ইন্টারনেট ও আধুনিক জীবন প্রবন্ধ রচনা – আজকের পর্বে ইন্টারনেট ও আধুনিক জীবন প্রবন্ধ রচনা নিয়েআলোচনা করা হল।
ইন্টারনেট ও আধুনিক জীবন প্রবন্ধ রচনা
ইন্টারনেট ও আধুনিক জীবন প্রবন্ধ রচনা
ভূমিকা
সারা পৃথিবী জুড়ে বিস্তৃত, পরস্পরের সঙ্গে সংযোগের কম্পিউটার নেটওয়ার্কনির্ভর আধুনিক ব্যবস্থাপনার নাম ইনটারনেট। এই ব্যবস্থাপনা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত এবং এখানে ইনটারনেট প্রোটোকলের প্রামাণ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে ডেটা আদানপ্রদান হয়। এখানে আমাদের মনে রাখা দরকার ইনটারনেট এবং ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবকে একই গোত্রে ফেলা হলেও প্রকৃতপক্ষে বিষয় দুটি পৃথক। ইনটারনেটের সম্পূর্ণ নাম ‘ইনটারনেটওয়ার্ক’। এই ব্যবস্থাপনায় বিশেষ গেটওয়ের মাধ্যমে কম্পিউটার নেটওয়ার্কগুলি একে অপরের সাথে সংযোগ তৈরি করে। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন সামরিক বাহিনীর গবেষণা সংস্থা এআরপিএ পরীক্ষামূলকভাবে ‘প্যাকেট সুইচিং’ পদ্ধতিতে আরপানেট নামে একটি যোগাযোগের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। এরপর ১৯৮০-তে আমেরিকার ‘ন্যাশনাল সাইন্স ফাউন্ডেশন’ তাকে বাণিজ্যিক রূপ দিতে সচেষ্ট হয়। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই ব্যবস্থাপনা সর্বসাধারণের আয়ত্তে আসে এবং আজ তা জনপ্রিয়তার শীর্ষে। সর্বোপরি কোভিড পরিস্থিতিতে ইনটারনেট হয়ে উঠেছে শুভদায়িনী শক্তি।
ইনটারনেট ব্যবস্থাপনার নবরূপায়ন
ইনটারনেট এখন আমাদের ঐতিহ্যবাহী যোগাযোগ ব্যবস্থাগুলিকে পুনর্গঠন করে যোগাযোগ ব্যবস্থায় অসম্ভব গতি দান করেছে। ভয়েসওভার ইনটারনেট প্রোটোকল, ইনটারনেট প্রোটোকল টেলিভিশন, ওয়েবসাইট, ব্লগিং, ওয়েব ফিড ইত্যাদি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ইনটারনেট এখন সব পেয়েছির দেশ। ক্যালিফোর্নিয়ায় আবিষ্কৃত ‘ইনটারনেট কর্পোরেশন ফর অ্যাসাইনড নেমস্ এন্ড নাম্বার’ সংস্থাটি এখন বিশ্বব্যাপী ইনটারনেটের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সংস্থা।
(১) নেটওয়ার্ক হিসেবে: কোনো ইন্সটিটিউশন বা সংস্থা ইনটারনেটের মাধ্যমে তাদের অফিসকর্মচারীদের মধ্যে যোগাযোগ রাখতে পারে। লকডাউন চলাকালীন তাই খুব সহজেই ঘরে বসে অফিসিয়াল কাজ অব্যাহত রাখা গেছে।
(২) মাধ্যম হিসেবে: কোনো সংস্থার উৎপাদিত বস্তু এবং তাদের কেনাবেচা সংক্রান্ত যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে এর ব্যবহার আজ সর্বজনস্বীকৃত। করোনা পরিস্থিতিতে খাদ্য থেকে ওষুধপত্র অবলীলায় মানুষের হাতে এসে পৌঁছেছে এর মাধ্যমে।
(৩) ব্যাবসাক্ষেত্রে: বর্তমানে ইনটারনেটের ব্যবহার বাণিজ্যের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। নিজ নিজ ওয়েবপেজে সংস্থার যাবতীয় বিষয় তুলে ধরে ব্যাবসার পথ সুগম হয়েছে। আবার গ্রাহক পরিষেবার বিস্তৃত ক্ষেত্র-টেলিফোন, রেলওয়ে, বিমানসংস্থা, হোটেল পরিষেবায় গ্রাহক সন্তুষ্টির অন্যতম মাধ্যম এটি। অনলাইন কেনাকাটা থেকে অনলাইন ব্যাংক পরিষেবা সবক্ষেত্রেই আজ ইনটারনেট অপরিহার্য। মহামারিকালে ইনটারনেটের সহায়তায় সুলভ হাসপাতাল থেকে ডাক্তারি পরামর্শ-সবই এক লহমায় হাতের নাগালে এসে পৌঁছেছে।
