তির মালিকানা পায়। সে তার কাকার খুনিকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পঞ্চাশ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে।

শহরের চাকরি ছেড়ে নবীন গ্রামে আসার একুশ দিন পরে এক সন্ধ্যায় নবীনের স্ত্রী দামিনীর গায়ে বাতাস লাগে, ভয়ে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। গ্রামের একমাত্র ডাক্তার (পাস-না-করা) ধীরেন, যে ঘটনাক্রমে শুভ্রার দাদা, তাকে ডেকে আনা হয়। ধীরেন কৈলাস ডাক্তারকে ডাকার পরামর্শ দিলেও বৃদ্ধ পঙ্কজ ঘোষাল গুনিন কুঞ্জকে ডাকার পরামর্শ দেন। ধীরেন তীব্র আপত্তি জানায়। নবীন উভয়পক্ষকেই গুরুত্ব দিয়ে কৈলাস ডাক্তার এবং কুঞ্জ দুজনকে আনতেই লোক পাঠায়।

প্রথমে আগমন ঘটে কুঞ্জ গুনিনের। দামিনীর এলোচুল বারান্দার খুঁটির সঙ্গে বেঁধে সে তার উপর নানা মন্ত্রতন্ত্র প্রয়োগ করতে থাকে। গ্রামের লোকেরা শিহরিত হয়ে সেই দৃশ্য দেখতে থাকে। একসময় দামিনীর চোখ বুজে আসে, সে নিস্পন্দ হয়ে যায়। কুঞ্জ কাঁচা হলুদ পুড়িয়ে তার নাকের কাছে ধরে। দামিনীর ঢুলে আসা চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়। সে নিজেকে ‘শুভ্রা’ বলে পরিচয় দেয় এবং কোনো প্রশ্ন করার আগেই জানিয়ে দেয় যে, ‘বলাই খুড়ো’ অর্থাৎ বলাই চক্রবর্তী তাকে খুন করেছে। এর বাইরে আর কোনো প্রশ্নের উত্তরই তার কাছ থেকে পাওয়া গেল না, এমনকি নাকে হলুদপোড়া ধরেও তাকে কথা বলানো গেল না।

কৈলাস ডাক্তারের আগমনে কুঞ্জর সমস্ত চেষ্টাই বন্ধ হয়ে যায়। তিনি কুঞ্জকে অপবিজ্ঞানের চর্চার জন্য তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন। থানায় তার নামে রিপোর্ট করার কথা বলেন। এরপর কৈলাস ডাক্তার দামিনীকে ঘুমের ওষুধের ইঞ্জেকশন দেন। ঘুমিয়ে পড়ার আগে অবশ্য দামিনী একইভাবে জানিয়ে যায় যে, সে ‘চাটুয্যে বাড়ীর শুভ্রা’।

শুভ্রার মৃত্যুর তিনদিন আগে বলাই চক্রবর্তী মারা যাওয়ায় তার দ্বারা শুভ্রার খুন হওয়া কীভাবে সম্ভব তা নিয়ে যখন সকলে সংশয়ে, তা দূর হয়ে যায় প্রথমে পঙ্কজ ঘোষাল এবং পরে কুঞ্জ গুনিনের কথায়। কুঞ্জ জানিয়ে দেয় যে, কোনো জীবন্ত মানুষকে ভর করে তাকে দিয়ে বলাই চক্রবর্তী শুভ্রাকে খুন করিয়েছে।

এইসব কথাবার্তা ধীরেনকে সীমাহীন বিষণ্ণ করে তুলল। অসহ্য কষ্ট তাকে তাড়া করে বেড়ায়। যে ঘাটে শুভ্রা খুন হয়েছে তার ধাপগুলো গর্ভবতী শুভ্রার জন্য বিশেষভাবে সে বানিয়ে দিয়েছিল। এইসব ভাবনা তাকে কষ্টে কাতর করে রাখে। অন্য কোনো বিষয়ে সে মনোনিবেশ করতে পারে না।

