বিজ্ঞানের ভালো মন্দ রচনা
|
ভূমিকা
আরণ্যক মানুষ নিজ কল্যাণী বুদ্ধিতে সমাজে এসে সংসার বেঁধেছে। সেই কল্যাণপ্রসূ বুদ্ধিতেই সে জগতের অপার রহস্যের জাল ছিন্ন করে তাকে প্রয়োজন অনুসারে নিজের আয়ত্তে এনেছে। মানুষ যত বিজ্ঞানবুদ্ধিতে বলীয়ান হয়েছে, তত সমৃদ্ধ হয়েছে তার জীবনযাত্রা। বিজ্ঞান আমাদের জীবনে এনেছে দুর্বার গতি। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার মানবসভ্যতাকে আজ মহান উচ্চতায় স্থাপন করেছে। যেমন আলোর বিপরীতে থাকে অন্ধকার তেমনি বিজ্ঞানই আবার স্বার্থান্বেষী মানুষদের কৌশলে মানবসভ্যতার পরিপন্থী হয়ে উঠেছে।
বিজ্ঞানের জন্ম
মানুষ যেদিন প্রথম আগুন জ্বালাতে শিখল সেদিনই সভ্যতার প্রদীপ জ্বলল। মানুষের অসীম কৌতূহল, অনন্ত জিজ্ঞাসা পরিতৃপ্ত করতে উদ্ভূত হয়েছে নতুন নতুন তথ্য এবং তত্ত্ব, যার পারিভাষিক নাম বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম প্রায় দেড়শো থেকে দুশো বছর আগে। জেম্স ওয়াট যেদিন বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন সেদিন থেকেই বিজ্ঞানের জয়যাত্রা শুরু। আর সেই বিজ্ঞানের হাত ধরেই আজ মানুষ গুহার পরিবর্তে অট্টালিকায় বাস করে, পরনে তার ছেঁড়া বল্কলের পরিবর্তে কাপড়ের পোশাক।
বিজ্ঞানের দ্বৈতসত্তা
যেদিন থেকে মানুষ বিজ্ঞানবুদ্ধিতে বলীয়ান হয়ে শুরু করল বিজ্ঞানচর্চা সেদিন থেকে একদল মানুষ সংকীর্ণ স্বার্থের দ্বারা পরিচালিত হয়ে বিজ্ঞানের শক্তির অপব্যবহারও শুরু করল। একদিকে যেমন মানুষের শুভ ও কল্যাণী বুদ্ধি বিজ্ঞানকে নিয়োজিত করল মানুষের কল্যাণে, সেবায়, অন্যদিকে মানুষেরই লোভ ও নীচতা বিজ্ঞানকে পরিচালিত করল অশুভ, ধ্বংসাত্মক পথে-সৃষ্টি হল বিজ্ঞানের দ্বৈতসত্তা।
আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের অবদান
সভ্যতার যত অগ্রগতি ঘটছে মানুষ বিজ্ঞানকে ততই তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আপন করে নিচ্ছে। বলতে দ্বিধা নেই, এই একবিংশ শতাব্দীতে মানুষ হয়ে পড়েছে বিজ্ঞানের দাস। জীবনযাপনে বিজ্ঞান এনেছে নিশ্চয়তা; বিজ্ঞানের সঞ্জীবনী মন্ত্রেই কমেছে মৃত্যুর হার, বেড়েছে গড় আয়ু। বিজ্ঞানের সাহায্য ও সাহচর্য ছাড়া মানুষ আজ জীবনধারণে অপারগ। আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের অপরিহার্যতা ব্যাপক। কোভিড মহামারি যার সুফল ভোগ করেছে।
বিজ্ঞানের অকল্যাণী মূর্তি
বিজ্ঞানের এই অগ্রগতি যেমন জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে তেমনই বিজ্ঞানের সহায়ক রূপ আজ সভ্যতাকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। প্রকৃতির অসীম শক্তির উৎস পরমাণু শক্তি বিজ্ঞানের বিস্ময়কর সৃষ্টি। সভ্যতার রথের চাকা পরমাণু শক্তির চালনায় গতিশীল হয়। কিন্তু মানুষের স্বার্থলিপ্সা এই পারমাণবিক শক্তিকে নিয়ে মেতে উঠেছে নিষ্ঠুর ধ্বংসলীলায়। তাই আমরা প্রত্যক্ষ করেছি দুটি বিশ্বযুদ্ধকে। এসবই মানবিক লজ্জা, যার জন্য দায়ী মানুষের সীমাহীন লোভ। খাদ্যে ও ওষুধে ভেজাল, মারণাস্ত্রের আবিষ্কার, নিত্যনতুন অশুভ শক্তির উদ্ভাবনে মানুষ এখন এত সিদ্ধহস্ত যে, একটি ছোটো বোতাম টিপলেই মুহূর্তে পৃথিবীর বৃহত্তর অংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে, ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কোটি কোটি মানুষের প্রাণ, অবলুপ্তি ঘটতে পারে মানুষের দীর্ঘদিনের শ্রম ও সাধনালব্ধ সভ্যতার। বিজ্ঞানের সাহায্যে মানুষের হাতে গড়ে উঠেছে পারমাণবিক বোমা, হাইড্রোজেন বোমা এবং আরও নানাবিধ বিধ্বংসী পরিকল্পনা চলছে পৃথিবীব্যাপী।
দায়ী কে?
বিজ্ঞান যন্ত্র, মানুষ যন্ত্রী; বিজ্ঞানের বিধ্বংসী মূর্তির জন্য দায়ী মানুষ, বিজ্ঞান নয়। বিজ্ঞানকে আর্শীবাদ না অভিশাপ-কোন্ রূপে মূর্ত করে তোলা হবে তার ভার মানুষেরই হাতে ন্যস্ত। যেদিন সকল মানুষের অন্তরে শুভবুদ্ধি জাগরিত হবে, সেদিনই বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ এই প্রশ্নের মীমাংসা আপনিই হয়ে যাবে।
উপসংহার
বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের প্রসিদ্ধ উক্তি হল-‘Religion without Science is lame, Science without religion is dead।’ বিজ্ঞানের পরিচালক মানুষকেই আগে শুভবুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হতে হবে। তবেই বিজ্ঞান হবে মানুষের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ। পৃথিবীর বুকে রচিত হবে মনুষ্যসৃষ্ট সাধের সভ্যতা আর সেই সভ্যতার চিরজাগ্রত প্রহরীরূপে বিরাজমান থাকবে বিজ্ঞান।