মেটারনিক ব্যবস্থা

মেটারনিক ব্যবস্থা – আজকের পর্বে মেটারনিক ব্যবস্থা কি তা আলোচনা করা হল।

    মেটারনিক ব্যবস্থা

    মেটারনিক ব্যবস্থা
    মেটারনিক ব্যবস্থা

    মেটারনিক ব্যবস্থা

    মেটারনিকতন্ত্র

    সূচনা: অস্ট্রিয়ার ‘চ্যান্সেলর’ বা প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স ক্লেমেন্স ফন মেটারনিখ (১৭৭৩-১৮৫৯ খ্রিঃ) ছিলেন সমকালীন ইউরোপের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সুদর্শন, মিতবাক্, তীক্ষ্ণধী এবং কূটকৌশলী এই রাজনীতিক ১৮০৯ থেকে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ চল্লিশ বৎসর ধরে অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী-পদে আসীন ছিলেন। দক্ষ কূটনীতিক মেটারনিখকে ‘কূটনীতির রাজপুত্র’ বলে অভিহিত করা হত। ১৮১৫ থেকে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে ইউরোপীয় রাজনীতি ও রাজনীতিকদের ওপর তিনি একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন। বস্তুত এসময় তিনিই ছিলেন ইউরোপের ভাগ্যনিয়ন্তা। এই কারণে ঐতিহাসিক ফিশার ইউরোপের ইতিহাসে ১৮১৫ থেকে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে ‘মেটারনিখের যুগ’ বলে অভিহিত করেছেন।

    মেটারনিখ ব্যবস্থা

    মেটারনিখ ছিলেন সবরকম প্রগতি-বিরোধী ও ঘোরতর রক্ষণশীল রাজনীতিক। তিনটি নীতির দ্বারা তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রভাবিত হয়েছিল। প্রথমত, ইউরোপের প্রাক-বিপ্লব যুগের রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন, দ্বিতীয়ত, ফরাসি বিপ্লব প্রসূত উদারতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও গণতান্ত্রিক ভাবধারার গতিরোধ এবং তৃতীয়ত, অস্ট্রিয়ার স্বার্থকে সর্বতোভাবে বজায় রেখে ইউরোপীয় রাজনীতিতে তাঁর নিরঙ্কুশ প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখা। এই আদর্শগুলিকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য তিনি যে দমনমূলক নীতি গ্রহণ করেন তা ‘মেটারনিখ ব্যবস্থা’ বা ‘মেটারনিখ সিস্টেম’ নামে পরিচিত। 
    •  তাঁর মতে পুরাতনতন্ত্রই হল সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রকৃত ভিত্তি। তিনি প্রাক-বিপ্লব যুগের বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র, রাজার দৈবস্বত্ব, অভিজাততন্ত্র, সামন্ততন্ত্র এবং ক্যাথলিক গির্জার প্রাধান্যে বিশ্বাসী ছিলেন। এই কারণেই ভিয়েনা সম্মেলনে ন্যায্য-অধিকার নীতির দ্বারা প্রাক্-বিপ্লব যুগের রাজবংশগুলিকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শাসন-ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয়। 
    • ফরাসি বিপ্লব ও বিপ্লব-প্রসূত ভাবধারাগুলিকে তিনি মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন। তাঁর কাছে এগুলি ছিল ‘রাজনৈতিক মহামারী’ ও ‘অরাজকতার দূত’। তাঁর চোখে ফরাসি বিপ্লব ছিল ‘ঘোরতর অরাজকতা ও নাশকতা’।
    • মেটারনিখ ছিলেন অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর বা প্রধানমন্ত্রী। অস্ট্রিয়ার হ্যাপস্বার্গ সাম্রাজ্য বহু জাতিগোষ্ঠী ও ভাষাভাষী মানুষকে নিয়ে গঠিত ছিল। মেটারনিখ স্পষ্টই উপলব্ধি করেন যে, ফরাসি বিপ্লব-প্রসূত জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, জাতিবর্গের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার-এইসব আদর্শ যদি অস্ট্রিয়ায় প্রবেশ করে, তাহলে হ্যাস্বার্গ সাম্রাজ্য তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। সুতরাং, মেটারনিখের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির উদ্দেশ্য ছিল এক ও অভিন্ন রক্ষণশীলতা ও স্থিতাবস্থার নীতি কায়েম করে সমগ্র ইউরোপে বৈপ্লবিক ভাবধারাকে প্রতিহত করা।

