সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির কারণগুলি আলোচনা করো
সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির কারণগুলি আলোচনা করো। |
সমুদ্রের বিপুল জলরাশি যখন নিয়মিতভাবে, নির্দিষ্ট দিকে, অনুভূমিক আকারে একস্থান থেকে অন্যস্থানে প্রবাহিত হয়, তখন ওই প্রবহমান জলরাশিকে সমুদ্রস্রোত বলে। সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির কারণগুলি হল—
বায়ুপ্রবাহ
ভূপৃষ্ঠের ওপর দিয়ে নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট দিকে প্রবাহিত নিয়ত বায়ুগুলি (আয়ন বায়ু, পশ্চিমা বায়ু ও মেরু বায়ু) সমুদ্রপৃষ্ঠের জলরাশিকে নিজের প্রবাহের দিকে টেনে নিয়ে যায় এবং সমুদ্রস্রোত সৃষ্টি করে। যেমন- (ⅰ) আয়ন বায়ুপ্রবাহ অনুসারে উত্তর গোলার্ধে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হয়। উদাহরণ- প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর নিরক্ষীয় স্রোত। (ii) পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবে পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হয়। উদাহরণ- উপসাগরীয় স্রোত, উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরীয় স্রোেত। (iii) মেরু বায়ুর প্রভাবে পূর্ব থেকে পশ্চিম-দিকে সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হয়। উদাহরণ- ল্যাব্রাডর স্রোত, বেরিং স্রোত প্রভৃতি।
পৃথিবীর আবর্তন গতি
পৃথিবীর আবর্তন গতির ফলে সৃষ্ট কোরিওলিস বল সমুদ্রস্রোতের গতির সঙ্গে সমকোণে ক্রিয়া করে। এর ফলে ফেরেল-এর সূত্রানুসারে সমুদ্রস্রোেত উত্তর গোলার্ধে ডানদিকে ও দক্ষিণ গোলার্ধে বামদিকে বেঁকে যায় এবং নতুন সমুদ্রস্রোতের উৎপত্তি ঘটায়। যেমন- উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে উত্তর নিরক্ষীয় স্রোত ডানদিকে বেঁকে জাপান বা কুরোশিয়া স্রোতের সৃষ্টি হয়।
সমুদ্রজলের উষ্ণতা
নিরক্ষরেখা থেকে মেরুর দিকে সূর্যরশ্মির পতনকোণের তারতম্যের জন্য সমুদ্রজলের উষ্ণতা ক্রমশ কমতে থাকে। ফলে, নিরক্ষীয় অঞ্চলের উষ্ণ ও হালকা জলরাশি বহিঃস্রোতরূপে মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়। জলের এই শূন্যতা পূরণের জন্য তখন মেরু অঞ্চলের শীতল ও ভারী জলরাশি অন্তঃস্রোতরূপে নিরক্ষীয় অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়। যেমন উপসাগরীয় উষ্ণ স্রোত নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে সুমেরুর দিকে প্রবাহিত হয়।
সমুদ্রজলের লবণতা
সমুদ্রের অধিক লবণাক্ত জল ভারী হওয়ায় সমুদ্রের নিম্নাংশ দিয়ে অন্তঃস্রোতরূপে কম লবণাক্ত হালকা জলের দিকে বয়ে যায় এবং কম লবণাক্ত জল হালকা হওয়ায় সমুদ্রের ওপরের অংশ দিয়ে বহিঃস্রোতরূপে অধিক লবণাক্ত জলের দিকে প্রবাহিত হয়। যেমন- আটলান্টিক মহাসাগর থেকে ভূমধ্যসাগরের দিকে জলরাশির বহিঃস্রোতের মূল কারণ লবণতার পার্থক্য।
সমুদ্রজলের ঘনত্ব
উষ্ণতা, লবণতা, চাপ প্রভৃতির তারতম্যের জন্য সমুদ্রজলের ঘনত্বের তারতম্য ঘটে। নিয়মানুসারে, কম ঘনত্বের জলরাশি বহিঃস্রোতরূপে অধিক ঘনত্ব অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়, আবার অধিক ঘনত্বের জলরাশি অন্তঃস্রোতরূপে কম ঘনত্ব অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়। যেমন- পূর্ব গ্রিনল্যান্ড স্রোত অন্তঃস্রোতরূপে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়।
বরফের গলন
Otto Pattersson সমুদ্রস্রোত সৃষ্টি সম্পর্কে বরফের গলনের বিষয়টি প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন এবং এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, বরফের গলনের ফলে সমুদ্রের জলস্তর উত্থিত হয়। ফলে, এই বিপুল জলরাশি স্বল্প জলরাশি সমন্বিত অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি করে।
উপকূলের আকৃতি
সমুদ্রস্রোতের প্রবাহপথে মহাদেশীয় উপকূলভাগ বা দ্বীপ অবস্থান করলে সমুদ্রস্রোত বাধা পেয়ে বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং নতুন সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয়। যেমন – আটলান্টিক মহাসাগরে দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোত ব্রাজিল উপকূলে বাধা পেয়ে ব্রাজিল স্রোত ও ক্যালিফোর্নিয়া স্রোতের সৃষ্টি হয়েছে।
ঋতু পরিবর্তন
ঋতুভেদে বায়ুপ্রবাহের দিক পরিবর্তন হয়, অধঃক্ষেপণের হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে। এর ফলে সমুদ্রস্রোতের দিক ও গতির পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। যেমন- ভারত মহাসাগরে গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে মৌসুমি স্রোত উত্তর-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয় এবং শীতকালে উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হয়।
মাধ্যাকর্ষণ শক্তি
নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে মেরু অঞ্চলের দিকে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে, নিরক্ষীয় অঞ্চলের জলভাগ অপেক্ষা মেরুদ্বয়ের জল অধিক পরিমাণে আকৃষ্ট হয়ে থাকে। এই কারণেও সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয়।
সমুদ্রতলের ভূপ্রকৃতি
সমুদ্রতলের শৈলশিরা, গায়ট, মালভূমি প্রভৃতি সমুদ্রস্রোতের দিকবিক্ষেপ ঘটায়। যেমন – উত্তর নিরক্ষীয় স্রোত মধ্য আটলান্টিক শৈলশিরায় বাধা পেয়ে ডানদিকে বেঁকে যায়।
বাষ্পীভবন
অধিক বাষ্পীভবনের কারণে সমুদ্রজলতলের উচ্চতা হ্রাস ঘটে। এর ফলে জলতলে সমতা বজায় রাখার জন্য সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয়। যেমন- আটলান্টিক মহাসাগর থেকে ভূমধ্যসাগরের দিকে এই কারণে সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হয়।