নীতি কর্তব্যবাদীরূপে কান্টের অভিমত
পাশ্চাত্য নীতিতত্ত্বের ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায় যে, প্রখ্যাত জার্মান দার্শনিক ও নীতিতাত্ত্বিক কান্ট তাঁর নৈতিক মতবাদের ক্ষেত্রে এক চরম নীতি-কর্তব্যবাদের প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর মতে, চরম নৈতিক নিয়ম হল-এক সর্বজনীন নিঃশর্ত অনুজ্ঞা (Universal Categorical Imperative) এবং এরূপ অনুজ্ঞা বা আদেশটিকে সকল মানুষই মানতে বাধ্য। কান্ট ফলমুখী বা উদ্দেশ্যমুখী নৈতিকতাকে বর্জন করে, কর্তব্যমুখী নৈতিকতার বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। সে কারণেই কর্তব্যবাদের ক্ষেত্রে কান্টের প্রতিষ্ঠিত নৈতিক নিয়মটি নীতি- কর্তব্যবাদ (Rule-Deontology) নামে খ্যাত। কান্টের এই নীতি-কর্তব্যবাদ অনুসারে উল্লেখ করা যায় যে, কোনো কর্তব্যকর্মকে উচিতরূপে গণ্য করা হয় যদি তা এক সর্বজনীন নৈতিক নিয়মকে অনুসরণ করে সম্পাদিত হয়। কান্টের নীতি-কর্তব্যবাদের ক্ষেত্রে অধ্যাপক ফ্রাঙ্কেনা (Frankena) তাঁর ‘Ethics’ গ্রন্থে শুধু নিঃশর্ত অনুজ্ঞার বিষয়টিই উল্লেখ করেছেন এবং নিয়মটির পর্যালোচনা করেছেন।
নীতি-কর্তব্যবাদে কান্টের নিঃশর্ত অনুজ্ঞা
নিঃশর্ত অনুজ্ঞার প্রয়োগে কর্মের নৈতিকতা নির্ধারণ: কান্ট তাঁর নীতিকর্তব্যবাদের পরিপ্রেক্ষিতে নিঃশর্ত অনুজ্ঞাটিকে যেভাবে উল্লেখ করেছেন, তা হল-এমন একটি কর্মনীতি অনুসারে তুমি কাজ করো-যাকে তুমি একটি সর্বজনীন নিয়মে পরিণত করতে পার। এরূপ নিঃশর্ত অনুজ্ঞার প্রয়োগ করেই সমাজে প্রচলিত কোনো নিয়ম নৈতিক কি নৈতিক নয়-তা সহজেই উল্লেখ বা নির্ধারণ করা যায়। প্রচলিত যে-সমস্ত নিয়মের ক্ষেত্রে সর্বজনীন নিঃশর্ত অনুজ্ঞার বিষয়টি যুক্ত হয়, সেই নিয়মটিকেই বলা হয় নৈতিক নিয়ম। অপরদিকে উল্লেখ করা যায় যে, যে-সমস্ত প্রচলিত নিয়মের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়, বা প্রয়োগ করতে গেলে অসংগতি দেখা যায়, সেই সমস্ত প্রচলিত নিয়মগুলি হল অনৈতিক নিয়ম।
স্বাভাবিকভাবেই তাই উল্লেখ করা যায় যে, আমাদের কর্মের নৈতিকতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে নিঃশর্ত অনুজ্ঞার যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে-তা অস্বীকার করা যায় না। এরূপ নৈতিকতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে নিঃশর্ত অনুজ্ঞাটি কখনো-কখনো আবশ্যিক শর্তরূপে, আবার কখনো-কখনো পর্যাপ্ত শর্তরূপে কাজ করে। কারণ, কোনো কর্মের নিয়ম নিঃশর্ত অনুজ্ঞার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হলে, তা নৈতিকরূপে গণ্য হবে না-এরূপ একটি আবশ্যিক শর্তরূপে কাজ করে। আবার বলা যায় যে, কোনো কর্মের নিয়ম নিঃশর্ত অনুজ্ঞার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হলে, তা নৈতিকরূপে গণ্য হবে-এরূপ একটি পর্যাপ্ত শর্তরূপেও কাজ করে। নীতিবিজ্ঞানী ফ্রাঁকেনা অবশ্য দাবি করেন যে, নিঃশর্ত অনুজ্ঞার বিষয়টিকে একটি আবশ্যিক শর্তরূপে গণ্য করা হলেও, পর্যাপ্ত শর্তরূপে গণ্য করা যায়।
ফ্রাঁকেনা-কৃত কান্টের নীতি-কর্তব্যবাদের ব্যাখ্যা
