ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ কী ছিল | এর গুরুত্ব লেখো

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ কী ছিল | এর গুরুত্ব লেখো

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ কী ছিল | এর গুরুত্ব লেখো
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের (February Revolution) কারণ কী ছিল? এর গুরুত্ব লেখো

১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে লুই ফিলিপ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। জুলাই বিপ্লবের ফলে তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্র ‘জুলাই মনার্কি (July Monarchy) নামে পরিচিত হয়। এই জুলাই মনার্কি ফরাসিদের আশা, প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। মাত্র ১৮ বছরের মধ্যেই গণরোষে এই রাজতন্ত্রের পতন ঘটে।

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ

জুলাই রাজতন্ত্রের পতনের অথবা ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের একাধিক কারণ লক্ষ করা যায়-

সমস্ত রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা

প্রথম থেকেই লুই ফিলিপ কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থন পাননি। দক্ষিণপন্থী ন্যায্য অধিকার সমর্থক বা লেজিটিমিস্ট (Legitimist) রা ফ্রান্সের সিংহাসনে লুই ফিলিপের অধিকারকে অবৈধ বলে মনে করত। বামপন্থী প্রজাতান্ত্রিক দল ও সমাজতান্ত্রিক দলগুলি জুলাই রাজতন্ত্রের তীব্র বিরোধী ছিল। মধ্যপন্থীরা লুই ফিলিপের মধ্যপন্থা নীতি ও শ্রমিককল্যাণবিরোধী নীতিতে এবং বোনাপার্টিস্ট দল ফিলিপের অগৌরবজনক পররাষ্ট্রনীতিতে হতাশ হয়।

বুর্জোয়া রাজতন্ত্র

লুই ফিলিপ বুর্জোয়া স্বার্থ রক্ষা করে শাসনকার্য চালাতেন। তাঁর শাসনব্যবস্থায় উচ্চবিত্ত ভূস্বামী, বণিক ও শিল্পপতিদের স্বার্থ রক্ষিত হত। প্রতিনিধি সভার সদস্য হওয়ার ও ভোটদানের অধিকার কেবলমাত্র বিত্তশালী শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন তিনি। এইভাবে গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্থাপিত হয় গোষ্ঠীতন্ত্র।

লুই ফিলিপের স্বৈরাচারী নীতি

জুলাই বিপ্লবের ফলে লুই ফিলিপ ফ্রান্সের সাংবিধানিক রাজা হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি স্বৈরশাসন কায়েম করেন। পরিণামে জনগণ হতাশ হয়ে পড়ে। তাদের এই হতাশাই পুঞ্জীভূত হয়ে প্রকাশ পায় ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে।

শ্রমিক অসন্তোষ

ফ্রান্সে শ্রমিকদের অবস্থা ছিল অবর্ণনীয়। কাজের অনির্দিষ্ট সময়সীমা, স্বল্প মজুরি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ শ্রমিকদের অবস্থাকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। শ্রমিকদের কল্যাণসাধনের জন্য জুলাই রাজতন্ত্র কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। সেন্ট সাইমন (Saint Simon), লুই ব্ল‍্যাঙ্ক (Louis Blanc) প্রমুখ সমাজতন্ত্রীরা শ্রমিকদের সমর্থনে এগিয়ে আসেন এবং রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়।

দুর্বল পররাষ্ট্রনীতি

লুই ফিলিপের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য ছিল- বৈদেশিক ক্ষেত্রে যুদ্ধ এড়িয়ে চলা এবং যে কোনো মূল্যে শান্তি বজায় রাখা। অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র উভয় নীতির ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করায় সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনে তিনি ব্যর্থ হন।

অর্থনৈতিক সংকট

১৮৪৬ এবং ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর পর দুই বছর অনাবৃষ্টির ফলে কৃষি উৎপাদন দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পায়, খাদ্যসংকট তীব্র হয় ও শ্রমিকদের দারিদ্রা চরমসীমায়। পৌঁছোয়। আর্থিক সংকট নিরসনে রাজা ব্যর্থ হলে রাজতন্ত্রের পতন ঘটাতে জনগণ তৎপর হয়ে ওঠে। ফলে দেশের নানান অঞ্চলে বিদ্রোহ শুরু হয়।

প্রত্যক্ষ কারণ ও বিপ্লবের সূচনা

১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি ভোটাধিকার সম্প্রসারণের দাবিতে প্যারিসের ময়দানে এক কেন্দ্রীয় সমাবেশের আয়োজন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী গিজো (Guizot) এই সমাবেশকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন। ক্ষুব্ধ জনতা গিজোর বাসভবন আক্রমণ করলে তাঁর দেহরক্ষীর গুলিতে ২৩ জন নিহত হয়। এই ঘটনার প্রত্যুত্তরে বিক্ষুব্ধ জনতা অবিলম্বে লুই ফিলিপের পদত্যাগ দাবি করে। লুই ফিলিপ তাঁর পৌত্রের হাতে সিংহাসনের দায়িত্বভার অর্পণ করে ইংল্যান্ডে পালিয়ে গেলে বাজতন্ত্রের অবসান হয় (২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ)। ফ্রান্সে প্রজাতান্ত্রিক দল ও সমাজতান্ত্রিক দল মিলিতভাবে সরকার গঠন করে।

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের গুরুত্ব

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে জুলাই রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। ফ্রান্সের বাইরে জার্মানি, ইটালি, অস্ট্রিয়া প্রভৃতি দেশে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাবে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে হাঙ্গেরি, বোহেমিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র ও শ্লাভ জাতিগোষ্ঠী স্বাধীনতা ঘোষণা করে। গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদী চেতনা আরও শক্তিশালী হয়। ইউরোপে মেটারনিখতন্ত্রের পতন ঘটে। এককথায় ইউরোপের পুরাতনতন্ত্রের পতন ত্বরান্বিত হয়।

Leave a Comment