গঙ্গা দূষণ ও তার প্রতিকার রচনা

গঙ্গা দূষণ ও তার প্রতিকার রচনা
গঙ্গা দূষণ ও তার প্রতিকার রচনা

ভূমিকা

মানবসভ্যতা সততই নদীমাতৃক। সুপ্রাচীন কাল থেকেই নদনদীকে কেন্দ্র করে মানবসভ্যতার উন্মেষ ও বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। কৃষি, শিল্প, ব্যাবসাবাণিজ্য, পরিবহণ সবক্ষেত্রেই নদীর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। আর সেই সূত্রেই ভারতের দীর্ঘতম নদী গঙ্গা ভারতীয় সভ্যতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে নিয়েছিল। এই নদীকে কেন্দ্র করেই ক্রমান্বয়ে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য জনপদ। গঙ্গা হয়ে উঠেছিল প্রাণদায়িনী, শস্যদায়িনী, কল্যাণময়ী। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল তার পবিত্র গৌরবগাথা। আর সেই সূত্রেই কবিকণ্ঠে একদা ধ্বনিত হয়েছিল-

“পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গে
শ্যামবিটপিঘন-তট-বিপ্লবিনী
ধূসর-তরঙ্গ-ভঙ্গে!”

কিন্তু আধুনিক সভ্যতার অমঙ্গলকারী প্রভাবে আজকের গঙ্গা কলুষিত, তার পবিত্র জলধারা আজ দূষিত, প্রাণঘাতী। মানুষের সীমাহীন লোভ ও অপরিণামদর্শিতাই এই সর্বনাশের মূল কারণ।

গঙ্গাদূষণের কারণ

যে-কোনো দূষণের মূলেই রয়েছে আধুনিক সভ্যতার বিপথগামিতা, যার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-

“হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন, পুণ্যচ্ছায়া রাশি, 
গ্লানিহীন দিনগুলি।”

একদিকে জনসংখ্যাবৃদ্ধি, অন্যদিকে সভ্যতার কুপ্রভাব গঙ্গার – পবিত্রতাকে ক্রমাগত কলুষ-কালিমালিপ্ত করে চলেছে। গঙ্গার দু-পাশে – গড়ে ওঠা ক্রমবর্ধমান নগর-বন্দর-জনপদ প্রতিনিয়ত দূষণের বিষ ছড়াচ্ছে। গঙ্গার জলদূষণের প্রধান কারণগুলি হল-(১) কলকারখানা ও পয়ঃপ্রণালী থেকে নির্গত দূষিত জল ও বর্জ্য পদার্থ, (২) পলি দ্বারা নদীর নাব্যতা হ্রাস, (৩) নদীর জলে গবাদিপশু স্নান করানো, (৪) নদীর উভয় তীরে শব দাহ করা, (৫) মানুষ ও পশুপাখির মৃতদেহ জলে ভাসানো, – (৬) কৃষিজমি থেকে আগত কীটনাশক ও রাসায়নিক সারমিশ্রিত জল গঙ্গার জলে মিশে যাওয়া, (৭) নদীর বুকে অতিরিক্ত যানবাহনের চলাচল, (৮) তেলবাহী জাহাজ থেকে তেলের নিঃসরণ এবং (৯) নদীবক্ষে নিক্ষিপ্ত ব্যবহৃত প্লাস্টিক প্যাকেট প্রভৃতি।

গঙ্গাদূষণের ফল

প্রায় ২৫২৫ কিমি দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট ভারতের দীর্ঘতম নদী গঙ্গা অগণিত প্রাণের ধারক ও বাহক। তাই গঙ্গার জল দূষিত হওয়ার অর্থ হল সমূহ বিপন্নতা। নদীর নাব্যতা কমে গেলে প্রকট হবে বন্যার বিধ্বংসী চেহারা। পরিবহণ ব্যবস্থা হবে বিপর্যস্ত। দূষিত জল হয়ে উঠবে নানা রোগের কারণ। বাস্তুতন্ত্রের সামঞ্জস্য রক্ষিত হবে না। বিঘ্নিত হবে জলসেচ ব্যবস্থা। মৃত্যু ঘটবে বহু জলজ প্রাণীর। জলদূষণের ফলে মাটিও দূষিত হবে-রোগ ছড়াবে ব্যাপকভাবে।