কান্টের নীতি-কর্তব্যবাদের বিষয়টি ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ফ্রাঁকেনা উল্লেখ করেছেন যে, আমরা কোনো কর্ম সম্পাদনের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ের কথা মাথায় রাখি। এই সমস্ত বিষয়গুলি হল-
[1] কর্মকর্তা কর্ম সম্পাদনের ক্ষেত্রে কোনো-না-কোনো নৈতিক নিয়ম অনুসরণ করে।
[2] যে নিয়মটি অনুসৃত হয়, তা সর্বজনীন নিয়মরূপে গণ্য।
[3] কর্মকর্তার কাজটি নৈতিকরূপে গণ্য হবে যদি তা ওই সার্বিক নিয়মের অন্তর্ভুক্ত হয়। কর্মকর্তার কোনো কাজ নৈতিকরূপে গণ্য হবে যদি এবং কেবল যদি ওই কাজটিকে সার্বিক নিয়মের অন্তর্ভুক্ত করলে কোনো অসংগতি পরিলক্ষিত না হয়। এগুলির মাধ্যমেই কান্ট তাঁর নীতি-দর্শনে এক সার্বিক নৈতিক নিয়মের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন এবং সে কারণেই কান্টের নীতি- কর্তব্যবাদ নীতি-দর্শনে এক সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়রূপে গণ্য।
কান্টের মতবাদের ব্যাখ্যা
কান্ট অনুভব করেছেন যে, আমাদের মধ্যে যে নৈতিকতার বিষয়টি প্রোথিত আছে, যা আমাদের বিবেক থেকে নিঃসৃত হয়-তা নক্ষত্রঘটিত অনন্ত আকাশের সঙ্গে তুলনীয়। এই নৈতিক নিয়মের স্বরূপ নির্ণয় করতে গিয়েই কান্ট একাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। এই সমস্ত গ্রন্থের মধ্যে ‘Groundwork of the Metaphysics of Morals’ গ্রন্থটি হল সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই গ্রন্থেই কান্ট নৈতিক নিয়মের ক্ষেত্রে শুভ সংকল্প (Good Will) এবং কর্তব্যের জন্য কর্তব্য-এর কথা বলেছেন। এই শুভ সংকল্প এবং কর্তব্যের জন্য কর্তব্য ছাড়া নৈতিকতার বিষয়টিকে কখনোই ব্যাখ্যা করা যায় না। এই শুভ সংকল্প ব্যক্তির কোনো সাধারণ শর্তযুক্ত সংকল্প নয়।
ব্যক্তির যে ব্যাবহারিক প্রজ্ঞা (Practical Reason) নিঃসৃত সংকল্প- যা ব্যক্তির ঐচ্ছিক কর্মের সূচনা করে, সেই বিশেষ ইচ্ছাই হল শুভ ইচ্ছা বা শুভ সংকল্প (Good Will)। এই শুভ ইচ্ছাকেই কান্ট নিঃশর্তভাবে ভালো বলেছেন এবং একে স্বাধীনরূপে উল্লেখ করেছেন। আর এই শুভ সংকল্পের স্বাধীনতাকেই সকল নৈতিক নিয়মের এবং তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সকল কর্তব্যের মূলনীতিরূপে উল্লেখ করেছেন। এই শুভ সংকল্পেরই যেন আর-এক নাম হল নিঃশর্ত অনুজ্ঞা (Categorical Imperative)। শর্তাধীন অনুজ্ঞাকে কান্ট বিচক্ষণতা (Prudence) রূপে এবং শর্তহীন অনুজ্ঞাকে নৈতিকতা (Morality)-রূপে উল্লেখ করেছেন-যা কর্তব্যের জন্য কর্তব্যের বিষয়টিকে সূচিত করে। কান্ট তার নিঃশর্ত অনুজ্ঞাকে তিনটি বয়ানের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন-
প্রথম বয়ান: এমন নীতি মেনে কাজ করো যে নীতিটি একইসঙ্গে একটি সর্বজনীন নীতিতে পরিণত হতে পারে।
দ্বিতীয় বয়ান: এমনভাবে কাজ করো যাতে মানবসত্তা কখনোই নিছক উপায় হিসেবে নয়, সর্বদাই উদ্দেশ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
তৃতীয় বয়ান: তুমি তোমার নীতির মাধ্যমে এমনভাবে কাজ করো যাতে তুমি উদ্দেশ্য রাজ্যের একজন বিধিপ্রণয়নকারী সদস্যরূপে গণ্য হও।
আরও পড়ুন – নাস্তিক দর্শন হিসেবে বৌদ্ধ দর্শনের পরিচয় দাও