রাষ্ট্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা অভিযান |
[রচনা-সংকেত: ভূমিকা-রাষ্ট্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা অভিযান কী-উদ্দেশ্য-কর্মপ্রণালী-সাফল্য-ব্যর্থতা-উপসংহার]
‘সেই উজ্জ্বল দিনের শিয়র ছুঁয়ে আছে
চন্দনবর্ণ মেঘ
সারি সারি সার্থবাহ চলেছে প্রমাণিত স্বপ্নগুলো নিয়ে’
-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
ভূমিকা
সভ্যতার প্রথম যুগ থেকে একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত শিক্ষা যেন বাস্তবিকই উজ্জ্বল দিনের স্বপ্ন দেখানো এক ভোর। এই শিক্ষা কোনো ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়, তা বরং ধনী-নির্ধন, হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, ছোটো-বড়ো, নারী-পুরুষ সবারই জন্য। কিন্তু ভারতে নানান কারণে এই শতাব্দীতেও সবার মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। সে কারণেই শিক্ষাকে সবার মধ্যে পৌঁছে দেবার উদ্দেশ্য নিয়ে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে চালু করা হয়েছিল সর্বশিক্ষা অভিযানের প্রথম পর্ব। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে এই অভিযানের দ্বিতীয় পর্বে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্র ও শিক্ষার প্রসারের পরিকল্পনা করা হয়। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে নতুনভাবে সংযোজিত হয়েছে রাষ্ট্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা অভিযান।
রাষ্ট্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা অভিযান
অশিক্ষার অন্ধকারের অভিশাপ এই পৃথিবীর বহু দেশে আজও ছড়িয়ে আছে। বহু মানুষের মধ্যে এখনও শিক্ষার আলো সেভাবে পৌঁছাতে পারেনি। তার জন্যে রয়েছে আর্থিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণ। অথচ দেশকে এগোতে গেলে সমগ্র দেশবাসীকে আগে শিক্ষিত করা প্রয়োজন। কবিকণ্ঠে তাই বার বার ধ্বনিত হয়েছে-
‘খুলে দাও দ্বার
নীলাকাশ করো অবারিত’
(-খুলে দাও দ্বার: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
ভারতে দেশের ও দশের অগ্রগতির স্বার্থে পূর্বতন ইউপিএ সরকার চালু করেছিল সর্বশিক্ষা অভিযান। বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে সেই প্রকল্পকে আরও আধুনিক করার লক্ষ্য নিয়ে এবং মাধ্যমিক স্তরের উন্নতির জন্যে গঠন করা হয়েছে এই রাষ্ট্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা অভিযান।
উদ্দেশ্য
ভারতের সংবিধান রচনার সময় ৪৫ নম্বর ধারায় শিক্ষার অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেখানে বলা হয়েছিল সংবিধান প্রবর্তনের দশ বছরের মধ্যে চোদ্দো বছর বয়সী সমস্ত শিশু-কিশোর-কিশোরীকে বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষার আওতায় আনতে হবে এবং সেই শিক্ষা দিতে হবে অবৈতনিকভাবে। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় বাদেও সেই শিক্ষা চোদ্দো বছর পর্যন্ত নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ছড়িয়ে দেওয়া যায়নি। অথচ বিশ্বের অন্যত্র সাক্ষরতা অভিযান সমানে চলছিল। নানান আন্তর্জাতিক সংস্থা আজও নিরক্ষরতা দূরীকরণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতে ‘সবার জন্যে শিক্ষা’র উদ্যোগ নেবার উদ্দেশ্যেই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের জন্য গঠন করা হয় প্রথমে সর্বশিক্ষা অভিযান এবং পরে মাধ্যমিক স্তরের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাদীক্ষার উন্নতি, বৃত্তিমূলক শিক্ষার ধারণা ইত্যাদির জন্যে চালু করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা অভিযান।
কর্মপ্রণালী
সর্বশিক্ষা অভিযানের প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণির মতো রাষ্ট্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা অভিযান ও নবম-দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের কারিগরি শিক্ষা ও প্রথাগত শিক্ষার উন্নতির উদ্যোগে বেশ কিছু কর্মপ্রণালী নির্ধারণ করেছে। যেমন-
- ‘সবার জন্যে শিক্ষা’র ব্যবস্থা করতে গিয়ে সর্বশিক্ষা অভিযানে নিয়োগ করা ছিল শিক্ষাবন্ধু, পার্শ্বশিক্ষক ও স্পেশাল এডুকেটর। তাঁরা সবাই মিলে এখনও সাধারণ ও বিশেষ শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রের উন্নতি ঘটাচ্ছেন। বর্তমানে রাষ্ট্রীয় মাধ্যমিক
- শিক্ষা অভিযানের মাধ্যমে নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার দিকে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। • ড্রপ আউট রুখতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্কুলছুট ছাত্রদের স্কুলে ফিরিয়ে আনবারও ব্যবস্থা করা হয়েছে।
- প্রাথমিক ও প্রাক-মাধ্যমিক স্তরের, বিশেষত অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের স্কুলছুট বুখতে এবং পুষ্টি বাড়াতে সর্বশিক্ষা অভিযানে মিড ডে মিল চালু করা হয়েছিল। সেই ব্যবস্থা এখনও বজায় আছে। পাশাপাশি মাধ্যমিক স্তরের ছাত্রছাত্রীদের জন্য রাইটিং, কোরিওগ্রাফি, পেইন্টিং, ক্যাটারিং প্রভৃতি বিষয়ে কেরিয়ার কাউন্সিলিং বা বৃত্তিবিষয়ক পরামর্শদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
- ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার সুবিধার্থে স্কুলঘর নির্মাণ, বেঞ্চ, বোর্ড ইত্যাদির ক্ষেত্রে অনুদানেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সম্ভাবনা
এখনও পর্যন্ত প্রচার, উদ্যোগ এবং কাজের ভিতর দিয়ে পূর্ববর্তী সর্বশিক্ষা অভিযানের মতো বর্তমানের রাষ্ট্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা অভিযান কিছুটা সাফল্যের মুখ দেখতে চলেছে। ভালোভাবে নবম-দশম শ্রেণি পাশ করে বৃত্তি বেছে নেবার জন্যে উপযুক্ত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তাতে আশা করা হচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা উপকৃতই হবে।
উপসংহার
জনকল্যাণে যে-কোনো সরকারি উদ্যোগই ভালো। পূর্ববর্তী সর্বশিক্ষা অভিযানের বর্তমানের মতো রাষ্ট্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা অভিযানও প্রবল চেষ্টার ভিতর দিয়ে সেই কাজটি শুরু করেছে। আমরা তাই আশা করতেই পারি- একদিন ভবিষ্যতের সব শিশু-কিশোর-কিশোরী শিক্ষিত হতে পারবে। মাধ্যমিকের পর নিজেদের অসহায় ভাববে না। আমরা তখন কবির সুরে সুর মিলিয়ে বলতে পারব- ‘আত্মপ্রত্যয়ের অগ্নি, হে সন্তান, প্রথম জ্বলুক তব ঘরে।’ (-জীবনানন্দ দাশ)।