মশাবাহিত রোগ- ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া: সমস্যা ও তার প্রতিকার রচনা

মশাবাহিত রোগ- ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া: সমস্যা ও তার প্রতিকার রচনা
মশাবাহিত রোগ- ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া: সমস্যা ও তার প্রতিকার রচনা

ভূমিকা

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানবসভ্যতার সংজ্ঞা বদলে দিয়েছে। সবুজায়ন রূপান্তরিত হয়েছে নগরায়নে। বহুতল দখল করেছে আদিগন্ত প্রান্তর। চিকিৎসাবিজ্ঞানের চরম উন্নতি বাড়িয়ে দিয়েছে মানুষের গড় আয়ুকেও। তবু এই উন্নয়নের অন্তরালে আজও দানা বাঁধছে মৃত্যুর হাতছানি। উপযুক্ত সচেতনতার অভাব, অবহেলা আজও মহামারিতে পরিণত করছে মশাবাহিত রোগসমূহকে। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু এই করোনা মহামারিকালেও আতঙ্কিত করছে মানুষের জনজীবনকে। হাওড়া, হুগলি, উত্তর চব্বিশ পরগনা, কলকাতার বিক্ষিপ্ত অঞ্চল চলতি বছরেও বিশেষভাবে প্রভাবিত।

রোগের উৎস

ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া- এগুলি মশাবাহিত রোগ। মশাদের আঁতুড় ঘর হল জমে থাকা জল। শহরে-গ্রামে-গঞ্জে ড্রেনে, বদ্ধ জলাশয়ে পুরনো ট্যাঙ্ক বা টবে, গ্রামের জলাজমিতে ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় জমে থাকা জলে বা বর্ষায় জল জমে মশার দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটে। এমনকি পরিষ্কার জল থেকেও মশাবাহিত রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে। মশাবাহিত অসুখগুলি কেবল বর্ষাকালেই সংক্রমণ ছড়ায় তা নয়, বছরের যে-কোনো সময়ই এই সংক্রমণ ছড়াতে পারে। 

ডেঙ্গু

‘ডেঙ্গু’ শব্দটির উৎপত্তি ঘটেছে আফ্রিকা মহাদেশের বাল্টু ভাষা ‘সোয়াহিলি’-র বাক্যবন্ধ ‘কা-ডিঙ্গা পেপো’ থেকে; যার অর্থ, কোনো অশুভ প্রেতের কবলে পড়ে খিঁচুনির মতো প্রকোপ। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম স্বীকৃত ডেঙ্গুর মহামারি দেখা দেয় এশিয়া, আফ্রিকা ও নর্থ আমেরিকায়।

ডেঙ্গু রোগের কারণ ডেঙ্গু ভাইরাস। এখনও পর্যন্ত পাঁচ ধরনের ডেঙ্গু ভাইরাসের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে, যার সবগুলিই মশার কামড়ের মাধ্যমে আমাদের রক্তে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটাতে পারে। Aedes শ্রেণির কয়েকটি প্রজাতির মশা, প্রধানত এডিস ইজিপ্টাই Aedes aegypti, (একে yellow fever mosquito-ও বলা হয়) ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়ায়। মানবশরীরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটার পর তিন থেকে চোদ্দো দিনের মধ্যে এই রোগের লক্ষণগুলি দেখা দেয়। বেশি জ্বর, মাথাযন্ত্রণা, বমি, মাংসপেশি ও গাঁটে গাঁটে ব্যথা এবং চামড়ায় এক ধরনের লাল লাল ফুসকুড়ি ইত্যাদি ডেঙ্গি রোগের লক্ষণ। রোগনির্ণয় ও তার প্রতিকারের উপায় সুনিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ সাধারণত ৩ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত থাকে। জ্বর হঠাৎ করে কমে গিয়ে আবার বেড়ে যায়। তাপমাত্রা ১০২-১০৩ ডিগ্রি হয়ে যায়। ক্ষেত্রবিশেষে অবশ্য এক বিশেষ ধরনের ডেঙ্গু (Dengue Hemorrhagic Fever) প্রাণঘাতী রূপ ধারণ করে।

