কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ এবং ভারতে চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করো

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ এবং ভারতে চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করো

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ এবং ভারতে চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করো
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ এবং ভারতে চিকিৎসাবিদ্যা চর্চা

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ এবং ভারতে চিকিৎসাবিদ্যা চর্চা

ভূমিকা

১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক কলকাতায় ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি হল ভারত তথা এশিয়ার প্রথম ইউরোপীয় চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। ভারতে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার বিকাশে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল–

[1] এদেশীয় ছাত্রছাত্রীদের আধুনিক পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শী করে তোলা এবং

[2] এদেশীয় চিকিৎসাবিদ্যার পরিবর্তে ইউরোপের উন্নত চিকিৎসাবিদ্যার চর্চা করা।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা

  • গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক ভারতে চিকিৎসাব্যবস্থার অবস্থা জানার জন্য ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে একটি কমিটি নিয়োগ করেন। এই কমিটির সভাপতি ছিলেন জন গ্রান্ট এবং এর ভারতীয় সদস্য ছিলেন রামকমল সেন।
  • এই কমিটি ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২০ অক্টোবর তার রিপোর্ট পেশ করে। এই রিপোর্টে একটি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা ও ইউরোপীয় চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার জন্য সুপারিশ করা হয়।
  • কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জানুয়ারি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার বিকাশ

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার ফলে ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। পাশ্চাত্যের চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার পথপ্রদর্শক ছিল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ভরতির মধ্য দিয়ে কলেজের কাজকর্মের সূচনা হয়। প্রথম ৪৯১) জন ছাত্রের সবাইকে মাসিক ৭ টাকা হারে বৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

পড়ার সময়সীমা

এই কলেজে ৪ থেকে ৬ বছর পড়াশোনা করতে হত। কলেজের পাঠ শেষ করার পর ফাইনাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্রদের সার্টিফিকেট দেওয়া হত।

নেটিভ ডাক্তার

ডাক্তারি পাস করার পর এরা সরকারি চাকরিতে যোগদান করতে পারতেন। এদের ‘নেটিভ ডাক্তার’ বা দেশি ডাক্তার বলা হত। বলা হয়, দেশি ডাক্তারদের প্রারম্ভিক বেতন হবে মাসে ৩০ টাকা, ৭ বছর পর ৪০ টাকা আর ১৪ বছর পর ৫০ টাকা।

পঠনপাঠন

ছাত্রদের শিক্ষার সুবিধার জন্য লাইব্রেরি, উপযুক্ত ভবন ও অ্যানাটমি শিক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ছাত্রদের হাতেকলমে শিক্ষালাভ করার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে যেতে হত। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে প্রতিষ্ঠানটি নতুন ভবনে স্থানান্তরিত হয়।

শিক্ষক

ডা. এম জে ব্রামলিকে এখানকার সুপারিনটেনডেন্ট এবং ডা. এইচ এইচ গুডইভ প্রমুখকে শিক্ষক নিযুক্ত করা হয়। পরে ১৮৩৭-৩৮ খ্রিস্টাব্দে কলেজের শিক্ষকসংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়।

শব ব্যবচ্ছেদ

১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হল শবব্যবচ্ছেদ করে চিকিৎসাবিদ্যার শিক্ষা দেওয়া। মধুসূদন গুপ্ত প্রথম ভারতীয় যিনি মানবদেহের শবব্যবচ্ছেদ করেন। এই ঘটনায় অংশগ্রহণকারী ছাত্ররা হলেন- রাজকৃষ্ণ দে, উমাচরণ শেঠ, দ্বারকানাথ গুপ্ত, নবীনচন্দ্র মিত্র প্রমুখ। ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে আয়োজিত পরীক্ষায় এঁরা উত্তীর্ণ হন। এঁরা সার্জারি ও মেডিসিনে ডাক্তারি করার যোগ্য বলে ঘোষিত হন। এঁরাই ছিলেন পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যায় যোগ্যতা অর্জনকারী প্রথম ভারতীয়।

ক্রমোন্নতি

  • লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অফ সার্জেন-এর পরামর্শে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের পাঠ্যসূচি পরিবর্তন করা হয়।
  • ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন ইউনিভার্সিটি, রয়্যাল কলেজ অফ সার্জনস এই পাঠ্যসূচিকে স্বীকৃতি দেয়।
  • ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এতে মেডিক্যাল ডিগ্রি প্রদানের জন্য চিকিৎসাবিভাগ খোলা হয়। এই বিভাগ মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসা পাঠ্যসূচির পরিবর্তন করে। এই সময় বিশ্ববিদ্যালয় তিনটি মেডিক্যাল ডিগ্রি প্রদান করত-

[1] এল এম এস- লাইসেন্সিয়েট ইন মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি।

[2] এম বি-ব্যাচেলর ইন মেডিসিন।

[3] এম ডি-ডক্টর অফ মেডিসিন।

  • ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে ১০০ শয্যার একটি মহিলা হাসপাতাল তৈরি করা হয়।
  • ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে ৩৫০ জন রোগীর সংকুলান করে একটি বড়ো হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়।
  • ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুন সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, এফ এ’ পাসের পর ছাত্রীদের কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে (সি এম সি)” ভরতির অধিকার দেওয়া হবে। কাদম্বিনী গাঙ্গুলি সি এম সি-তে ভরতি হওয়া প্রথম ভারতীয় ছাত্রী।
  • ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে ছাত্রীদের জন্য মাসিক ২০ টাকা সরকারি বৃত্তি দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়। বিধুমুখী বসু ও ম্যারি মিত্র এই বৃত্তি লাভ করেন। তাঁরা ১৮৮৮-৮৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে চিকিৎসাশাস্ত্রে স্নাতক হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।
  • ১৮৯১-৯২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯০১-০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছাত্রসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ১৯০৬-০৭ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশি আন্দোলনের সময় এই সংখ্যা হ্রাস পেলেও পরবর্তীকালে আবার তা বৃদ্ধি পায়।

উপসংহার

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র এবং চিকিৎসক-শিক্ষকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় চিকিৎসাশিক্ষা ও গবেষণার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ভারতবর্ষের চিকিৎসাশিক্ষার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

Leave a Comment