বাংলার পটচিত্র রচনা

বাংলার পটচিত্র রচনা
বাংলার পটচিত্র রচনা

ভূমিকা

গ্রামবাংলার এক ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন লোকশিল্পমাধ্যম হল পটচিত্র। সংস্কৃত ভাষায় ‘পট্ট’ মানে বিশেষ ধরনের বা রেশমি কাপড় ও ‘চিত্র’ মানে ছবি। পটচিত্রের উদ্ভব নিয়ে নানা মুনির নানা মত। অনেক বিশেষজ্ঞ আদিম জনগোষ্ঠীর সঙ্গে পটুয়া বা পটচিত্রকরদের যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের আর-এক গোষ্ঠী মৌর্যযুগে ও দ্বিতীয় শতকের সংস্কৃত সাহিত্যে পটুয়াদের উপস্থিতির তথ্য নির্দেশ করেন। ‘হর্ষচরিত’ গ্রন্থে পটুয়াদের উল্লেখ আছে। তবে সার্বিক বিচারে বলা যায় যে, পটচিত্রের উদ্ভব ওড়িশায় দ্বাদশ শতাব্দীতে। পুরির জগন্নাথ মন্দির স্থাপনের সঙ্গে এর যোগাযোগ ছিল বলে অনেক শিল্পী-ঐতিহাসিক মনে করেন। বাংলায় মোটামুটি ত্রয়োদশ শতাব্দী বা তারও আগে পটচিত্রের ব্যবহারের ঐতিহাসিক উল্লেখ পাওয়া যায়। ষোড়শ শতকে চৈতন্যের বাণীপ্রচারে পট ব্যবহৃত হত। কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তীর কাব্যেও পটের উল্লেখ রয়েছে।

বৈশিষ্ট্য

পটচিত্র হল দর্শকদের সামনে প্রদর্শনমূলক এক শিল্পমাধ্যম, যার মধ্যে একত্রিত হয়েছে ভাববিনিময়ের একাধিক মাধ্যম যেমন, চিত্রকলা ও কথকতা এবং সংগীত। বাংলার পটুয়ারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে গ্রামের মানুষদের সামনে তাদের আঁকা, গোটানো পটচিত্র একটু একটু করে মেলে ধরত আর পটের ছবির সঙ্গে সম্পর্কিত পৌরাণিক বা নীতিকথাটি বর্ণনা করত কথকতা ও গানের মাধ্যমে। বিনিময়ে তারা অর্থ বা দানসামগ্রী উপার্জন করত। সেইসব যুগে গ্রামের মানুষদের কাছে পটুয়াদের দ্বারা পটচিত্র প্রদর্শন ছিল মনোরঞ্জনের অন্যতম প্রধান উৎস। সহজ-সরল পটচিত্রশিল্পের আবেদন সাড়া জাগাত আবালবৃদ্ধবনিতার মনে।

পটচিত্র আঁকার রীতি

পট আঁকা হয় প্রধানত দ্বিমাত্রিক পদ্ধতিতে, আলো-ছায়ার ব্যবহারে বস্তুর ঘনত্বের আভাস পটচিত্রে থাকে না। বলা হয় আদিকালে পটচিত্র আঁকা হত তালপাতার উপর। পরবর্তী যুগে চটের উপর বিভিন্ন জিনিসের প্রলেপ দিয়ে তার উপর ছবি আঁকা হত। আরও পরে একধরনের তুলোট হ্যান্ডমেড পেপারের ব্যবহার শুরু হয়। সাম্প্রতিক কালে কাপড়ের উপর সাধারণ কাগজ সাঁটিয়ে তাকে পট হিসেবে ব্যবহার করেন পটুয়ারা। পটচিত্রের মূল আকর্ষণ এর রঙের বৈচিত্র্য। আর সেইসব রং তৈরি হয় নানান দেশে ঘরোয়া উপাদান থেকে। যেমন হলুদ রং খাবার হলুদ বা গেরিমাটি থেকে, সবুজ রং কচুরিপানা গাছের বা বেল গাছের পাতা থেকে, বেগুনি রং কালোজাম বা কালো তাল থেকে, সাদা রং শামুকের খোলের গুঁড়ো বা খড়িমাটি থেকে। কালো খয়েরের সঙ্গে চুনাপাথর মিশিয়ে বাদামি রং তৈরি করা হয়। লাল রঙের উৎস সিঁদুর, আলতা বা রাঙামাটি। নীল রং তৈরি হয় সাদা কাপড়জামা ব্যবহার করার নীল বড়ি থেকে, ভুষোকালি থেকে হয় কালো রং এবং কালো আর সাদা মিশিয়ে পাওয়া যায় ধূসর রং। তেঁতুল বা বেল বীজের গুঁড়ো জলে ফুটিয়ে আঠা তৈরি করে সেই আঠায় রং মিশিয়ে ঘরোয়া পদ্ধতিতে বানানো তুলি দিয়ে ছবি আঁকা হয়। অবশ্য আধুনিক যুগে বাজারলভ্য ক্যানভাস, রংতুলি-এসবও পটুয়ারা ব্যবহার করতে শুরু করেছেন পট আঁকার জন্য।