ম্যালেরিয়া

ম্যাল বা স্যাঁৎসেঁতে স্থানে ম্যালেরিয়া জ্বরের উৎপত্তি বলে এই রোগের নাম ম্যালেরিয়া। ডাক্তার আভেরণ ১৮৮০ সালে আবিষ্কার করেন যে প্রোটোজোয়াজাতীয় জীবাণু এই রোগের উৎস। ১৮৯৭ সালে ডাক্তার রোনাল্ড রস প্রমাণ করেন এনোফিলিসজাতীয় স্ত্রী মশার দংশনে ম্যালেরিয়ার জীবাণু মানবশরীরে প্রবেশ করে এবং লোহিত রক্তকণিকার মধ্যে বর্ধিত হতে হতে বিষক্রিয়া ঘটায়। মানবদেহে এক থেকে তিন সপ্তাহ এই জীবাণু অবসথান করে এবং ক্রমে রোগ লক্ষণ প্রকাশ পায়, প্রত্যহ বা দুই তিন দিন অন্তর জ্বর আসে। ম্যালেরিয়ার জীবাণু টার্সিয়ান ৪৮ ঘণ্টায় ও কোয়ার্টন ৭২ ঘণ্টায় পূর্ণতা পায় এবং জীবাণু রেখে ধ্বংস হয়ে যায়। এই রোগের তিনটি উপসর্গ, যথা- শীত ও কম্পন, উত্তাপ, ঘর্ম। পারনিসাস বা ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় সাব-টার্সিয়ান জীবাণু পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে হঠাৎ জ্বর উগ্রমূর্তি ধারণ করে এবং অনেক সময় রোগীর মৃত্যুও ঘটে।

নিরাময় ও প্রতিবিধান

ডেঙ্গুর বিশেষ কোনো চিকিৎসা এখনও আমাদের কাছে লভ্য নয়। নির্দিষ্টভাবে কোনো প্রতিরোধক টিকা বা ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। কুইনাইন বা আর্টিমেসিনিন গ্রুপের ম্যালেরিয়া প্রতিষেধক ওষুধ দিয়ে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা করা হয়। ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে আদর্শ প্রতিবিধান হল মশার কামড় থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা, অবশ্যই মশারি ব্যবহার করা। মশার বংশবৃদ্ধি রোধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য দফতর ও কেন্দ্রগুলির জোরদার পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। শহর-গঞ্জের নালা-নর্দমা, খানা-খন্দে জমে থাকা নোংরা জল প্রায় প্রত্যহ পরিষ্কার করা একান্ত কর্তব্য। পরিষ্কার জমা জলে ডেঙ্গুর মশা বংশবৃদ্ধি করে বলে এয়ারকন্ডিশনার, রেফ্রিজারেটরের জমা জল প্রতিদিন খালি করা উচিত।

এ ব্যাপারে জনগণের ভূমিকা ও পালনীয় ক্রিয়াকর্মের ব্যাপারে তাদের সচেতন করার জন্য লাগাতার প্রচার অভিযানও চালানো দরকার। ডেঙ্গুর প্রকোপ চলাকালীন জ্বর হলে রক্ত পরীক্ষা করানোর ব্যাপারে অবহেলা করা সমীচীন নয়। শুরুতেই রোগ নির্ধারণ করা গেলে প্রাণঘাতী ডিএইচএফ ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও কার্যকরী চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সম্ভব।

উপসংহার

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী ৫০-১০০ মিলিয়ন ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটে প্রতি বছর। এর মধ্যে প্রায় ৫০,০০০টি ক্ষেত্রে ডেঙ্গু প্রাণঘাতী অর্থাৎ DHF শ্রেণির এবং ডেঙ্গুজনিত মৃত্যুর হার প্রায় ২২,০০০, যার মধ্যে শিশুমৃত্যুর সংখ্যাই বেশি। পাশাপাশি আমাদের দেশে প্রতি বছর ১.৫ কোটি মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। এমনকি কোরোনা পরিস্থিতিতেও পরিসংখ্যান আশঙ্কাজনক। বিগত বছরের তুলনায় প্রকোপ কমলেও একমাত্র সচেতনতাই পারে এই রোগগুলিকে প্রতিহত করতে, তাই ডেঙ্গু আর ম্যালেরিয়াকে প্রতিরোধ করতে জনসচেতনতাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

Leave a Comment