বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ রচনা
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ রচনা
|
ভূমিকা
জীবধাত্রী ধরিত্রী সৃষ্টিশীলতার বিশেষ পরিণতি অসংখ্য বিচিত্র সব পশুপক্ষী। আপাতদৃষ্টিতে মানবজগতের সভ্য জীবন ও অরণ্যচারীদের আরণ্যক জীবন স্বতন্ত্র হলেও তা গভীর সূত্রে গ্রথিত। বাস্তুতন্ত্র অনুযায়ী জীববৈচিত্র্যই প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। তাই এর বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি মহাকালের সম্মুখীন করতে পারে ধরিত্রীকে। সেজন্য বন্যপ্রাণী নিধনের পরিবর্তে সম্মিলিত প্রয়াসে জীববৈচিত্র্য তথা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের সংকল্প গ্রহণ করা উচিত।
বিলুপ্তির কারণ
মানুষের স্বার্থপরতার ফলশ্রুতিতেই বর্তমানে প্রকৃতি মাতার ক্রোড়লগ্ন সন্তানদের অস্তিত্ব আজ বিপন্নপ্রায়। বিবিধ কারণে নস্যাৎ হয় তাদের জীবন-(১) মানব বসতি নির্মাণের প্রয়োজনে বনাঞ্চল ধ্বংস হয়। নগর-শহর ও গ্রামের পত্তন ঘটানোর জন্য বনভূমি কর্তিত হওয়ায় বন্যপ্রাণীর বসবাসযোগ্য স্থানসংকুলানের অভাব ঘটে। (২) কলকারখানা বা শিল্পোেদ্যগের আয়োজনও বনভূমি ধ্বংসের পাশাপাশি বন্যপ্রাণী অবলুপ্তির অপর কারণ। (৩) অনেক সময় বন্যপ্রাণীরা বাঁচার তাগিদে লোকালয়ে পৌঁছে গেলে মানুষের হাতেই মারা পড়ে। (৪) প্রাচীনকালের রাজা-জমিদাররা আমোদ-প্রমোদের জন্য এবং বিংশ শতাব্দীর সূচনায় ইংরেজরা উপনিবেশ স্থাপনের সময় খাদ্য ও বিনোদনের জন্য বন্যপ্রাণী শিকার করত। এই উদ্দেশ্যে অবশ্য বর্তমানেও পশুবধ হয়। (৫) প্রোটিন জাতীয় খাদ্যের প্রয়োজনের অজুহাতে বেশকিছু পশু মৃত্যুমুখী হয়ে পড়েছে। (৬) আধুনিক যুগে বাণিজ্যিক স্বার্থে বন্যপ্রাণীর মাংস, হাতির দাঁত, কস্তুরী, গন্ডার-হরিণের শৃঙ্গ, বিভিন্ন প্রাণীর চামড়ার প্রয়োজন হয়। তাই মূলত এই চোরাইচালানের জন্যই বেআইনিভাবে বহু প্রাণীর হত্যা হয়।
ভারতবর্ষে বন্যপ্রাণী নিধন
ভারতবর্ষে বন্যপ্রাণী নিধনের উদাহরণ দুর্লভ দৃষ্ট নয়। দুর্গাপুরের বনভূমি লুপ্ত হয়েছে ইস্পাত প্রকল্পের প্রয়োজনে। ঘাটশিলা, ঝাড়গ্রাম, শালবনি ও সাঁওতাল পরগনার শালপিয়ালের বনও আজ নিঃশেষিত হয়ে আসছে। মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা ও হিমালয়ের পাদদেশের সবুজ সম্পদ ও সেখানে বসবাসকারী প্রাণীদের অস্তিত্ব আজ বিপদসীমা অতিক্রম করে গেছে। বন্যপ্রাণী হত্যা করার নির্মম কদর্যতার কারণে বাঘের সংখ্যা ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে যেখানে ছিল পনেরো হাজার তা বর্তমানে দেড় হাজারও নেই। জীববিজ্ঞানীদের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে পঞ্চাশ বছর আগে কমপক্ষে পাঁচশো প্রজাতির স্তন্যপায়ী, প্রায় দু-হাজার প্রজাতির পক্ষীশ্রেণি এবং ত্রিশ হাজার প্রজাতির কীটপতঙ্গ ছিল যা বর্তমানে কমে যথাক্রমে তিনশো, বারোশো, কুড়ি হাজারে পরিণত হয়েছে।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের গুরুত্ব