ধীরেন দ্রুত উপলব্ধি করতে থাকে যে, তার প্রতি তার চারপাশের পৃথিবীর দৃষ্টিভঙ্গি দ্রুত পালটে যাচ্ছে। পুরুতঠাকুর তাকে শাস্ত্রীয় ক্রিয়াকর্ম বিষয়ে পরামর্শ দিলেন। বাড়ির সকলের জন্য মাদুলি নিতে বললেন। স্কুলে গিয়ে মনে হল সে যেন সেখানে অভ্যাগত। এমনকি ছাত্ররা পর্যন্ত তার ক্লাসে আড়ষ্ট, কিংবা কোনো গোপন আলোচনায় রত। হেডমাস্টার তাকে স্কুলের সেক্রেটারি মথুরবাবুর পরামর্শমতো এক মাসের ছুটি নিতে বললেন এবং সেদিন থেকেই তাকে পড়ানোয় বিরত থাকতে বললেন।

স্কুল থেকে মাইলখানেক হাঁটলে মথুরবাবুর বাড়ি। সেদিকে যাবে ভেবে পা বাড়িয়েও ধীরেন সিদ্ধান্ত পালটায়। কোনো কারণে তার ছুটি বাতিল করে স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দিলে সে যে সমস্যায় পড়বে, তা ধীরেন বুঝতে পারে। কারণ সে উপলব্ধি করে যে, প্রতিদিন স্কুলে গিয়ে ছেলেদের পড়ানোর ক্ষমতা তখন তার নেই। মথুরবাবু, এমনকি কোনো চেনা মানুষের সামনে দাঁড়াতেও ধীরেন তখন লজ্জা পাচ্ছে। বাড়ি গিয়ে ঘরের মধ্যে লুকোনোই তখন তার একমাত্র লক্ষ্য।

সমস্ত দুপুর ঘরের মধ্যে ছটফট করে পড়ন্ত বিকেলে ধীরেন যখন বেরিয়ে আসে, তার স্ত্রী শান্তি তখন বাসন হাতে ঘাট থেকে থেকে উঠে আসছিল। ক্ষেন্তিপিসির পরামর্শে শান্তির নির্দেশে তখন বাঁশ কাটা চলছিল। উদ্দেশ্য ছিল, বাঁশের দু-প্রান্ত পুড়িয়ে ঘাটের পথে আড়াআড়ি ফেলে রাখা। অশরীরী কারোর আসা আটকাতেই এই ব্যবস্থা।

আতঙ্কিত শান্তি, সন্ধ্যা হওয়ার আগেই প্রদীপ জ্বালিয়ে দেয়। নিজের খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে ধীরেনের খাবার ঢেকে রেখে রান্নাঘরে তালা দিয়ে কাপড় ছেড়ে ঘরে গিয়ে ঢোকে। এঁটোকাটা অশরীরী আত্মাকে আকর্ষণ করে বলে, বিকেলে শান্তি মাছ রান্না করে না।

ধীরেনকে ঘরে আসতে বললেও সে আসে না। রাত্রি নামতে চলেছে। ধীরেনের মনে হয় শুভ্রাকে তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেওয়া উচিত। বাঁশ ডিঙিয়ে সে এগিয়ে যায় ডোবার দিকে।

শান্তি ঘরের ভিতর থেকে শুনতে পায় এক অদ্ভুত বিকৃত গলার আওয়াজ। বেরিয়ে এসে দেখে বাঁশের ওপাশে দাঁড়িয়ে হিংস্র জন্তুর মতো চাপা গর্জনের মতো ধীরেন তার নিজের নাম ধরেই ডাকাডাকি করছে। তার গেঞ্জি এবং কাপড়ে কাদা ও রক্ত মাখা। ঠোঁট থেকে চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। শান্তিকে ধীরেন বাঁশটা সরিয়ে নিতে বলে। শান্তি ডিঙিয়ে আসতে বললে ধীরেন জানায় যে, সে বাঁশ ডিঙোতে পারছে না। শান্তি নিঃসন্দেহ হল যে, ধীরেনকে অশরীরী ভর করেছে। তার সুতীক্ষ্ণ আর্তনাদে গ্রামের লোকেরা চলে এল, কুঞ্জও এল। স্নান করিয়ে খুঁটিতে বেঁধে দামিনীর মতোই তন্ত্রমন্ত্রের প্রয়োগ শুরু হল ধীরেনের উপরে। কাঁচা হলুদ ধীরেনের নাকের কাছে ধরে কুঞ্জ বজ্রকণ্ঠে তার পরিচয় জানতে চায়। ধীরেন উত্তর দেয় যে, সে বলাই চক্রবর্তী এবং সে শুভ্রাকে খুন করেছে।

