হরিনাথ মজুমদার বা’ ‘কাঙাল হরিনাথ’ সম্পর্কে কী জান? |
ভূমিকা
১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে কাঙাল ফিকিরচাঁদ গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা নামক পত্রিকা প্রকাশ করেন। কাঙাল ফিকিরচাঁদের (প্রকৃত নাম ছিল হরিনাথ মজুমদার (১৮৩৩-১৮৯৬ খ্রি.)। তিনি ছিলেন একজন প্রতিভাবান সাংবাদিক, লেখক, গীতিকার ও মানবদরদি সম্পাদক।
প্রথম জীবন
১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত নদিয়া জেলার কুমারখালিতে (বর্তমানে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলায় অবস্থিত) হরিনাথ মজুমদার জন্মগ্রহণ করেন। পিতৃ-মাতৃহীন অনাথ শৈশব এবং কৈশোরে তীব্র দারিদ্র্য ও অনিশ্চয়তার সঙ্গে কঠোর সংগ্রামের পর স্বশিক্ষিত ও স্বনির্ভর এই মানুষটি বঙ্গীয় সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক অনন্য নজির রেখে গেছেন। দারিদ্র্য ছিল তাঁর ছায়াসঙ্গী। তাই তিনি কাঙাল হরিনাথ নামে পরিচিত।
গ্রামবার্তা প্রকাশিকার আবির্ভাব
১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে হরিনাথের সম্পাদনায় এই পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রথমে গিরিশ বিদ্যারত্ন প্রেস থেকে ও পরে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে কুমারখালির মথুরানাথ প্রেস নামক ছাপাখানা থেকে পত্রিকা প্রকাশের কাজ চলতে থাকে। প্রথমে ‘মাসিক’ পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হলেও পরে ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের জুন-জুলাই মাসে এটি ‘পাক্ষিক’ ও ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল-মে মাস থেকে এই পত্রিকা ‘সাপ্তাহিকে’ পরিণত হয়। এই পত্রিকায় নিয়মিত সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, রাজনীতির সংবাদের পাশাপাশি ব্রিটিশ, নীলকর সাহেব ও সুদখোর মহাজনদের অত্যাচার ও সমাজের অন্ধকার দিকগুলিকে তুলে ধরা হত।
শোষণের বিরোধিতা
কাঙাল হরিনাথ সম্পাদিত ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ ছিল সমকালীন বাংলার গ্রামীণ জীবনের যথার্থ দর্পণ বা প্রতিচ্ছবি। এই পত্রিকায় জমিদার, মহাজন, নীলকর সাহেব ও সরকারের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে লেখা প্রকাশিত হত। ফলে অত্যাচারের মাত্রা অনেকটা হ্রাস পেয়েছিল। অন্যদিকে শিক্ষিত সমাজের নজরে খবরগুলি আসাতে ব্রিটিশবিরোধী জনমত গড়ে ওঠে।
শিক্ষার প্রসার
এই পত্রিকায় সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, বীরত্বগাথা প্রভৃতি প্রকাশিত হত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মির মোশারফ হোসেন, জলধর সেন প্রমুখের রচনা শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়েছিল। হরিনাথ কয়েকজন বন্ধুর সাহায্যে নিজ গ্রামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
সাহিত্য ও সংগীত প্রতিভা
কাঙাল হরিনাথ রচিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল ‘বিজয়বসন্ত’, ‘চারুচরিত্র’, ‘কবিতা কৌমুদী’ প্রভৃতি। লালন ফকির তাঁর পত্রিকার জন্য লেখা পাঠাতেন। হরিনাথ মজুমদারের একটি উল্লেখযোগ্য ও স্মরণীয় গান হল ‘হরি দিন তো গেল, সন্ধ্যা হল পার করো আমারে।’ ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে হরিনাথ বাউল সংগীতের দল গঠন করেন, যার নাম ছিল- ‘কাঙাল ফকিরের চাঁদের দল’।
উপসংহার
কাঙাল হরিনাথ ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল- ‘নদিয়া জেলাবাসী একজন মহান ব্যক্তিত্বকে হারালো।’ ভাগ্যের পরিহাস হল এই যে, হরিনাথ বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ালেও, তাঁর বিপদের দিনে তিনি সমাজের কাউকে পাশে পাননি। একমাত্র লালন ফকির ও তাঁর দল এগিয়ে এসেছিলেন। যাইহোক, গ্রামবার্তা প্রকাশিকা ছিল গ্রামীণ আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, আর হরিনাথ ছিলেন গ্রামীণ সাংবাদিকতার জনক।