আমার প্রিয় গ্রন্থ রচনা |
ভূমিকা
গ্রন্থটির বিষয়বস্তু
থাকাকালে একটা সময় চরম দুরবস্থায় পড়ে। সেই অবস্থা বদলাতে সে কলকাতার খেলাতচন্দ্র ঘোষের এস্টেটের চাকরি নিয়ে তৎকালীন বিহারে যায়। ভাগলপুরের উত্তরে এবং পূর্ণিয়া কাটিহারের পশ্চিমে অবস্থিত লবটুলিয়া বইহার, ফুলকিয়া বইহার, নাড়া বইহার প্রভৃতি অঞ্চলের দশ হাজার একরের একটা বিশাল উর্বর ভূমির জঙ্গল কেটে সেখানে প্রজা বসানোই ছিল তার কাজ। সেখানে পৌঁছে অরণ্য-প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে একাত্ম হয়ে পড়ে সত্যচরণ। পরিচিত হয় সে অঞ্চলের মানুষের দারিদ্র্যসহ ভানুমতী, কুন্তা, মন্ত্রী, দোবরু পান্না, ধাওতাল সাহু, রাজু পাঁড়ে, ধাতুরিয়া, যুগলপ্রসাদ, গনোরী তেওয়ারী প্রভৃতি চরিত্রের সঙ্গে। অবশেষে সেখানকার কাজ মেটার পর সে ফিরে আসে কলকাতায়।-এটাই হল ‘আরণ্যক’ গ্রন্থটির মূল বিষয়বস্তু।
গ্রন্থটি কেন প্রিয়
(ক) প্রকৃতির ছবি: ‘আরণ্যক’ উপন্যাসগ্রন্থটিতে লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ফুটিয়ে তুলেছেন অরণ্য-প্রকৃতির এক মায়াময় ছবি। প্রকৃতির অন্তর্নিহিত মর্মবাণী অনুপম কথামালায় উপস্থাপিত করেছেন লেখক। সেই প্রাকৃতিক জগৎ রোমান্টিক কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ কথিত ‘colour and form’-এর জগৎ। প্রকৃতির এই ছবি আমার মনকে খুবই মুগ্ধ করেছে।
লেখকের এই অদৃশ্য জগতের সন্ধান আমাকে বার বার মুগ্ধ করেছে। এখনও করে। এ-ও জানি, ভবিষ্যতে যতবার গ্রন্থটি পড়ব, ততবারই মুগ্ধ করবে।
(গ) অপার্থিব সান্নিধ্যের অনুভব: ইংরেজ কবি কীটস একবার বলেছিলেন- “The poetry of the earth is never dead.” সেদিক দিয়ে তাঁর পৃথিবী ছিল সুরলোকবিহারের পৃথিবী। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাঁর ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে অরণ্য-প্রকৃতির আড়ালে এক ঐশী ও অপার্থিব দেবলোকের সান্নিধ্য অনুভব করেছেন। সেখানে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর রূপাতীত অতীন্দ্রিয় ভাবুকতা। যা সত্যিই বেশ আকর্ষণীয়।
(ঘ) স্বপ্নরাজ্যের রূপময় বর্ণনা: ‘আরণ্যক’ গ্রন্থটির প্রতিটি বাক্যেই যে, ছড়িয়ে আছে ইন্দ্রিয়গাহা এক স্বপ্নরাজ্যের অনুভব। সেখানে কোথাও বর্ণিত হয়েছে লবটুলিয়া বইহারের জঙ্গল, মোহনপুরা রিজার্ভ ফরেস্ট, সরস্বতী কুন্ডার ধার, মহালিখারূপ পাহাড়ের পাদদেশ; কোথাও বা বর্ণিত হয়েছে রোদমাখা এবং বনজঙ্গলে ভরা দীর্ঘ শৈলমালা। সেসব যেন অস্কার ওয়াইল্ড বর্ণিত ‘Suffocating sensuousness’-এর স্বপ্নরাজ্য। লেখকের সেই স্বপ্নরাজ্যের বর্ণনায় আমি মুগ্ধ।
(ঙ) বর্ণময় চরিত্রচিত্রণ: সাঁওতাল রাজকন্যা ভানুমতী, রাজা দোবরুপান্না, দেবী সিংহের বিধবা কুস্তা, পাটোয়ারী বনোয়ারী লাল, গরিব ব্রাহ্মণ রাজু পাঁড়ে, নাচের দলের ছেলে ধাতুরিয়া, নকছেদীর স্ত্রী মন্ত্রী প্রভৃতি চরিত্র ‘আরণ্যক’ গ্রন্থের সম্পদ। তাদের সত্যিই ভোলা যায় না।
(চ) উপন্যাসটির ভাষা : ‘আরণ্যক’ উপন্যাসগ্রন্থটির ভাষা অপূর্ব মায়াময়। এই বিষয়ে একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে- ‘জ্যোৎস্না আরও ফুটিয়াছে, নক্ষত্রদল জ্যোৎস্নালোকে প্রায় অদৃশ্য, চারদিকে চাহিয়া মনে হয়, এ সে পৃথিবী নয়, -যাহাকে জানিতাম,’ এমন মায়াময় ভাষা আর কোনো গ্রন্থে পাইনি আমি। এসব কারণেই ‘আরণ্যক’ উপন্যাসটি আমার সবচেয়ে ‘প্রিয় গ্রন্থ’।
উপসংহার
‘প্রকৃতির যে সূক্ষ্ম, কবিত্বপূর্ণ অনুভূতি বিভূতিভূষণের গৌরব, তাহা এই উপন্যাসে চরম উৎকর্ষ লাভ করিয়াছে।’ (-বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা: শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)