পটের প্রকারভেদ

পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম ও পশ্চিম মেদিনীপুরে প্রচলিত পটচিত্রের প্রধান তিনটি প্রকার নিম্নরূপ- 
(ক) জোড়ানো বা গোটানো পট-দশ বা পনেরোটি দৃশ্য উল্লম্বভাবে জুড়ে এইধরনের পট তৈরি করা হয়।

(খ) আড়েলাটাই পট-এই ধরনের পটে সাধারণত ছয় থেকে আটটি দৃশ্যের আড়াআড়ি সংযোজনের মাধ্যমে একটি কাহিনি, নীতিকথা বা লোককথা বিধৃত করা হয়।

(গ) চৌকো পট-ছোটো মাপের বর্গাকার বা আয়তাকার পটচিত্র। 

পটচিত্রের বিষয়

রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত, মঙ্গলকাব্য, লৌকিক নানা কাহিনি ও পুরাণকথা-এইসব কিছুর লোকপ্রিয় অংশগুলিকে বিষয় করে পটচিত্র আঁকার রেওয়াজ প্রধানত চোখে পড়ে। এ ছাড়াও শ্রীচৈতন্য, সত্যপির, গাজিপির প্রমুখ ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের জীবনীনির্ভর বা বনবিবির মতো নির্দিষ্ট আঞ্চলিক দেবীর উপরও পটচিত্রের প্রচলন দেখা যায়। প্রাচীন বাংলায় এক বিশেষ ধরনের পট আঁকা হত, যার নাম ছিল যমপট। মৃত্যুর পর যমপুরীতে গিয়ে পাপীতাপীদের কী ভয়ংকর যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়, তারই চিত্র এগুলিতে দেখানো হত। এখনও এ ধারা একেবারে লুপ্ত হয়নি। বাংলার পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত যাদুপটে পশুপাখি, লৌকিক দেবদেবীর সঙ্গে আদিম বিশ্বাসের ছবি ফুটে উঠত। এককালে আদিবাসী পরিবারে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হলে এরা মৃত ব্যক্তির ছবি এঁকে তার পরিবারের লোকজনের কাছে যেত। ছবিতে • মৃত ব্যক্তির চোখের মণি থাকত না। মৃতের আত্মীয়স্বজনকে পটুয়ারা • বলত চোখের মণি না-থাকায় মৃত ব্যক্তির আত্মা লক্ষ্যহীনভাবে শূন্যে ঘুরছে। উপযুক্ত অর্থ বা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তারা চোখের মণি এঁকে দিত। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পটুয়ারা তাদের পটচিত্রের বিষয়ের পরিধি বাড়াতেই থাকে। আধুনিক বিষয়ের মধ্যে নানান আঞ্চলিক ঘটনা; নাগরিক, সামাজিক ও বৈষয়িক ব্যাপার এবং এমনকি বড়োসড়ো প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন, সুনামি প্রভৃতিও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

কালীঘাটের পট

বাংলার পটচিত্রের আর-এক বিশেষ ধারা হল কালীঘাটের পট। এই পটুয়ারা কালীঘাট মন্দিরের কাছাকাছি থাকত বলে এই পটের এমন নাম। গতানুগতিক পৌরাণিক চিত্রের পাশাপাশি উনিশ শতকের সমাজজীবন এই পটচিত্রের বিষয়। এই পটে পাশ্চাত্য চিত্রধারার প্রভাবও ছিল। বাংলার শিল্প-সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এই কালীঘাটের পট।

উপসংহার

আমাদের জীবনের আধুনিক গতিপ্রকৃতি নিরন্তর বদলে যাচ্ছে। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তিত ও বিবর্তিত হচ্ছে আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির ধারাটিও। পটচিত্রশিল্পও এর ব্যতিক্রম নয়।

Leave a Comment