প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষের জীবনযাত্রার পরিচয় দাও

প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষের জীবনযাত্রার পরিচয় দাও

প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষের জীবনযাত্রার পরিচয় দাও
প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষের জীবনযাত্রার পরিচয় দাও

ভূমিকা

মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারার আদিযুগ অর্থাৎ প্রথম যুগ হল প্রাচীন প্রস্তর যুগ। বিভিন্ন পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করে মানুষ এই যুগে খাদ্য সংগ্রহ করত। তাই এই যুগকে ‘প্রস্তর যুগ’ বলা হয়। প্রস্তর যুগ তিনভাগে বিভক্ত, যথা—i. প্রাচীন প্রস্তর যুগ, ii. মধ্য প্রস্তর যুগ, iii. নব্য প্রস্তর যুগ ।

প্রাচীন প্রস্তর যুগের সময়কাল

প্রাচীন প্রস্তর যুগের সূচনা হয় আজ থেকে প্রায় 50 হাজার বছর আগে, শেষ হয় আজ থেকে প্রায় 17000 বছর আগে অর্থাৎ 15000 BC-তে।

উপাদান

প্রাচীন প্রস্তর যুগের কোনো লিখিত উপাদান নেই। একমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলির ওপর ভিত্তি করে এই যুগের ইতিহাস রচিত হয়েছে। বিভিন্ন হাতিয়ার, ফসিল, গুহাচিত্র ও ব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী থেকে এই যুগের সমাজজীবন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

মানবগোষ্ঠী

পিকিং মানব (চিন), জাভা মানব (ইন্দোনেশিয়া), আটলানথ্রোপাস মানব (আলজেরিয়া), ওন্ডুভাই মানব (তানজানিয়া), নিয়ান্ডারথাল মানবসহ বিভিন্ন শাখার হোমোইরেকটাস প্রজাতির মানুষ পুরাতন প্রস্তর যুগে বসবাস করত।

হাতিয়ার

পুরোনো প্রস্তর যুগে মানুষ পাথরের ও হাড়ের তৈরি হাতিয়ার ব্যবহার করত। প্রকৃতি থেকে যে ধরনের পাথর পেত তার কোনো পরিবর্তন না-করেই ব্যবহার করত। তাই হাতিয়ারগুলি ছিল অমসৃণ ও ভোঁতা। হাতকুঠার, বল্লম, ছুরি, ছুঁচ, হারপুন, র‍্যাদা প্রভৃতি হাতিয়ার ব্যবহার করত। পুরাতন প্রস্তর যুগের শেষ পর্বে মানুষ তিরধনুকের ব্যবহার শেখে।

খাদ্য

পুরাতন প্রস্তর যুগের মানুষ ছিল খাদ্য সংগ্রহকারী—খাদ্য উৎপাদন করতে জানত না। পশুর মাংস, মাছ, পাখির ডিম ও বিভিন্ন ধরনের ফলমূল ছিল মানুষের প্রধান খাদ্য। আগুনের ব্যবহার জানত না তাই তারা কাঁচা মাংস, মাছ ও ফলমূল খেত। প্রথমে ছোটো পশুশিকার করত, পরে অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পেলে ম্যামথ, বাইসন, বল্‌গা হরিণ প্রভৃতি বড়ো পশুশিকারে তারা অভ্যস্ত হয়।

পোশাক-পরিচ্ছদ

আদিম মানুষ এই যুগে পশুর চামড়া ও গাছের ছাল পোশাক হিসেবে ব্যবহার করত।

বাসস্থান

প্রস্তর যুগে আদিম মানুষ প্রথমে খোলা আকাশের নীচে বা গাছের তলায় বাস করত। পরে তারা পাহাড়ের গুহাতে বসবাস করত। আরও পরে তারা গাছের ডাল, পশুর চামড়া ও পাথর দিয়ে বাসস্থান তৈরি করতে শেখে।

সমাজজীবন

আদিম মানুষ প্রস্তর যুগে দলবদ্ধভাবে বসবাস করত। প্রথমে এই দলগুলি ছিল ছোটো ছোটো, পরে আত্মরক্ষা ও শিকারের সুবিধার জন্য আরও বড়ো দল গঠন করে। আদিম মানুষের সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। সমাজ ও পরিবারে পুরুষের তুলনায় নারীদের প্রাধান্য ছিল বেশি। প্রতিটি গোষ্ঠীর নিজস্ব বিধিনিষেধ ছিল এবং তার কল্পিত পূর্বপুরুষদের পুজো করত।

ভাষার ব্যবহার

ঐতিহাসিকরা অনুমান করেন পুরাতন প্রস্তর যুগেই ভাষার উদ্ভব হয়। প্রতিটি গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা ছিল। শিকারে যাওয়ার সময় আদিম মানব মনের ভাব প্রকাশের জন্য বিভিন্ন সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করত। এই সাংকেতিক শব্দগুলি থেকেই ভাষার জন্ম হয়।

আগুনের ব্যবহার

আগুন কৃত্রিমভাবে জ্বালাতে না পারলেও প্রস্তর যুগের আদিম মানুষ দাবানল বা অন্য কোনো কারণে জ্বলে ওঠা আগুনকে অনেকদিন জ্বালিয়ে রাখত। গুহামুখে আগুন রেখে হিংস্র বন্যপশুর আক্রমণ ও শীতের তীব্রতা থেকে আত্মরক্ষা করত। পরে শিকার করা পশুর মাংসও পুড়িয়ে খেতে শুরু করে।

ধর্মবিশ্বাস

প্রস্তর যুগে মানুষ তাদের কল্পিত পূর্বপুরুষকে পুজো করত। গুহার দেয়ালে পশুর হাড় ও শিং দিয়ে বিভিন্ন ছবি আঁকত। বিভিন্ন পশু, দলবদ্ধ নাচ বা দলবদ্ধ শিকারের ছবিও আঁকত। কোনো অলৌকিক শক্তিকে তুষ্ট করার জন্য আদিম মানব এই ছবিগুলি আঁকত। ঐতিহাসিকগণ অনুমান করেন গুহাচিত্রগুলি ছিল আদিম মানবের ধর্মচর্চার অঙ্গ।

মূল্যায়ন

প্রস্তর যুগ ছিল মানবসমাজের সূচনার যুগ। এই যুগেই মানুষ দলবদ্ধভাবে বসবাসের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। আগুন ব্যবহার করে হিংস্র বন্যপশুকে প্রতিরোধ করতে শেখে। অপর দিকে কঠোর সামাজিক অনুশাসনের মধ্য দিয়ে গোষ্ঠীকে আরও সুসংবদ্ধ করে। তবে প্রস্তর যুগে মানুষের সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। খাদ্য, হাতিয়ার, বাসস্থান, ভাষা ও আগুনের ব্যবহারে প্রস্তর যুগের মানুষের উন্নতির লক্ষণ সুস্পষ্ট।

Leave a Comment