গঙ্গা বাঁচাও অভিযান

“গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা

তার দুই চোখে দুই জলের ধারা
মেঘনা যমুনা।”

চিরকল্যাণময়ী মাতৃসমা গঙ্গা আজ অশ্রুপ্লাবিতা। যন্ত্রসভ্যতাপ্রসূত অশুভ শক্তি গঙ্গাকে আজ রাক্ষসী করে তুলতে বদ্ধপরিকর। আমাদের উচিত সে বিষয়ে সচেতন হয়ে নদীর কল্যাণীমূর্তি ফিরিয়ে দেওয়া। আর সেই কর্তব্যপালনের প্রধান অঙ্গ হল ‘গঙ্গা বাঁচাও অভিযান’। এর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে তার নাম ‘গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান’। এই পরিকল্পনা রূপায়িত করতে যেসব কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে সেগুলি হল-

  • গঙ্গার জলের বিশুদ্ধতার মান বজায় রাখতে দূষণের পরিমাণ নির্ণয়ের জন্য প্রতিনিয়ত পরীক্ষানিরীক্ষা প্রয়োজন।
  • কলকারখানার দূষিত জল ও বর্জ্য পদার্থ যাতে সরাসরি গঙ্গার জলে মিশতে না পারে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া।
  • বৈজ্ঞানিক উপায়ে দূষণ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা।
  • জনপদের অবাঞ্ছিত নোংরা-আবর্জনা যাতে গঙ্গার জলে না মেশে সেদিকে লক্ষ রাখা।
  • নদীর নাব্যতা বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হওয়া।
  • পয়ঃপ্রণালী নিয়ন্ত্রণ ও সুলভ শৌচাগার নির্মাণ।
  • স্নানের জন্য উপযুক্ত ঘাটনির্মাণ ও বৈদ্যুতিক চুল্লি গড়ে তোলা।
  • নদীর জলে প্রতিমা নিরঞ্জনের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলিকে জল থেকে তুলে নেওয়া।
  • নদীর ভাঙন রোধ করার ব্যবস্থা করা।
  • বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ পদ্ধতির উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা।

উপসংহার

ভগীরথের হাত ধরে যে গঙ্গা সগর-সন্তানদের প্রাণদানকল্পে স্বর্গ থেকে অবতরণ করেছিলেন, তাকে আবার হয়ে উঠতে হবে অমৃতময়ী, দিতে হবে কোটি কোটি মানুষের প্রাণদানের প্রতিশ্রুতি। গঙ্গা ভারতের অন্তরাত্মা, তা ‘যেন ভারতের যজ্ঞোপবীত-ভারতের জ্ঞান-ধর্ম-তপস্যার স্মৃতিযোগসূত্র।’ গঙ্গার সেই প্রাচীন ঐতিহ্যকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। মনে রাখতে হবে পৃথিবীতে গঙ্গাই একমাত্র নদী, যার অববাহিকায় প্রায় চল্লিশ কোটি মানুষ বাস করে, যার তীরে গড়ে উঠেছে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ শহর। সুতরাং তাকে দূষণমুক্ত রাখা আমাদের প্রধান কর্তব্য। আর এর জন্য কেবল সরকারি পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়-প্রয়োজন মানুষের সচেতনতা-দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। কেবল আইন প্রণয়ন করলেই হবে না, তার যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে হবে; তবেই প্রাণদায়িনী গঙ্গা ফিরে পাবে তার পবিত্রতা ও শুচিতা।

Leave a Comment