হলুদ পোড়া গল্পের নামকরণ

‘হলুদ পোড়া’ গল্পটি এক অতিপ্রাকৃত প্রেক্ষাপটে মানুষের আদিম সংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের শিকড় বিস্তারের কাহিনি। তিন দিনের ব্যবধানে দুটি মৃত্যুর ঘটনা গ্রামে চাঞ্চল্য তৈরি করে। একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ এবং একজন অল্পবয়স্ক বিবাহিতা মেয়ের মৃত্যুতে গোটা গ্রামে হইচই পড়ে যায়। এরকম পরিস্থিতিতে অপমৃত্যুর অন্যতম চরিত্র বলাই চক্রবর্তীর ভাইপো নবীনের স্ত্রী দামিনীর গায়ে তেঁতুল গাছ ছুঁয়ে দমকা বাতাস এসে লাগে। এবং সে অজ্ঞান হয়ে যায়। গ্রামের একাংশ, যাদের প্রতিনিধি পঙ্কজ ঘোষাল, নিশ্চিত হয়ে যায় দামিনীকে ভূতে ধরেছে। ধীরেনের মতো মুক্তমনা মানুষের আপত্তিকে পাশে সরিয়ে রেখে সিদ্ধান্ত হয় কুঞ্জ গুনিনকে ডেকে আনার। তারপরে ভূত তাড়ানোর নামে চলে এক যুক্তিহীন, অমানবিক, অতিসক্রিয় কার্যক্রম; যার শেষপর্বে এসে কুঞ্জ একটা কাঁচা হলুদ পুড়িয়ে দামিনীর নাকের কাছে ধরে। তারপরেই কুঞ্জ-র ‘বল, তুই কে?’-প্রশ্নের উত্তরে দামিনী জানিয়ে দেয় যে, সে খুন হয়ে যাওয়া ‘শুভ্রা’।

যে ধীরেনকে কাহিনির প্রথম অংশে দেখা গিয়েছিল অন্ধ-সংস্কারের বিরোধিতা করতে তাকেই শেষপর্বে দেখা যায় চূড়ান্ত মনোবিকলনের শিকার হয়ে শুভ্রার সঙ্গে কথা বলার জন্য অস্থির হয়ে উঠতে। এবং রাতের অন্ধকারে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে সেই পুকুরঘাটে চলে যায় যেখানে শুভ্রার মৃতদেহ পড়েছিল। কিছুক্ষণ পরে ধীরেনের স্ত্রী দামিনী শুনতে পায় যে, হিংস্র জান্তব গলায় ধীরেন নিজেই নিজের নাম ধরে ডাকছে। তার চিবুক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। অশরীরীর প্রবেশ আটকানোর জন্য তার স্ত্রী যে বাঁশ দিয়ে রেখেছিল তা ডিঙিয়ে সে আসতে পারছে না, দামিনী নিশ্চিত হয়ে যায় ধীরেনকেও অশরীরী ভর করেছে। অতএব আবারও কুঞ্জ গুনিনের আগমন ঘটে এবং একইভাবে তন্ত্রমন্ত্রের প্রয়োগ শেষে মালসার আগুনে কাঁচা হলুদ পুড়িয়ে ধীরেনের নাকের কাছে ধরে জিজ্ঞাসা করা হয় তার পরিচয়। ধীরেন উত্তর দেয় যে, সে বলাই চক্রবর্তী এবং সে-ই শুভ্রাকে খুন করেছে। এভাবে হলুদপোড়ার সাহায্যে একটা কাল্পনিক ধারণা অলৌকিক ভিত্তি পেয়ে যায়। যে ধীরেন একদা নবীনকে ‘লেখাপড়া শিখেছ, জ্ঞানবুদ্ধি আছে’ এই যুক্তিতে কুঞ্জ গুনিনকে ডাকতে নিষেধ করেছিল, গল্পশেষে সে-ই কুঞ্জর মন্ত্রসাধনা এবং আদিম আধিভৌতিক চর্চার অবলম্বন হয়ে ওঠে। যুক্তি থেকে অন্ধত্বের এই বিচলনে যেন অনুঘটক হয়ে থাকে হলুদপোড়া। গল্পের নাম ‘হলুদপোড়া’ তাই তাৎপর্যগতভাবে অত্যন্ত সার্থক।

আরও পড়ুন- ছুটি গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment