মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান রচনা |
ভূমিকা
‘বিনে স্বদেশী ভাষা, মিটে কি আশা’-ভাষা হল ভাবের বাহক। আর মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধসম। সে ভাষায় মনের ভাবের এমন স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ, যে তৃপ্তি অন্য ভাষাতে নেই। আমাদের শিক্ষার্জনেরও সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম এই মাতৃভাষা। মানুষ যুগে যুগে মাতৃভাষাতেই তার জ্ঞানের চর্চা করে আসছে। প্রাচীন ভারতের প্রাজ্ঞব্যক্তিগণের জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাও এই মাতৃভাষাতেই। কেবল প্রাচীন ভারতবর্ষই নয়, গ্রিস, চিন, মিশরের প্রাচীন ইতিহাসও মাতৃভাষাতেই তাদের নাম স্বর্ণোজ্জ্বল করে রেখেছে ইতিহাসের পাতায়।
শিক্ষার মাধ্যমরূপে ইংরেজি ভাষার প্রবর্তন
পলাশীর প্রান্তরে বণিকের মানদণ্ড যবে দেখা দিল রাজদণ্ডরূপে-ইংরেজের রাজ্যলিপ্সার দাসত্ববন্ধনে ভারতীয় ভাষা-শিক্ষা-সংস্কৃতিও প্রভাবিত হল। প্রশাসনিক কাজে সুবিধার্থে এদেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তনে ডিগ্রি-ডিপ্লোমা কিংবা রাজকর্মে পদাধিকার প্রার্থনায় মুষ্টিমেয় ভারতবাসী সেদিন রাজপ্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্যকে সম্বল ও সার্থক করে তুলেছিল।
ইংরেজি ভাষার আধিপত্যবিস্তার
উনিশ শতকীয় নবজাগরণ ইংরেজি ভাষাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তিকে এদেশে সুদৃঢ় করে। ইংরেজি ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। শিক্ষার মাধ্যমরূপে প্রবর্তিত হয় ইংরেজি ভাষা। সভাসমিতি, চিঠিপত্র, বক্তৃতা-ভাষণে ইংরেজির প্রচলন ঘটে।
বিদেশি ভাষার আধিপত্যজনিত কুফল
ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে এখনও কয়েক শতাংশ মানুষ শিক্ষার মৌলিক অধিকারের বহির্ভূত, অন্তেবাসী। সেখানে বিদেশি ভাষার আধিপত্য সর্বশিক্ষার সর্বব্যাপী সম্ভাবনাকে অসম্ভব করে তোলে প্রতিমুহূর্তে। পরভাষাকেন্দ্রিক কৃত্রিম শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে একাত্ম হতে না পেরে শিক্ষার উদ্দেশ্য প্রতিমুহূর্তে ব্যর্থ হয়ে যায়।
সহযোগী ভাষা-শিক্ষার তাৎপর্য
‘নানা-ভাষা নানা মত নানা পরিধান’-এর দেশ এই ভারতবর্ষ-ফলে সর্বভারতীয় স্তরে ভাবের আদানপ্রদান, কাজকর্ম, সংযোগরক্ষার্থে মাতৃভাষা ব্যতীত সহযোগী ভাষার প্রযোজনীয়তা অনিবার্য। তাই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের প্রয়োজনে মাতৃভাষায় শিক্ষাদীক্ষার পাশাপাশি সহযোগী ভাষা-শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রের মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক স্তরে প্রথম ভাষারূপে মাতৃভাষা এবং দ্বিতীয় ভাষারূপে ইংরেজিকে আবশ্যক করা হয়েছে।
মাতৃভাষায় শিক্ষার প্রসার
স্বাধীন ভারতে প্রাথমিক শিক্ষার স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের নীতিকে অনিবার্যরূপে প্রতিষ্ঠা দেওয়া গেলেও শিক্ষার সর্বস্তরে শিক্ষার বাহনরূপে মাতৃভাষা এখনও ছাড়পত্র পায়নি। এর মূল কারণ উপযোগী গ্রন্থ, পরিভাষা, সর্বোপরি শিক্ষাব্যবস্থার উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব। তবে এর মূলে রয়েছে বিদেশি ভাষার অন্ধ অনুসরণ ও মাতৃভাষার প্রতি অনুদারতা।
উপসংহার
স্বাধীন ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্নকে যথার্থরূপে সার্থক করে তুলতে, জাতিকে শিক্ষা, সাহিত্যসংস্কৃতিতে উদ্বুদ্ধ পরিমার্জিত করে তুলতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন মাতৃভাষার শ্রীবৃদ্ধি সাধন ও মাতৃভাষায় শিক্ষাদান। না হলে স্বাধীনতার প্রকৃতি অধীনতামুক্ত বিদেশি ভাষার মোহবন্ধনে চিরকাল অধরাই থেকে যাবে।