    মেটারনিখ নীতির প্রয়োগ

    মেটারনিখ নিজ রাজ্য অস্ট্রিয়া এবং জার্মানিতে অতি সাফল্যের সঙ্গে এই নীতি প্রয়োগ করতে সক্ষম হন। বহু জাতিগোষ্ঠী ও ভাষাভাষী মানুষের দেশ অস্ট্রিয়ায় তিনি বিভেদনীতি প্রয়োগ করে এক জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অন্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে লেলিয়ে দেন। দমন-পীড়ন দ্বারা জাতীয়তাবাদীদের কণ্ঠরোধ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে এনে উদারপন্থী ছাত্র ও অধ্যাপকদের কারারুদ্ধ করা হয়। ছাত্র ও অধ্যাপকদের গতিবিধির ওপর নজর রাখার জন্য গোয়েন্দা নিযুক্ত হয়- এমনকি শ্রেণিকক্ষেও • গোয়েন্দা পাঠানো হয়। ছাত্ররা যাতে উদারপন্থা দ্বারা প্রভাবিত হতে না পারে সে জন্য পাঠ্যসূচির পরিবর্তন করা হয়। ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও দর্শনের পঠন-পাঠন নিষিদ্ধ হয়। বিশেষ অনুমতি ব্যতীত বিদেশি পুস্তক, সংবাদপত্র ও অধ্যাপকদের অস্ট্রিয়ায় আসা নিষিদ্ধ হয়। রাজনৈতিক সভা-সমিতি নিষিদ্ধ হয়, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয় এবং বাক-স্বাধীনতা খর্ব করা হয়। ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে কুখ্যাত ‘কার্লস্বাড ডিক্রি’ (Carlsbad Decrees) বা হুকুমনামা জারি করে জার্মানির রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলিকে নিষিদ্ধ করা হয়, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয়, ছাত্র ও অধ্যাপকদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য গোয়েন্দা নিযুক্ত করা হয়। প্রাক্-বিপ্লব অবস্থা বজায় রাখা এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে ভিয়েনা সম্মেলনের অব্যবহিত পরেই ইউরোপীয় শক্তি-সমবায়’ বা ‘কনসার্ট অব ইউরোপ’ গঠিত হয় (১৮১৫ খ্রিঃ)। মেটারনিখের উদ্যোগে এই শক্তি-সমবায় একটি প্রতিক্রিয়াশীল যন্ত্রে পরিণত হয়। এর কাজই হল দমন-পীড়ন দ্বারা সমস্ত প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমন করা। তাঁকে ইউরোপের প্রধানমন্ত্রী’ বা ‘ইউরোপীয় রক্ষণশীলতার জনক’ বলে অভিহিত করা হয়। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের আঘাতে মেটারনিস্তন্ত্রের পতন ঘটে এবং মেটারনিখ ইংল্যান্ডে আশ্রয় গ্রহণ করেন।

    মেটারনিখ ও তাঁর পদ্ধতির পতন অনিবার্য ছিল। মেটারনিখ যে যুগের মানুষ ছিলেন, তার অভিমুখ ছিল জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও উদারতন্ত্রের দিকে। তিনি যুগধর্মকে অস্বীকার করে দমন-পীড়নের মাধ্যমে পুরাতনতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। এটি তাঁর প্রধানতম ত্রুটি। দমন-পীড়নের মাধ্যমে নবজাগ্রত আশা-আকাঙ্খাগুলিকে কিছুদিনের জন্য হয়তো দমিয়ে রাখা যেত, কিন্তু তাদের জয় ছিল অনিবার্য। তিনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থে রক্ষণশীল। নতুন ঐতিহাসিক শক্তির অভ্যুদয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সংস্কার করে পুরোনো কাঠামোকে পরিমার্জন করার নীতি বা পরিকল্পনা তাঁর ছিল না। এটাই রাজনীতিক হিসাবে তাঁর ব্যর্থতা।

    Leave a Comment