স্বাভাবিক পরিবেশে বন্যপ্রাণীদের সৌন্দর্য উপভোগ করা, বিভিন্ন প্রজাতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা ও অর্থনৈতিক কারণে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ প্রয়োজন যা বর্তমানে মানুষের ব্যক্তিগত কারণেই সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়; কারণ-(১) বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের দ্বারাই প্রাকৃতিক পরিবেশে অক্সিজেনের জোগান অক্ষুণ্ণ রাখা সম্ভব। (২) লুপ্তপ্রায় বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা যায়। (৩) প্রাকৃতিক পরিবেশে খাদ্য-খাদকের ভারসাম্য অর্থাৎ খাদ্যশৃঙ্খল বজায় রাখা সম্ভবপর হয়। (৪) জীবজন্তুর খাদ্যের জোগান অব্যাহত থাকে। (৫) প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবৃদ্ধির দ্বারা – মানবসমাজকে নির্মল আনন্দ প্রদান সম্ভব। (৬) বন্যপ্রাণী ক্রয়বিক্রয়ের দ্বারা বৈদেশিক মুদ্রার্জন সম্ভব। (৭) বাস্তুতন্ত্রের কার্যকারী একক মানুষের জীবন জৈব-অজৈব উপাদানের পরিবর্তনের কারণে বিপন্নতার সম্মুখীন হচ্ছে। তাই মানুষের অস্তিত্ব বজায় রাখতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ প্রয়োজন। (৮) বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের দ্বারা পর্যটন শিল্পের বিকাশসাধন সম্ভব। (৯) গ্লোবাল-ওয়ার্মিং-এ নিয়ন্ত্রণ লাভ সম্ভব।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উপায়
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য বেশ কয়েকটি পন্থা গ্রহণযোগ্য- (১) নিঃশেষিত অরণ্যাঞ্চলকে পুনরায় বৃক্ষরোপণের দ্বারা বিকশিত করে তুলতে হবে। (২) বিলুপ্তপ্রায় জীবজন্তুর পুনরায় প্রজননের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। (৩) নিঃশেষিত প্রায় শ্রেণির প্রাণীদের হত্যা করা যা আইনত নিষিদ্ধ তা কার্যক্ষেত্রে অনুসরণ করা প্রয়োজন। (৪) চোরাইচালানকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন জারি করতে হবে। (৫) দূষণমুক্ত পরিবেশ এই সকল প্রাণীদের জীবনধারণের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন। তাই বনমহোৎসবের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
সংরক্ষণের উদ্যোগসমূহ
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সরকারি উদ্যোগে ভারতে বনমহোৎসবের সূচনা হয়। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন পৃথক পৃথক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে এবং সে সকল খাতের ব্যায়বরাদ্দেরও বৃদ্ধি ঘটানো হয়েছে। ১৯৭২-এ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করে ৪৩টি প্রজাতির পশু ও ১৮টি প্রজাতির পাখিকে সম্পূর্ণরূপে সংরক্ষণযোগ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
জাতীয় উদ্যান ও অভয়ারণ্য
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য ভারতে বিভিন্ন জাতীয় উদ্যান, অভয়ারণ্য, সংরক্ষিত অরণ্য প্রভৃতির আয়োজন গ্রহণ করা হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক (আয়তন- ১৩১৮.৫৪ বর্গকিলোমিটার); কেরলের পেরিয়ার অভয়ারণ্য; পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন অভয়ারণ্য (রয়াল বেঙ্গল টাইগারের জন্য বিখ্যাত), জলদাপাড়া অভয়ারণ্য (একশৃঙ্গবিশিষ্ট গন্ডার, বাইসন, হাতি ইত্যাদির বিচরণ ক্ষেত্র); ওড়িশার শিমলিপাল, কর্ণাটকের বন্দিপুর; হাজারিবাগ ও দুধওয়ার ন্যাশনাল পার্ক বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ভারতের প্রায় ৯০০০০ বর্গকিলোমিটার স্থান জুড়ে মোট ১০৩টি ন্যাশনাল পার্ক ও ৫১৫টি অভয়ারণ্য অবস্থিত।