জীবনচরিত পাঠের প্রয়োজনীয়তা রচনা
জীবনচরিত পাঠের প্রয়োজনীয়তা রচনা
|
ভূমিকা
দিগন্তবিস্তৃত বা অতলান্ত সমুদ্রের মাঝে একা এক দৃঢ়প্রাণ নাবিকের মতো এমন অনেক মানুষ থাকেন, যাঁরা অন্যান্য মানুষের হাজারও দুঃখকষ্ট-মর্মবেদনার নিদারুণ অন্ধকারের মাঝে যেন দীপ্তমান এক আলোকবর্তিকা। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেদেরই কর্মের কারণে হয়তো বা মহামানবও। এঁদের অবদানের কথা ভেবেই কবি বলেছেন- “Lives of Great men remind us/We can make our lives sublime.” সেই মানুষদের সম্পর্কে জানা যায় তাঁদের জীবনচরিত পাঠের ভিতর দিয়ে।
জীবনচরিত কী
জীবনচরিত হল কোনো বিশেষ ব্যক্তির জীবনকাহিনিমূলক গ্রন্থ, যার মধ্যে থাকে ওই বিশেষ ব্যক্তির মহৎ কর্মের বিবরণ, জীবনকথা এবং তাঁর আদর্শকথা; থাকে ওই ব্যক্তির আত্মত্যাগ, ধৈর্য, অধ্যবসায়, কখনও বা দেশপ্রেম, সেবাধর্ম, কৃষ্ণসাধন ইত্যাদির কথাও, যা থেকে ছাত্রছাত্রী কিংবা সাধারণ মানুষ আদর্শের একটি পাঠ নিতে পারে।
জীবনচরিত পাঠের প্রয়োজনীয়তা
সাধারণ মানুষের জীবন নিরন্তর সংগ্রামের জীবন। তাদের জীবনে আছে দুঃখকষ্ট, আছে হাজারও মর্মবেদনাও। তা ছাড়া সত্য এবং ন্যায়ের সন্ধানে তাদের যাত্রা যেন ফুরাতে চায় না। তারা তখন সান্ত্বনা খোঁজার জন্যে, সংসারজীবনে সুস্থভাবে বাঁচার জন্যে আঁকড়ে ধরতে চায় মহৎ মানুষের জীবনচরিতকে। তাদের কাছে তখন জীবনচরিত হয়ে ওঠে বহু প্রয়োজন মেটাবার একটি আলোকবর্তিকা। যেমন-
শক্তি ও প্রেরণার দিক : ছাত্রজীবন ভবিষ্যতের সমাজজীবনের প্রস্তুতিপর্ব। সেই সমাজজীবনে আসতে পারে গ্লানি, আসতে পারে ব্যর্থতাও: বিপদের দিনে দিশাহারা হয়ে পড়ারও সম্ভাবনা থাকে প্রবল। সেক্ষেত্রে জিশুখ্রিস্ট, রামকৃষ্ণ পরমহংস, স্বামী বিবেকানন্দ, গৌতম বুদ্ধ, হজরত মহম্মদ, নাইটিঙ্গেল প্রমুখ মহৎ মানুষের জীবনচরিত পাঠ ছাত্রছাত্রীদের তো বটেই, যে-কোনো সাধারণ মানুষকেও শক্তি ও প্রেরণা জোগাতে পারে।
আদর্শ, ত্যাগ ও সত্যের দীক্ষা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার বলেছিলেন- “যেখানে চিত্তের সত্য-উদ্বোধন হয় সেখানে/সত্যকর্ম আপনি প্রকাশ পায়।” সেই সত্য পাওয়া যেতে পারে জীবনচরিত পাঠের ভিতর দিয়ে। আসলে মহামানবদের আদর্শ, তাঁদের ত্যাগ, বিপদের দিনেও সত্যে অবিচল থাকা যে-কোনো ছাত্রছাত্রী এবং সাধারণ মানুষকে নবদীক্ষায় দীক্ষিত করে। জীবনচরিতকে তাই সেই দীক্ষার আদর্শ মাধ্যম বলা যেতে পারে।
বিশ্ববোধের দিক, নবজাগরণ : বিশ্বের কোনো মহামানবকেই কোনো ভৌগোলিক সীমার বাঁধনে বাঁধা যায় না। তাঁরা দেশ-কাল ছাপিয়ে যেন বা সারা বিশ্বের একজন। কোনো সংকীর্ণতার বাঁধনে ও তাঁদের বাঁধা যায় না। যেমন বাঁধা যায় না জিশু- খ্রিস্টকে নাইটিঙ্গেলকে, তেমনি বাঁধা যায় না রামকৃয়, বিবেকানন্দ, হজরত মহম্মদ, গৌতমবুদ্ধসহ আরও অনেককেই। তাঁদের সেই বিশ্বজনীনতা জীবনচরিত পাঠের মাধ্যমে পাঠককে করে তোলে বিশ্ববোধের নবজাগরণে উদ্বুদ্ধ।
ইতিহাস ও সমাজ দর্শন : জীবনচরিত পাঠের ভিতর দিয়ে সমসাময়িক যুগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দেশের সাংস্কৃতিক, শৈল্পিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক তথ্যপঞ্জির জ্ঞান অর্জন করে পাঠকশ্রেণি। সেদিক দিয়ে জীবনচরিতগুলো হয়ে ওঠে ঐতিহাসিক ও সামাজিক দর্পণ। যেমন- গৌতম বুদ্ধের জীবনচরিত থেকে কিংবা চৈতন্যদেবের জীবনচরিত থেকে সে যুগের ইতিহাস ও সমাজজীবন সম্পর্কে ধারণা মেলে।
উপসংহার
জীবনচরিত এমনই এক গ্রন্থ, যা পাঠের সুফল নিয়ে কারও সন্দেহ থাকা উচিত নয়। তবে মহৎ মানুষের পাশাপাশি এমন কিছু মানুষের জীবনচরিতও লেখা হয়েছে, যা পাঠ করা ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে উপযুক্ত নয়। সেক্ষেত্রে তাই উপযুক্ত জীবনচরিত নির্বাচনের প্রয়োজন রয়েছে। তাদের ক্ষেত্রে মহান মানুষের আদর্শ জীবনচরিত নির্বাচনে পাঠের জন্যে শ্রেয়। আর তখনই সংশ্লিষ্ট মহৎ ব্যক্তির গলায় শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে যেন ধ্বনিত হতে পারবে সেই অমোঘ উক্তি “আত্ম প্রত্যয়ের অগ্নি, হে সন্তান, প্রথম জ্বলুক তবো ঘরে।” (জীবনানন্দ দাশ)
আরও পড়ুন – ভারতে রেলপথ প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ও প্রভাব আলোচনা করো