বাংলার লোকসংস্কৃতি প্রবন্ধ রচনা

বাংলার লোকসংস্কৃতি প্রবন্ধ রচনা
বাংলার লোকসংস্কৃতি প্রবন্ধ রচনা

ভূমিকা

পল্লির মানুষদের আচার-আচরণ, শিক্ষাদীক্ষা, শিল্প- সাহিত্য প্রভৃতির একটি দেশজ স্বকীয়তা থাকে। আর তা যখন উৎকৃষ্ট অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে এক সামগ্রিক রূপ পরিগ্রহ করে, তখন তা লোকসংস্কৃতির পর্যায়ভুক্ত হয়। কোনো জাতির মর্মকথা সেই জাতির লোকসংস্কৃতির মধ্যেই নিহিত থাকে।

লোকসংস্কৃতির স্বরূপ

‘লোকসংস্কৃতি পাঠের ভূমিকা’ বইয়ে তুষার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন “লোকায়ত সংহত সমাজের মূলত সমষ্টিগত জীবনচর্যার ও মানসচর্চার স্বতঃস্ফূর্ত, নামাঙ্কহীন সামগ্রিক কৃতিই লোককৃতি বা লোকসংস্কৃতি।” সমাজবদ্ধ সমস্ত মানুষের জীবনযাপন ও মিলিত বোধবুদ্ধি ও চেতনাসঞ্জাত সুখ-দুঃখ, হাসিকান্না, আনন্দ-উচ্ছ্বাসের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ, যা নানাভাবে, নানারূপে আবহমানকাল ধরে আপামর জনসাধারণের মধ্যে বংশপরম্পরায় প্রচলিত থাকে, তাই লোকসংস্কৃতি। লোকসংস্কৃতিতে বিধৃত থাকে লোকসমাজের অগ্রগতির ইতিহাস এবং সভ্যতার অপেক্ষাকৃত অনাড়ম্বর দিকটি। ড. সুকুমার সেন লোকসংস্কৃতিকে ‘লোকচর্যা’ বলে অভিহিত করেছেন। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য একে বলেছেন ‘লোকশ্রুতি’।

বাংলার লোকসংস্কৃতির বৈচিত্র্য

বাংলার লোকসংস্কৃতি বহুমুখী ও বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। বাংলার লোকসংস্কৃতির আঙ্গিক তিনটি ধারায় বিকশিত হয়েছে-আদিম সংস্কৃতি, লোকসংস্কৃতি এবং উচ্চ বা দরবারি সংস্কৃতি। বহু সম্প্রদায়ের বসবাস এই বাংলায়। প্রত্যেক সম্প্রদায়েরই আছে নিজস্ব কিছু কিছু আচার ও অনুষ্ঠান, ধর্মীয় বিশ্বাস, রীতিনীতি। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য পল্লীগীতির বৈচিত্র্যের কথা, যা স্থানভেদে বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন-ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, আলকাফ, ঝুমুর, ভাদু, টুসু, তরজা, পাঁচালি ইত্যাদি। বাংলার লোকসংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে মুখে মুখে প্রচলিত রকমারি ছড়া, প্রবাদ, ধাঁধা, লোককথা, রূপকথা, যেগুলির কিছু কিছু পরবর্তীকালে লিখিতরূপে বাংলা সাহিত্যের অমর সম্পদ হয়ে উঠেছে। লোকসংস্কৃতির ধারায় ব্রতকথাকে গৃহিণী সমাজের দর্পণ বলা যায়। সাবিত্রী ব্রত, সেঁজুতি ব্রত, তুষতুষালি ব্রত, পুণ্যিপুকুর ব্রতপালনের মাধ্যমে বঙ্গীয় রমণীরা গার্হস্থ্য শান্তি ও প্রিয়জনদের কল্যাণসাধনের বিশ্বাসকে বাংলার সংস্কৃতির অঙ্গ করে তোলেন। ময়নামতীর গান, মুরশিদি গান, সারিগান, জারিগান ইত্যাদিতে যেন মিশে থাকে বাংলার মাটির গন্ধ। পুরুলিয়ার ছৌ, মালদার গম্ভীরা ডোেমনি, মুরশিদাবাদের আলকাপ প্রভৃতি নৃত্যরীতি বাংলার লোকসংস্কৃতিতে যোগ করে অতুল সমদ্ধি ও বৈচিত্র্য।

লোকসংস্কৃতি-সময় ও সমাজের দর্পণ

কোনো প্রদেশের ইতিহাস, বিভিন্ন সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা, মানুষের সহজাত প্রজ্ঞা প্রভৃতির প্রতিফলন ঘটে সেই প্রদেশের লোকসংস্কৃতিতে। এই ব্যাপারটির নির্দশন বাংলার লোকসংস্কৃতিতে ভুরি ভুরি। ‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এল দেশে। বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে,’-এই ছড়াটিতে তৎকালীন বাংলার সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র যেমন ধরা পড়েছে, তেমনই ‘আমে ধান, তেঁতুলে বান’-প্রবাদটির মধ্যে নিহিত আছে অভিজ্ঞ মাথার এই ভবিষ্যদ্বাণী যে, যে বছর আমের ফলন বেশি হয়, সে বছর ধান ফলে ভালো আর যে বছর তেঁতুল ফলে বেশি, সে বছর বন্যা হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।

উপসংহার

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে বাংলার গ্রামীণ জীবনযাত্রার ধরনধারণ। শহুরে অত্যাধুনিকতার জোয়ার গ্রামের মানুষদের জীবনযাপনকেও প্রভাবিত করে। আর তার ফলে বদলায় লোকসংস্কৃতিও। এই পরিবর্তন স্বাভাবিক এবং তাকে অনভিপ্রেত মনে করা বা প্রতিহত করার চেষ্টা অর্থহীন। শুধুমাত্র পরিবর্তিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকসংস্কৃতির ধারাটি যাতে নিজের মতো করে বিকশিতও হতে পারে, সে বিষয়ে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। আশার কথা, বাংলার লোকসংস্কৃতির রক্ষণাবেক্ষণ ও বিস্তারের ব্যাপারে এ রাজ্যে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ ও জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা, কিছুরই অভাব নেই।

Leave a Comment