(৪) শিক্ষাক্ষেত্রে: ইনটারনেটের ব্যবহার শিক্ষাক্ষেত্রে ‘ডেটা’ সংগ্রহে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়ে পঠনপাঠন থেকে গবেষণায় নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। দূরশিক্ষার প্রসারে ইনটারনেটের ব্যবহার প্রচলিত ক্লাসরুম ধারণাকে ভেঙে দিচ্ছে। বিভিন্ন সংস্থার কোচিং, পরীক্ষা এখন অনেকটাই ইনটারনেটনির্ভর। শিক্ষাবিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে যোগাযোগ ইনটারনেটের দৌলতে আজ হাতের মুঠোয়। লকডাউনে স্কুল-কলেজ ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকলেও থেমে থাকেনি পড়াশোনা। অনলাইন ক্লাসের বদান্যতায় শিক্ষাব্যবস্থা অব্যাহত থেকেছে। এমনকি যথাসাধ্য মূল্যায়ন পদ্ধতিরও ব্যবস্থা করা গেছে।
(৫) বিনোদনের উৎস হিসেবে: ই-মেল থেকে খেলাধুলা একটি ‘নেট ‘নির্ভর স্মার্টফোনের দৌলতে আজ মানুষের পকেটে। গান, সিনেমা, আড্ডা-সবই আজ ইনটারনেট মারফত মানুষের ছায়াসঙ্গী। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ফেসবুক, টুইটারে মগ্ন আট থেকে আশি -সব বয়সিরা। ইনটারনেট এখন ক্রাউডসোর্সিং-এর দৌলতে প্রয়োজনেরগভীরে প্রবেশ করেছে। স্কাইপের ব্যবহার সব সীমাকেই প্রায় ভেঙে দিচ্ছে। করোনাকালে সিনেমা হল, শ্যুটিং বন্ধ থাকলেও সুফল প্রদান করেছে ওটিটি (Over The Top) প্ল্যাটফর্ম। নেটফ্লিক্স, হটস্টার-এর মাধ্যমে বিনোদনের হোম ডেলিভারি ঘটেছে সহজেই।
(৬) সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে: সামাজিক নানা প্রকল্পগুলি সরকারি অথবা বেসরকারি সংস্থাগুলি খুব সহজেই মানুষের কাছে নিয়ে যেতে পারছে এই মাধ্যমকে ব্যবহার করে। আজকের এই পৃথিবীতে একজন রাজনৈতিক নেতাকেও ইনটারনেট ব্যবহার করে তার বক্তব্য তুলে ধরে জনগণের সঙ্গে সংযোগসাধন করতে হচ্ছে।
(৭) মহাকাশগবেষণা ক্ষেত্রে: পৃথিবীর সীমা ছাড়িয়ে মহাকাশগবেষণায় ইনটারনেটের প্রয়োগ আজ আমাদের উপহার দিচ্ছে নিত্যনতুন বিস্ময়ক তথ্যাদি।
ইনটারনেটের অপব্যবহার ও ভবিষ্যৎ
ইনটারনেটের অপরিহার্যতা- এ নিয়ে বিতর্ক করে লাভ নেই। কিন্তু তার ব্যবহারের ক্ষতিকারক দিকগুলি সম্পর্কে সচেতন না থাকলে আধুনিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে। সমস্যাগুলিকে আমরা এভাবে চিহ্নিত করতে পারি- (১) ব্যক্তিগত তথ্য চুরি, (২) স্পামিং সমস্যা, (৩) ভাইরাস আক্রমণ, (৪) ভুল তথ্য, (৫) হ্যাকিং সমস্যা, (৬) বয়সের কোনো সীমারেখা না থাকায় অবাঞ্ছিত বা আপত্তিকর বিষয়ের সহজলভ্যতা, (৭) সামাজিক মানুষের অতিমাত্রায় ইনটারনেট ব্যবহারের ফলে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, (৮) শারীরিক ক্রিয়া কমে আসায় স্বাস্থ্যের অবনতি, (৯) লকডাউনকালে ইনটারনেটের মাধ্যমেই সারাদিনব্যাপী অনলাইন ক্লাস বা অফিসিয়াল কাজকর্মের ফলে মানসিক অবসাদ, শারীরিক অসুস্থতা।
উপসংহার
একজন সচেতন, দক্ষ ও মানবিক গুণের অধিকারী মানুষই পারে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে উন্নততর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে। আগামী পৃথিবীতে সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে কাটিয়ে আমাদের সমাজে ইনটারনেটের ব্যবহারকে আরও কার্যকর করে, অত্যাধুনিক করে তুলতে হবে মানবসভ্যতাকে।