সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা
সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা রচনা
|
ভূমিকা
সাহিত্য হল মানুষের হৃদয়বেদ্য অনুভূতির এক অনুপম ভাষাপ্রকাশ, সার্থক লেখকদের লেখার গুণে কিংবা কবি-নাট্যকার-প্রবন্ধকারদের ভাবভাবুকতা এবং চিন্তাচেতনার পেলবতায় যা হয়ে ওঠে দার্শনিক সান্তায়ানা কথিত ‘objectified pleasure’। হৃদয়ের জগতই তার মুখ্য উপজীব্য। অনেকের মনের কথাই যেন বলা থাকে সাহিত্যে। সে কারণে সাহিত্যের পাঠক তার প্রিয় সাহিত্যের মধ্যে নিজেকেই খুঁজে পায়। খুঁজে পায় বলে তাকে ভালোওবাসে। সেদিক দিয়ে সাহিত্য হল sense-perception বা ইন্দ্রিয়-সংবেদন।
সাহিত্যের প্রকৃতি
সাহিত্যের প্রকৃতি বা স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘সাহিত্য’ গ্রন্থের ‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন-
‘সৃষ্টির উদ্দেশ্য পাওয়া যায় না, নির্মাণের উদ্দেশ্য পাওয়া যায়। ফুল কেন ফোটে তাহা কার সাধ্য অনুমান করে, কিন্তু ইটের পাঁজা কেন পোড়ে, সুরকির কল কেন চলে, তাহা সকলেই জানে। সাহিত্য সেইরূপ সৃজনধর্মী।’
রবীন্দ্রনাথের কথা মাথায় রেখেও বলা যায়-সাহিত্য হল এমন একটি মাধ্যম, যা মূলত লেখকের হৃদয়গত, বুদ্ধিগত এবং কল্পনাগত উপাদান সমৃদ্ধ; composition and style-এ যা কোনো-না-কোনো জীবনের কথা বলে, পাঠকের হৃদয়ে বিশেষ অনুভূতি সৃষ্টি করে।
সাহিত্যের শ্রেণি
সাহিত্যের প্রধানত তিনটি শ্রেণি- (১) মন্ময় বা আত্মমগ্ন সাহিত্য : এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হল গীতিকবিতা: শোকগাথা, ধর্মমূলক খণ্ডকবিতা, রম্যরচনা, Impressionistic Criticism বা প্রতীতিমুখ্য সমালোচনা ইত্যাদি, যেখানে সৃষ্টিকর্তার হৃদয়ের উন্মোচনই বড়ো কথা। (২) তন্ময় বা বস্তুধর্মী সাহিত্য : আখ্যানকাব্য, মহাকাব্য, জীবনীকাব্য, জীবনী, উপন্যাস, নভেল, নাটক, ইতিহাসের কাহিনি ইত্যাদি রচনা এই শ্রেণির। এই শ্রেণির রচনায় সৃষ্টিকর্তার বহির্জগৎ-এর কথাই উন্মোচিত হয়। (৩) তথ্যমূলক সাহিত্য : গুরু প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি, তথ্যমূলক সমালোচনা ইত্যাদি এই ধরনের সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত।
সাহিত্য পাঠের প্রয়োজন কেন
যেকোনো ভালো সাহিত্য পাঠের ভিতর দিয়ে নানান ধরনের সুফল লাভ হয় পাঠক- বর্গের। যেমন-
আত্মদর্শন : সাহিত্যে ব্যক্তিজীবনের দুঃখ-সুখ, আনন্দ-বেদনা, আশা-নিরাশা, চাওয়াপাওয়া, হাসি-কান্না, মানসিক দ্বন্দ্ব, মানসিক ভাবরাজি প্রভৃতি ফুটে ওঠে। সাহিত্য পাঠ করলে পাঠকবর্গ সাহিত্যের চরিত্র কিংবা তথ্য বা বর্ণনার ভাষার ভিতর থেকে ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে খুঁজে নিতে পারে।
সমাজ দর্শন : সাহিত্যে মানুষের পরিচিত সমাজের নানান তথ্য ও ছবি ফুটে ওঠে। সমাজে ঘটে যাওয়া অত্যাচার-অবিচার, শোষণ-বঞ্চনা, পাপপুণ্য, আচার-বিচার বা সামাজিক রীতিনীতি ইত্যাদি ফুটে ওঠে। সাহিত্যের পাঠকবর্গ সাহিত্য পাঠের ভিতর দিয়ে নিজের সমাজকে চিনতে পারে। সমাজে তাদের অবস্থানকে চিহ্নিত করতে পারে।
রসোপলব্ধি লাভ : সাহিত্য মানুষের হৃদয়বেদ্য এমনই এক মাধ্যম, যার ভিতর দিয়ে পাঠকবর্গের নানান ভাব ও রসোপলব্ধি সম্ভব হয়। বিষয়বৈচিত্র্যময় সাহিত্য পাঠে মনে তৃপ্তি আসে, সত্যকে জানা সম্ভবও হয়। তা ছাড়া মনকে পরিশীলিত করা যে-কোনো ধরনের মহৎ সাহিত্যের এক বড়ো গুণ।
চরিত্র গঠনে সহায়তা : সাহিত্যে কখনো কখনো থাকে আদর্শের কথা। থাকে সত্য দর্শন, মিথ্যার স্বরূপ, সৎ ও অসৎ-এর দ্বন্দু, ভালো ও মন্দের প্রকৃতি ইত্যাদি। পাঠক সাহিত্য পাঠের ভিতর দিয়ে সেগুলো চিনতে শেখে এবং নিজেকে শোধরাতে পারে। সেভাবে সাহিত্য পাঠে পাঠকদের চরিত্র গঠিত হয়।
মানসিক পুষ্টিসাধন : সাহিত্য পাঠে পাঠকের মনের পুষ্টিসাধন হয়। পাঠক নানান বিষয়ে যেমন জ্ঞান অর্জন করতে পারে, তেমনি বাড়াতে পারে নিজের পর্যবেক্ষণ শক্তি, সত্যানুসন্ধানের ক্ষমতা ইত্যাদি। সাহিত্য পাঠ মনকে উদার হতে এবং কালিমামুক্ত হতেও সাহায্য করে।
উপসংহার
সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে এভাবে পাঠকের আত্মদর্শন, সমাজদর্শন, রসোপলব্ধি, চরিত্র গঠন এবং মানসিক পুষ্টিসাধন ঘটে বলে সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। যে-কোনো সাহিত্যের উদ্দেশে তাই কবির ভাষায় বলা যায়-
আরও পড়ুন – 1943 খ্রিস্টাব্দে বাংলায় দুর্ভিক্ষের কারণ গুলি কী ছিল