উন্নয়ন ও পরিবেশ রচনা/উন্নয়ন বনাম পরিবেশ রচনা
|
“দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর, লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর হে নব সভ্যতা।”
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভূমিকা
সমগ্র প্রাণীজগৎকে পরিবেষ্টন করে আছে জল-স্থল-অন্তরিক্ষ। এই সমগ্রটাকে নিয়েই আমাদের পরিবেশ, যাকে অবলম্বন করেই সমগ্র জীবজগতের জীবনধারণ সম্ভব হয়। কিন্তু বর্তমানে সভ্যতার অগ্রগতির হাত ধরে, প্রযুক্তি বিজ্ঞানকে অবলম্বন করে মানুষ যতই উন্নয়নের সিঁড়ি বেয়ে ঊর্ধ্বগমনে আত্মবিনিয়োগ ঘটাচ্ছে ততই সে দূরে চলে যাচ্ছে আরণ্যক প্রকৃতির কোমল শ্যামলতা থেকে। এরই ফলশ্রুতি সবুজ সম্পদের অভাবে বিজ্ঞানের কৃপাধন্য মানবসভ্যতা, সভ্যতার অভ্রভেদী শিখরদেশে পৌঁছে দূষণ জর্জরিত কায়াযোগে তার মূলদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।
উন্নয়ন ও পরিবেশের সম্পর্কসূত্র
উন্নয়ন ও পরিবেশ পরস্পর গভীরভাবে সম্পর্কসূত্রে আবদ্ধ। পরিবেশকে অবলম্বন করেই, পরিবেশ থেকে উপাদান সংগ্রহ করেই যেহেতু মানুষ উন্নয়নের পথে অগ্রসরমান তাই উন্নয়নের বহরে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় পরিবেশই। বিজ্ঞানের কল্যাণে বর্তমানে নানাভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে। তাই উন্নয়ন ঘটালেও তাকে হয়ে উঠতে হবে পরিবেশবান্ধব। সামাজিক, রাষ্ট্রনৈতিক, প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক সকল পরিবেশের মধ্যে একটা সুস্থির ও সহজ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। তবেই উন্নয়ন স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে।
কৃষি উন্নয়ন ও পরিবেশ
কৃষি প্রধান ভারতবর্ষে কৃষিক্ষেত্রের উন্নয়নের অর্থই হল জমির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, জমির উৎকর্ষ বর্ধন ও কৃষকের শ্রমলাঘব। কৃষির উন্নয়নের জন্য বর্তমানে বিভিন্ন উচ্চফলনশীল বীজ, কীটনাশক ওষুধ প্রয়োগ করা হয়, পরিবর্তিত হয়েছে কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহার্য সামগ্রীসমূহও। এগুলি প্রয়োগের দ্বারা আপাতদৃষ্টিতে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না বলে মনে হলেও পরোক্ষভাবে পরিবেশদূষণের মাত্রা বর্ধিত হচ্ছে। কৃষিজমি বৃষ্টির জলে ধৌত হয়ে জমিতে ব্যবহৃত সার-কীটনাশক পুকুর ও নদীর জলে মিশে জলদূষণ যেমন ঘটাচ্ছে তেমনি ঘটছে মৃত্তিকা দূষণও।
শিল্পের উন্নয়ন ও পরিবেশ
স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে শিল্পোন্নয়নকে ব্যাপক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে কুটির ও ক্ষুদ্রশিল্পের পাশাপাশি বৃহৎ শিল্পের প্রভূত প্রসার ঘটিয়ে দেশের অর্থনৈতিক মানোন্নয়ন যেমন সম্ভবপর হয়েছে তেমনি বেড়েছে কর্মসংস্থানের সুযোগ। কিন্তু বৃহৎ শিল্পের উন্নয়ন পরিবেশদূষণকে বহুল মাত্রায় ত্বরান্বিত করেছে। শিল্পকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া বাতাসে গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রা যেমন বর্ধিত করে চলেছে, তেমনি কারখানার বর্জ্য পদার্থসমূহ নদী ও সমুদ্রের জলে নিক্ষিপ্ত হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জলজ প্রাণীদের জীবন। মানবজীবনে ঘনীভূত হচ্ছে বিবিধ মারণ রোগের বিষবাষ্প।
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে পরিবেশ
উন্নয়নের ধারাপথ বেয়ে উন্নত রূপ লাভ করছে যোগাযোগ ব্যবস্থাসমূহও। প্রকৃতিকে অবলম্বন করেই যেহেতু যোগাযোগ ব্যবস্থাসমূহ নির্মিত হয়, তাই এই নির্মাণকার্যের দ্বারা সর্বাধিক প্রভাবিত হয় প্রকৃতিই। দুর্গম অরণ্যসংকুল পথকে সুগম করে তোলার প্রয়াসে একদিকে যেমন সবুজ সম্পদ নিধনের পরিমাণ ক্রমবর্ধিত তেমনই নির্মাণকার্য চলাকালে সৃষ্ট বর্জ্য পরিবেশদূষণ ঘটাচ্ছে। তা ছাড়া পেট্রোল-ডিজেল চালিত যানসমূহ থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ুদূষণের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করছে। সর্বোপরি যানবাহনগুলির কর্ণবিদারী হর্নের আওয়াজ শব্দদূষণকে ক্রমবর্ধিত করছে।
প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নয়ন ও পরিবেশ
সময়ের ক্রম-অগ্রসরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নয়ন পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নয়নের লেখচিত্র এখনও ঊর্ধ্বগামী। মহাকাশ গবেষণায় সাফল্য, পরমাণু গবেষণায় কৃতকার্যতা কিংবা নিত্যনতুন শ্রমলাঘবকারী প্রয়োজনীয় সামগ্রীর আবিষ্কার সবক্ষেত্রেই উন্নয়নশীলতা লক্ষিত। কিন্তু এই সকল গবেষণার কারণে পরিবেশ ব্যাপকভাবে দূষিত হচ্ছে। শুধু জনাকীর্ণ লোকারণ্যই নয় নিষ্কলুষ বরফের দেশও এখন দূষণ কলঙ্কে কলঙ্কিত।
জীবজগতে উন্নয়নের যুগ্মপ্রভাব
উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান রূপ জীবজগতে যুগ্মপ্রভাব বিস্তারী। একদিকে এই মরজগতের কালব্যাপ্তি যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে তেমনি রোগের প্রাদুর্ভাবের মাত্রা ও সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান। দূষিত জল, দূষিত মাটি-বাতাস বহু মনুষ্যেতর প্রাণীকে চিরতরে বিলুপ্ত করে দিচ্ছে; ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছে জলজ প্রাণীদের জীবন। মানব জগৎও বীভৎস রূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। ক্যানসার ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগের পাশাপাশি বিবিধ নিত্যনতুন স্নায়বিক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে চলেছে। পরমাণু গবেষণার ফলশ্রুতি ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করে চলেছে। তাই প্রযুক্তি আমাদের শ্রম লাঘব করে উন্নত জীবনের অঙ্গীকার প্রদান করলেও সে জীবন রোগ ও বিনাসের অভিশাপে পূর্ণ।
উপসংহার
উন্নয়ন ও জীবনের সমার্থকতা লাভ সর্বাগ্রে প্রয়োজন, নতুবা উন্নয়ন প্রকৃত অর্থে সার্থকতা লাভে সমর্থ হবে না। তাই উন্নয়নের আবাহন-গীতি রচনা করতে হবে পরিবেশকে সুরক্ষিতকরণের মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে। এই উদ্দেশ্যে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবেই দূষণমুক্ত এক পরিবেশ গঠন ও প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব।