মানবজীবন সততই বহমান নদীর মতো গতিশীল। সেই গতিশীল মানবজীবনে কখনো কখনো এমন এক-একটি দিন আসে, যে দিনটাকে একেবারে অন্যরকম বলে মনে হয়। আজকের এই দিনটা আমার জীবনে সেরকমই একটা দিন। কবির ভাষায় বলা যায়-
কেন? গতকাল রাত থেকে শুরু করে আজ ভোরে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ছোটোদের পথের পাঁচালী’ উপন্যাসটা পড়ে ফেলেছি যে। ওফ্, সে যে কী অভিজ্ঞতা, তা ওই বইটা যে পড়েছে, একমাত্র সে-ই বুঝবে।
বইটির কাহিনি
‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসটিতে নাকি ‘বল্লালী বালাই’, ‘আম আঁটির ভেঁপু’ এবং ‘অক্রুর সংবাদ’ – এই তিনটি পর্ব আছে। আমি হাতে পেয়েছিলাম ‘আম আঁটির ভেঁপু’ পর্বটি, যা ‘ছোটোদের পথের পাঁচালী’ নামে আলাদা করে ছাপা হয়েছে। বইটির কাহিনিটি যথেষ্ট অভিনব। নিশ্চিন্দিপুরের হরিহরের বছর ছয়-সাতের অপু বাবার সঙ্গে নীলকুঠির মাঠ আর নীলকণ্ঠ পাখি দেখতে যাচ্ছে, সেই ঘটনা দিয়েই বইটা শুরু হয়েছে। পথে অপুর গাছগাছালি ও খরগোশ দেখা, বাড়িতে ফিরে আসা এই প্রথম অধ্যায়ের কাহিনি।
বাকি ছাব্বিশটি অধ্যায়ে দশ-এগারো বছরের দিদি দুর্গার সঙ্গে মিলে অপুর আম জারানো, মহাভারতের যুদ্ধপ্রিয় অপুর খেলাধুলা, ছটফটে দুর্গার চুরি করা, মায়ের হাতে মার খাওয়া, ব্রতপালন, ঝড়ে ভাইবোনে আম কুড়াতে যাওয়া, অপুর স্কুলে যাওয়া, আতুরি বুড়ির সামনে পড়া, দুর্গা-অপুর রেলের রাস্তা দেখতে যাওয়া, চড়ুইভাতি করা, অবশেষে জ্বরে পড়ে দুর্গার মৃত্যু এবং অপুদের নিশ্চিন্দিপুর গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার কাহিনি বর্ণিত আছে।
অনন্য সব অভিজ্ঞতা
বইটি পড়তে গিয়ে নানান অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। প্রাথমিকভাবে আরণ্যক সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটু-আধটু তো চিনেইছি, উপরন্তু ঋদ্ধ হয়েছি আরও নানান দিক দিয়ে। যেমন-
(ক) চরিত্র: ছোটোদের পথের পাঁচালী বইটির সবচেয়ে বড়ো সম্পদ হল চরিত্র। অপু এই বইটির প্রধানতম চরিত্র। কল্পনার ভাবপেলবতায়, আবেগের অনুরণে, প্রকৃতির প্রতি মুগ্ধতায়, অচেনাকে চেনার আনন্দে সে বিভূতিভূষণের এক অনুপম সৃষ্টি। নিশ্চিন্দিপুরের মাঠেঘাটে, বনবাদাড়ে, সেই গ্রামের প্রেমভরা হৃদয়ে বা-
হ্যাঁ, সে চিহ্ন পড়ে আছে সর্বত্রই। এমনকি মানুষের মনেও। আসলে অপুদের মতো চরিত্রদের ভোলা যায় না। যেমন ভোলা যায় না প্রাণচঞ্চল মেয়ে দুর্গাকে। সেই তার চুরির স্বভাব, ছটফটে ভাব নিয়েও অন্যরকম। ম্যালেরিয়ায় তার মৃত্যু সে কারণে পাঠকদের চোখে জল আনে। তাকে তুলতেও পারে না কেউ। কেননা তারা জানে-
শুধু কি অপু-দুর্গা? তাদের বাবা হরিহর, মা সর্বজয়া, নিশ্চিন্দিপুরের রাণু, প্রসন্ন গুরুমশায়, রাজকুম্ন সান্যাল, আতুরিবুড়ি, নরোত্তম দাস বাবাজি, নীলমণি হাজরার যাত্রাদলের অজয় পাঠক তাদেরও কি ভুলতে পারে? আমারও মনে তারা জেগে রইবে বহুদিন।
(খ) গ্রামের ছবি: গ্রাম্যজীবনের অনুপম চিত্রমালা ফুটে উঠেছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বইটাতে। গাছপালা-নদনদী-পুকুর-মাঠ-রেলরাস্তা-পাকা সড়ক-দিঘি কীসের বর্ণনা নেই তাতে? গ্রামের এমন ছবি আমি আর কোনো উপন্যাসে আমি পাইনি। কতরকম যে গাছ-লতার নাম আছে বইটাতে।
(গ) ভাষাশৈলী: বইটির অননুকরণীয় ভাষাশৈলী আমাকে অসম্ভব মুগ্ধ করেছে। সংলাপের চেয়ে অপূর্ব শব্দমালায় বর্ণনার পর বর্ণনা সাজিয়েছেন তিনি। তার মধ্যে কখনো কখনো প্রকৃতি যেন আপনা আপনি ধরা দিয়েছে। অথচ সে বর্ণনায় অলংকারের চাতুর্যের প্রয়োজন হয়নি বিভূতিভূষণের।
(ঘ) সংলাপ: বইটির অন্যতম আরেকটি সম্পদ হল চরিত্রের সংলাপ। অপুকে দুর্গার বলা- ‘আমায় একদিন রেলগাড়ি দেখাবি?’ কিংবা গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় দিদির উদ্দেশে অপুর মনে মনে বলা- ‘আমি চাইনি দিদি, আমি তোকে ভুলিনি, ইচ্ছে করে ফেলেও আসিনি ওরা আমায় নিয়ে যাচ্ছে’ ইত্যাদি সংলাপ আমার বুকে এখনও যেন বাজছে।