রূপ-রস-গন্ধে ভরা অপূর্ব মায়াময় এই পৃথিবী। এখানে জলভাগের পরিমাণ সবথেকে বেশি হলেও স্থলভাগের পরিমাণও কম নয়। সেখানে কোথাও মনবিহারী সৌন্দর্যের ঢেউ তুলে, কোথাও বা ‘Suffocating sensuousness’-এর অনাবিল আবহ সৃষ্টি করে বিরাজ করছে বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল। সেই বনাঞ্চলে আবার ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য বন্যপ্রাণী। দুইয়ে মিলে রচিত হয়েছে অপূর্ব এক মেলবন্ধন। পৃথিবীর স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে প্রকৃতির এই দুই অঙ্গ- বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ বিশেষভাবে প্রয়োজন।
বন ও বন্যপ্রাণীর সম্পর্কের দিক
বৃক্ষই হল এই পৃথিবীর প্রাণগঙ্গার প্রথম তরঙ্গ। বিশ্বকবির মুখে তাই শোনা গিয়েছে-
বনের বৃক্ষরা প্রাণীকুলকে অক্সিজেন জুগিয়ে, ফুলফল জুগিয়ে, কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে, বনের প্রাণীদের খাদ্য জুগিয়ে বাঁচিয়ে রাখে। স্বাভাবিকভাবে বন্যপ্রাণীরা বন নির্ভর। আবার বনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে একটি খাদ্যশৃঙ্খল। কিছু বন্যপ্রাণী বনের ফুল-ফল-পাতা খায়। ‘কিছু হিংস্র’ বন্যপ্রাণী শাখাহারী এবং অন্যান্য প্রাণীদের খেয়ে বেঁচে থাকে। সুতরাং বন ও বন্যপ্রাণীদের সম্পর্ক অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা।
বন ও বন্যপ্রাণীর বর্তমান সংকট
মানুষের লোভ সর্বগ্রাসী। সেই লোভের আগুনে দীর্ঘদিন ধরে পুড়ে গিয়েছে অরণ্যাঞ্চল। সেই লোভই ধ্বংস করেছে বনের বহু প্রাণীকে। তা ছাড়া নগর প্রতিষ্ঠার তাগিদে মানুষ ধ্বংস করে ফেলেছে বহু বনজঙ্গল ও বন্যপ্রাণীকে। স্বাভাবিকভাবেই যে পৃথিবীকে দেখে কবির গলায় একদা ধ্বনিত হয়েছিল-
সেই পৃথিবী আজ আর নেই। বহু বনাঞ্চল তো বটেই, ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে কমপক্ষে ১৩৪ রকমের পশুপাখি হারিয়ে গিয়েছে পৃথিবীর বুক থেকে। হারিয়ে গিয়েছে মরিশাস দ্বীপের ডোডো পাখি। মেরু অঞ্চলের স্বর্ণশৃগাল, হিমালয়ের ক্লাউডেড লেপার্ডসহ আরও অনেক প্রাণী। আজকের দিনে একশৃঙ্গ গণ্ডার, হাতি, বাঘ, কুমির, কৃষ্ণসার হরিণ, তক্ষক, লজ্জাবতী বাঁদর, তুষার চিতা, ভারতীয় বন্য গাধা, কস্তুরীমৃগ ইত্যাদি প্রাণী ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
বন ও বন্যপ্রাণীর ধ্বংসের বিশেষ কারণ
বন ও বন্যপ্রাণী ধ্বংসের পিছনে যেসব কারণ রয়েছে, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, দাবানল ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়। শহরের সম্প্রসারণ, কাঠের ব্যাপক ব্যবহার এবং পশুর দাঁত, চামড়া, মাংস, শিং প্রভৃতির প্রতি মানুষের আকাঙ্ক্ষা, কুসংস্কারজনিত লোভ ইত্যাদিও বন ও বন্যপ্রাণী ধ্বংসের অন্যতম কারণ।
বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা
(৩) পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গাছপালা অক্সিজেন ত্যাগ করে এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে। তা দিয়েও মানুষের উপকার করে। অন্যদিকে বন্যপ্রাণী থেকে মানুষ তার খাদ্য যেমন পায়, তেমনি পায় প্রাকৃতিক সাহচর্যও।
সংরক্ষণের নানান ব্যবস্থা
মানবজীবনে বন ও বন্যপ্রাণীর বিশেষ ভূমিকার কথা স্মরণ করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানান ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে। লুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করে, অভয়ারণ্য সৃষ্টি করে, রেডিয়ো সিগনালের দ্বারা পশুদের গতিবিধি জানা ও নিয়মিত নজরদারি ব্যবস্থার মাধ্যমে সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। গাছ লাগানো, বন্যপ্রাণী বৃদ্ধিও এই পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
ভারতবর্ষে সংরক্ষণের উদ্যোগ
একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে- According to expart opinion, the minimum area of forest for a tropical country like India should be about one-third of the total area. সুতরাং সরকারি উদ্যোগে বনাঞ্চল সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। তা ছাড়া বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় গড়ে তোলা হয়েছে বহু অভয়ারণ্য। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল উত্তরপ্রদেশের করবেট ন্যাশানাল পার্ক, মধ্যপ্রদেশের কানহা অভয়ারণ্য ও শিবপুরি জাতীয় উদ্যান, অসমের কাজিরাঙা অভয়ারণ্য ও মানস অভয়ারণ্য, গুজরাটের গির অভয়ারণ্য, পশ্চিমবঙ্গের জলদাপাড়া, সুন্দরবন, ওড়িশার সিমলিপাল অভয়ারণ্য ইত্যাদি। বনাঞ্চল তো বটেই, এসব অভয়ারণ্যে বাঘ, কুমির, নেকড়ে, সম্বর, হাতি, বাইসন, হরিণ ইত্যাদি প্রাণীও রক্ষা পাচ্ছে।