বায়ু দূষণ ও তার প্রতিকার রচনা
|
ভূমিকা
এই মরজগতের প্রতিটি প্রাণীর জীবনযাপন পরিবেশের সঙ্গে একান্তভাবে লগ্ন। বিশেষত জীবজগতের অস্তিত্ব বায়ু ব্যতিরেকে কল্পনাতীত। কিন্তু যন্ত্র সভ্যতার বিষবাষ্পে দিশাহারা মানুষের একটাই প্রার্থনা ‘বাঁচো এবং বাঁচাও’। এক সময় মানুষ যে পৃথ্বী জননী বক্ষে নিশ্চিন্তে মাথা রেখে নিশিযাপন করেছে তারই নিশ্বাস আজ কলঙ্কিত। মনুষ্যসৃষ্ট প্রকৃতির ভারসাম্য বিনষ্টকারী বিভিন্ন পদার্থ থেকে যেসকল মারণবায়ু নির্গত হয় তার প্রভাবে মানুষের প্রশ্বাস গ্রহণের উপযুক্ত বাতাসটুকুও আজ অব্যাহত নেই। অর্থাৎ, বায়ু হয়ে উঠেছে দূষিত।
বায়ুদূষণ কী
ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO)-এর মতে বায়ুমণ্ডলের মধ্যে দূষিত ধোঁয়া, গ্যাস, গন্ধ, বাষ্প ইত্যাদি অনিষ্টকারী পদার্থের সমাবেশ ঘটলে তাকে বায়ুদূষণ বা Air Pollution বলে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্যে অনিষ্টকারী পদার্থের সমাবেশ যখন মানুষ ও সমগ্র পরিবেশের ক্ষতিসাধনে সক্ষম হয় তখন তাকেই বলা হয় বায়ুদূষণ।
বায়ুদূষণের পূর্বেতিহাস
বায়ুদূষণ কোনো সাম্প্রতিক কালের ঘটনা নয়, এর ইতিহাস দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকেও প্রসারিত। ১২৭৩ খ্রিস্টাব্দে কয়লা দহনে উৎপন্ন ধোঁয়া থেকে সৃষ্ট দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আইন বলবৎ হয়। ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট প্রথম এডওয়ার্ড’ ঘোষণা করেন কয়লা দহনে বায়ুদূষণকারী ব্যক্তির শিরশ্ছেদ ঘটানো হবে। এই আইন ১৩০৬-এ একবার কার্যকারীও হয়। তবে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের সময় এই আইন অমান্য করা হয়।
বায়ুদূষণের উৎসসমূহ
বায়ুদূষণের উৎসকে মোটামুটি দ্বিধাবিভক্ত করা যায়- প্রাকৃতিক উৎস ও মনুষ্যসৃষ্ট উৎস। (১) প্রাকৃতিক উৎস বা প্রাকৃতিক দূষকগুলির মধ্যে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, অরণ্যের দাবদাহ, বায়ুঝড়, মৃত পচনশীল উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহ প্রধান। (২) মনুষ্যসৃষ্ট উৎস বা মনুষ্যসৃষ্ট বায়ুদূষকের মধ্যে কলকারখানা, কৃষি পদ্ধতি, পৌর প্রতিষ্ঠানের জঞ্জাল দহন, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, শিল্প প্রক্রিয়াকরণ, গৃহস্থালির জীবাশ্ম জ্বালানির দহনের মতো স্থির উৎসের উল্লেখ যেমন করা যায় তেমনি বিবিধ পরিবহণ মাধ্যমের মতো সচল উৎসকেও অস্বীকার করা যায় না।
বায়ুদূষণের প্রভাব
বর্তমানে বায়ুদূষণের সমস্যা সর্বাপেক্ষা ব্যাপক রূপ ধারণ করেছে। বায়ুমণ্ডলে দূষণ বর্ধিত হওয়ায় প্রথমত, গ্রিনহাউস এফেক্ট বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থাৎ, হাইড্রোকার্বন, কার্বন ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইডের মতো বায়ুকণা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে উন্নতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে, বৃষ্টিপাত হয়ে পড়ছে অনিশ্চিত। উপকূলবর্তী নীচু অঞ্চলগুলি প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি কৃষি-শিল্পও এর ফলে ব্যাহত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইড বৃদ্ধি পাওয়ায় বৃষ্টির সময় সেই কার্বন ডাইঅক্সাইড বৃষ্টির জলে মিশে কার্বলিক অ্যাসিডে পরিণত হয়ে অ্যাসিড বৃষ্টি ঘটাচ্ছে। এই বৃষ্টির জলে অতিরিক্ত মাত্রায় সালফিউরিক অ্যাসিড, নাইট্রিক অ্যাসিড প্রভৃতি মিশে থাকে। তৃতীয়ত, ওজোন স্তরে ফুটো হয়ে দ্রুত সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে প্রবেশ করছে। চতুর্থত, মানুষের মধ্যে ক্যানসার, শ্বাসকষ্ট, দীর্ঘস্থায়ী কাশি, শ্বাসনালীর স্ফীতি, বন্ধ্যাত্ব, পেশির দুর্বলতা, জন্মত্রুটি, গা-বমি, মাথা ধরা প্রভৃতি বিবিধ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটছে। সমগ্র জীবকুল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এর প্রভাবে।
বায়ুদূষণ প্রতিরোধের উপায়
বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য বিঘ্নিত হওয়ায় যে বায়ুদূষণ ঘটে চলেছে তা প্রতিরোধের জন্য- (১) যন্ত্রপাতি, কলকারখানা, যানবাহন থেকে নির্গত গ্যাসকে বাতাসে ছাড়ার আগে যান্ত্রিক উপায়ে শোধন করতে হবে। (২) দূষক কম উৎপাদনকারী জ্বালানি ব্যবহার করতে হবে। (৩) উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে দূষিত পদার্থের উৎপাদন হ্রাস করতে হবে। (৪) বৃক্ষচ্ছেদন আইন করে নিষিদ্ধ করে তা কার্যকারী করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। (৫) পুনরাবর্তনের মাধ্যমে বর্জ্য পদার্থের পুনরায় ব্যবহার করতে হবে। (৬) জনসচেতনতা বৃদ্ধি করে শক্তি সম্পদের ব্যবহার হ্রাস করতে হবে।
উপসংহার
বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য বেঙ্গল স্মোক নুইসেন্স অ্যাক্ট আইন (১৯০৫, ১৯৮০-তে সংশোধিত), ভারতীয় বয়লার আইন (১৯২৩), শিল্প নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন আইন (১৯৫১), গুজরাট স্মোক নুইসেন্স আইন (১৯৬৩) প্রভৃতি জারি করা হয়েছে। এই সকল আইন কার্যকারী ভূমিকা গ্রহণ করে যাতে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় সেদিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। সরকারি উদ্যোগ ও ব্যক্তিগত প্রয়াসেই বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।