অরণ্যচারী মানুষ এই শ্বাপদসংকুল পৃথিবীর বক্ষে অবতরণ করা মাত্রই বিজ্ঞানসাধনায় আত্মনিয়োগ করেছে। নবাবির্ভূত মানবকুল অস্তিত্বরক্ষার তাগিদে প্রথমে খাদ্যের সন্ধানে ব্যাপৃত হলেও তার বোধ ও চাহিদার ক্রমবিবর্তন তাকে বিজ্ঞানের সাধক করে তুলেছে। বিজ্ঞানের গবেষণালব্ধ বিশেষ জ্ঞান মানুষকে প্রদান করেছে বেগ। প্রকৃতির বিবিধ সামগ্রীকে আপন করায়ত্ত করার বাসনায় যে বিজ্ঞানের জন্ম, দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে তার বিজয়রথ আজ সর্বত্রগামী। মানবজীবনের অন্দরে প্রবেশ করে বিজ্ঞান তার স্রষ্টাকেই আপন দাসে পরিণত করেছে।
বিজ্ঞানের জয়যাত্রা
বর্তমানে এই বিজ্ঞানের যুগে বিজ্ঞান ও সভ্যতা প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছে। জীবনের অসহায়তাকে বিদূরিত করার সাধনায়, প্রকৃতিকে বশে আনার তাড়নায় প্রাচীন প্রস্তর যুগে বিজ্ঞানচর্চার সূত্রপাত ঘটে। সভ্যতার ধারাপথ পেয়ে এই বিজ্ঞানচর্চাকে অবলম্বন করেই মানুষ মহাকাশ যুগে উপনীত হয়েছে। ক্রমোন্নয়ন ও পরিবর্তনকে পাথেয় করেই প্রযুক্তিবিদ্যার অভাবনীয় উৎকর্ষ সাধন সম্ভব হয়েছে। এর ফলে মানবজীবনেও নানা পরিবর্তন এসেছে। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, নিরাপত্তাবোধ বৃদ্ধি পাওয়া জীবনস্রোত হয়ে উঠেছে সরলগামী।
বিজ্ঞান নির্ভর বর্তমান জীবন: মানবজীবনের কেন্দ্রস্থলে বিজ্ঞানের অবস্থিতি। তাই দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের সঙ্গে বিজ্ঞান অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। বিজ্ঞান ব্যতীত সুষ্ঠুভাবে জীবনযাপন আজ কল্পনাতীত বিষয়। বিজ্ঞানের অগ্রসরমানতার ওপর নির্ভরশীল মানবজীবন তাই পূর্ণতই বিজ্ঞান নির্ভর।
প্রাত্যহিক প্রয়োজনসমূহ ও বিজ্ঞান
দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান আজ পরীক্ষিত সত্য। প্রত্যুষে যে অ্যালার্ম ঘড়িটি আমাদের নিদ্রাভঙ্গ করে তার থেকে শুরু করে স্নানকক্ষে ব্যবহার্য প্রতিটি সামগ্রী, রন্ধনশালার দ্রব্যসমূহ, স্কুল-কলেজ-অফিসে অবশ্য ব্যবহৃত বস্তুসকল-সর্বত্রই বিজ্ঞানের অবাধ গমনাগমন। আবার, আমাদের অবসরবিনোদনের ক্ষেত্র থেকে শুরু করে প্রাত্যহিক যাত্রাপথকে সুগম করার দায়িত্বও বিজ্ঞানের স্কন্ধেই অর্পিত, বিজ্ঞানহীন জীবন তাই দুঃস্বপ্নের সমতুল্য।
স্বাচ্ছন্দ্য বিধানে বিজ্ঞান
দৈনন্দিন জীবনকে সুখময় করে তুলতে বিজ্ঞানের অবদান কল্পনাতীত। রান্না করার গ্যাসের চুল্লি বা আধুনিক বিদ্যুৎচালিত চুল্লিসমূহ, বাটনা বাটার আধুনিক বিদ্যুৎচালিত যন্ত্র, খাদ্য সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজ, কাপড় কাচার ওয়াশিং মেশিন প্রভৃতি গৃহিণীদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান করেছে। আবার হিসাবযন্ত্র, যন্ত্রগণক, বৈদ্যুতিক লিফট, শীতাতপনিয়ন্ত্রণকারী যন্ত্র, গাড়ি চালানোর স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র, বেতার, টেলিফোন, মোবাইল প্রভৃতি কর্মজীবনেও স্বাচ্ছন্দ্যের বার্তাবহন করে এনেছে-ছাত্রছাত্রী বা চাকুরিজীবী-ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের জীবন হয়ে উঠেছে অনেক সহজ।
অবসরবিনোদনে বিজ্ঞান
অবসরবিনোদনে বিজ্ঞানের অবদান অবিসংবাদিত। টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, বেতার কর্মক্লান্ত ব্যক্তিকে যে নির্ভেজাল বিনোদনের সুযোগ প্রদান করেছে তা মানুষকে পরবর্তী কর্মব্যস্ত জীবনপথে অগ্রসর হওয়ার প্রেরণা প্রদান করে। তা ছাড়া বিজ্ঞানের এই অবদানগুলি মানুষকে একঘেঁয়ে জীবনের অবসাদ থেকে মুক্তি প্রদান করে।
কৃষি ও প্রযুক্তি বিজ্ঞানের জয়যাত্রা
বর্তমানে কৃষি থেকে শুরু করে বৃহৎ শিল্পের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবারিত হস্তক্ষেপ ও অকল্পনীয় জয়যাত্রা। কৃষিক্ষেত্রে লাঙলের পরিবর্তে ট্র্যাক্টর, পাওয়ার টিলার ব্যবহারের পাশাপাশি কীটনাশক-রাসায়নিক সারের প্রয়োগ আধুনিক ঝাড়াই-মাড়াই মেশিন তথা সেচ পাম্পের ব্যবহার কৃষি ব্যবস্থায় অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটিয়েছে। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে জমির উৎপাদনশীলতা।
অপরপক্ষে, বড়ো বড়ো আধুনিক মানের বাড়ি তৈরি, সেতু নির্মাণ, বৃহদায়তন কলকারখানা স্থাপন, পাহাড় কেটে টানেল তৈরি-সবই তো বিজ্ঞানের দান।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান
চিকিৎসাবিজ্ঞানের দ্রুত উন্নতির ফলে বহু দুরারোগ্য ব্যাধি আজ নিরাময়যোগ্য হয়ে উঠেছে। দৃষ্টিহীনকে দৃষ্টিদান বা বধিরকে বাকশক্তি প্রদানের পাশাপাশি বসন্ত-কলেরা-প্লেগ-ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কারও সম্ভব হয়েছে। কিডনি প্রতিস্থাপন, ওপেন হার্ট সার্জারি, ক্যানসার নিরাময় কিংবা যক্ষ্মার সফল চিকিৎসা আজ সম্ভব। টেস্ট-টিউব বেবি চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক বিরাট বিস্ময়।
বিজ্ঞান ও কম্পিউটার
বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক আবিষ্কার কম্পিউটার প্রযুক্তি যার নবায়মানের ধারা আজও অব্যাহত। অফিস-আদালত, কারখানা-হাসপাতাল, রেলওয়ে-এয়ারলাইনস, ব্যাংক-বিমা-শিক্ষাক্ষেত্র বা ব্যক্তিক প্রয়োজনে সর্বত্রই কম্পিউটারের একচ্ছত্র আধিপত্য। এর সঙ্গে ইনটারনেটের সংযুক্তি সমগ্র বিশ্বকে মানুষের মুষ্টাগত করে তুলেছে। ইনটারনেটবিহীন জীবন বর্তমান প্রজন্মের কাছে কল্পনাতীত।
বিজ্ঞানের ক্ষতিকর দিক
মানবজীবন বর্তমানে মাত্রাতিরিক্ত বিজ্ঞাননির্ভর যা মানুষকে সততই শ্রমবিমুখ করে তুলেছে। এর ফলশ্রুতিতে মানুষ নানাপ্রকার শারীরিক ও মানসিক ব্যাধির শিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। তা ছাড়া বিজ্ঞান মানুষকে বেগ প্রদান করলেও কেড়ে নিয়েছে আবেগ। ফলে মানবিক সম্পর্ক আজ ধূলিস্যাৎ হওয়ার পথে। এ ছাড়া বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার মানুষকে শক্তির নেশায় মাতোয়ারা করে তুলেছে ফলে হিরোসিমা-নাগাসাকি কাণ্ড যে ভবিষ্যতে আর ঘটবে না তাও বলা যায় না।
উপসংহার
বিজ্ঞান এক বিশুদ্ধ জ্ঞান মাত্র। তাই একে যেমন কল্যাণময় রূপে সকলের সামনে উপস্থাপিত করতে হবে তেমনি গ্রাম-শহর, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সর্বস্তরে পৌঁছে দেওয়াও প্রয়োজন। সমাজের একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি নয়, সকল স্তরের মানুষ যাতে বিজ্ঞানের উপকার লাভে সমর্থ হয় এমনভাবে বিজ্ঞানের পুনর্নির্মাণ প্রয়োজন। বিজ্ঞানের ধর্ম হল নিষ্কাম ধর্ম আর সেই পথেই বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে চির-অক্ষুণ্ণ রাখা প্রয়োজন।