একটি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রচনা

কখনো কখনো মনে হয় আমার মনটা যেন বহমান এক জীবন্ত নদী। যেন সে আপন খেয়ালে আঁকাবাঁকা পথে চলেছে তো চলেছেই। তার থামা নেই, নেই কোনো পিছুটান, নেই বড়ো কিছু চাওয়াও। চলার পথে সে শুধু দেখে নিতে থাকে অনেককিছু। মনের মধ্যে এই চলমানতা আছে বলেই প্রতিবছরই কি গ্রীষ্মের ছুটি, কি পুজোর, মা-বাবার সঙ্গে কোথাও-না-কোথাও ঘুরতে বেরিয়ে যাই আমি। যেমন গতবার গরমের ছুটিতে গেছিলাম দার্জিলিং, তার আগেরবার পুজোর ছুটিতে বিষ্ণুপুর, তারও আগেরবার পুজোর সময় বাংলাদেশে। এখনও পর্যন্ত আমার অবস্থা এমন যে-

‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে যাই না আর’;
(-জীবনানন্দ দাশ)

এবারও আমি ঘুরতে গেছিলাম। তবে দূরে কোথাও নয়। কাছাকাছি একটা গ্রামে। সেটাও এই বাংলারই এক গ্রাম।

পূর্বপ্রস্তুতি

উত্তর চব্বিশ পরগনার হাবড়ার কাছাকাছি মসলন্দপুরের ঘোষপুরে আমার মামির বাপের বাড়ি। বনেদি পরিবার। বাড়িতে প্রতিবছরই ধুমধাম করে দুর্গাপুজো হয়। মামার বাড়ি বিরাটিতে গেলে মামি বহুবারই বলতেন পুজোর সময় ঘোষপুর থেকে একবার ঘুরে আসতে। আমরা আগে কোনোবারই যেতে পারিনি। এবারই পুজোর আগে আগে বাবা। খোলসা করলেন, ‘এবার আর দূরে কোথাও হয়, ঘোষপুরেই যাব আমরা।’ সত্যি কথা বলতে কী, অখুশি হইনি। কারণ গ্রাম দেখতে আমার ভালোই লাগে। শহরের মানুষ তো। পুজোর সাতদিন আগে থেকেই তাই সব গুছিয়েগাছিয়ে তৈরি আমার।

যাত্রাপথের অভিযাত্রী

পুজোর তিনদিন আগেই আমরা রওনা হলাম ঘোষপুরের উদ্দেশ্যে। গড়িয়াহাটের ফ্ল্যাট থেকে মালপত্র সমেত প্রথমে পৌঁছালাম বালিগঞ্জ স্টেশনে। সেখান থেকে শিয়ালদহ স্টেশন। তারপর সকালের বনগাঁ লোকালে। রবিবার ছিল দিনটা। তাই ট্রেনটা ফাঁকাই ছিল। আমি বেছে বেছে বসলাম একটা জানালার কাছে। ট্রেন ছাড়ার পর জানালার ওপারের দৃশ্য দেখতে দেখতে চললাম। বারাসতের পর থেকে সে এক অন্য অভিজ্ঞতা। দুধারেই মাঠ আর মাঠ। কোথাও বা চাষের জমি, জলাভূমি কোথাও বা, তার মধ্যে গড়ে ওঠা জনজীবন। দূরে আবার উন্নত শির গাছের সারি। রোদ পড়ে পড়ে সেসব যেন স্বপ্নমাখা ছবি। দেখলে মনে হয়-

‘রৌদ্রে এসে দাঁড়িয়েছে রৌদ্রের প্রতি।।
এ যেন আলোরই শস্য’,
(-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)

ওসব দেখতে দেখতে অবশেষে পৌঁছালাম মসলন্দপুর। সেখান থেকে অটোতে ঘোষপুরে।

গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর পরের অভিজ্ঞতা

নিজেদের বাড়ি থেকে মামা-মামি আগেই পৌঁছে গেছিলেন। তাঁরা এবং বাড়ির আর সবাই সাদর অভ্যর্থনা জানালেন আমাদের। মামির মুখে আগেই নাম শুনেছিলাম। তাই সেদিন বিকালেই মামির দাদার ছেলে অরিত্রর সঙ্গে সাইকেলে করে ছুটলাম কিছুটা দূরে গোবরডাঙার কাছে যমুনা নদী দেখতে। কেননা, ‘আমি তারেই খুঁজে বেড়াই যে রয় মনে আমার মনে।’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) নদীটা মরে গেছে। বর্ষার জমা জলে এখন কচুরিপানার দঙ্গল। তাতে আবার যতদূর দৃষ্টি যায়, নীলচে ফুল আর ফুল।

একেবারে হাতের কাছে কাশফুল দেখলাম এই প্রথম। দেখলাম গ্রাম্য বাড়িঘর, পুকুর। পুকুরে ভাসমান হাঁস, ছিপ ফেলে মাছ ধরা। আর দেখলাম গাছপালা আর গাছপালা। মনটা যেন জুড়িয়ে গেল। পরদিন আমরা সবাই মিলে গেলাম গোবরডাঙার পুরনো কালীমন্দিরে। দেখলাম গোবরডাঙা শ্মশানও। বাকি কদিনে এদিকে-ওদিকে সৎসঙ্গ মন্দির, কুন্নমন্দির আরও কতকিছু যে দেখলাম। পুজোর কদিনও চলল দেদার মজা। কত মানুষের সঙ্গে যে পরিচয় হল।

উপসংহার

বিজয়াদশমীর পরদিন আমরা আর মামারা মিলে সেই ছোট্ট ভ্রমণ শেষে ফিরে চললাম কলকাতায়। আবার সেই ট্রেন। দু-পাশে সেই উদার গৈরিক দৃশ্য। কবির সঙ্গে গলা মিলিয়ে সে দৃশ্য সম্পর্কে বলা যায়-

“ধুধু মাঠ — ধানখেত —  কাশফুল — বুনো হাঁস — বালুকার চর
বকের ছানার মতো যেন মোর বুকের উপর 
এলোমেলো ডানা মেলে মোর সাথে চলিল নাচিয়া;” 
(-জীবনানন্দ দাশ)

Leave a Comment