একটি অসাধারণ বই পড়ার অভিজ্ঞতা রচনা |
প্রারম্ভিক কথা
বই মানুষের বন্ধু। বই পড়ার চর্চা এক মহান অভ্যাস। কিন্তু বর্তমান শিক্ষা পরিস্থিতির চাপে পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই পড়ার সুযোগ খুব সীমিত। তবে আমাদের বিদ্যালয়ের বহু প্রাচীন ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারের সুবাদে আমার প্রথম পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই পড়া শুরু। বিভিন্ন লেখকের ভিন্নস্বাদের বই পড়ার নেশা থেকেই একদিন পড়েছিলাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ বইটি।
পথের পাঁচালী’র কাহিনি
আমার প্রিয় গ্রন্থ ‘পথের পাঁচালী’র কাহিনি সহজ-সরল। গ্রন্থটি তিনটি পর্বে বিভক্ত-‘বল্লালী বালাই’, ‘আম আঁটির ভেঁপু’ ও ‘অক্রুর সংবাদ’। প্রথম পর্বে নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের যজমান বৃত্তিধারী এক ব্রাহ্মণ হরিহর রায়ের পূর্বপুরুষ ও দূরসম্পর্কীয়া বিধবা দিদি ইন্দির ঠাকরুণের প্রসঙ্গ রয়েছে। এই পর্বেই নায়ক অপুর জন্ম হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে গ্রন্থটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ অপু-দুর্গার বিভিন্ন কার্যকলাপ, প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা ইত্যাদি যেমন বর্ণিত হয়েছে তেমনি অপুর পাঠশালায় যাওয়া স্বপ্নমুগ্ধতা, কল্পনাবিলাসিতা ইত্যাদি প্রসঙ্গ রয়েছে। এই পর্বের শেষের দিকে রয়েছে দুর্গার মৃত্যু এবং স্ত্রী-পুত্র-সহ হরিহরের নিশ্চিন্দিপুর ত্যাগ। তৃতীয় পর্বে স্ত্রী-পুত্র-সহ হরিহরের কাশী গমন, কথকতা বৃত্তির সাহায্যে সংসারনির্বাহ, অসুস্থতা ও তাঁর মৃত্যু দেখানো হয়েছে।
আমার উপলব্ধি
‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসটি পড়ে আমার মনে হয়েছে লেখক এই কাহিনিকে গভীরতম উপলব্ধি থেকে নির্মাণ করেছেন। অপুর জীবনদর্শনের মাধ্যমে তিনি জীবনের পথ চলার গুরুভারকে সহজ করে দিয়েছেন। হরিহরের সঙ্গে অপুর প্রথম বাড়ির বাইরে যাওয়া, মায়ের মুখে মহাভারতের গল্প শুনে কর্ণের জন্য অশ্রুপাত, দিদি দুর্গার সঙ্গে আম কুড়োনো, রেলগাড়ি দেখতে যাওয়ার রোমাঞ্চ, আবার কখনও নিঃসঙ্গ অবস্থায় গ্রামের প্রতি অদ্ভুত মমত্ববোধ-এমন সব বিবরণ বারবার পাঠ করেও যেন চিরনতুন মনে হয়। এ গ্রন্থে বিভূতিভূষণের শিল্পীসত্তা হল অপু। অপুর চোখ দিয়েই তিনি এ উপন্যাসের কাহিনি বর্ণনা করেছেন। অপু তার শৈশবের অপার বিস্ময় দিয়ে জীবনকে উপভোগ করেছে। পাশাপাশি অপু উপলব্ধি করেছে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর স্বরূপ। পিসি ইন্দির ঠাকরুণ, দিদি দুর্গা এবং পিতা হরিহরের মৃত্যু অপুকে মানবজীবনের সত্য উন্মোচনের পথে নিয়ে গিয়েছে। এসব পড়তে পড়তে, ভাবতে ভাবতে আমার মনে হয়েছে > জীবনটা আসলে একটা পথ, সকল মানুষকেই সেই পথ অতিক্রম করতে হয়। চলার পথে থাকে প্রতিবন্ধকতা, অনেক দুঃখ; তবু তো পথিকের ‘পথ চলাতেই আনন্দ।’ এ উপন্যাস পড়তে পড়তে তাই আমার মনে হয়েছে, গদ্যে রচিত হলেও এ গ্রন্থের এক-একটি অংশ যেন কাব্যরসে সম্পৃক্ত।
আমার অভিজ্ঞতা
ভারতীয় সভ্যতা পরিবারভিত্তিক। এই পরিবারভিত্তিক সভ্যতায় মা-বাবা, ভাই-বোন, ছেলেমেয়ে, আত্মীয়পরিজনের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের এক নিবিড় বন্ধন আছে। এই বন্ধনচিত্র ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে এতটাই আন্তরিক যে, এ গ্রন্থ বারবার আমাকে আকর্ষিত করে। এ গ্রন্থে অনেক মৃত্যু আছে, দুঃখদারিদ্র্যের অবতারণাও আছে; তবু প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্য, কন্যার প্রতি পিতার স্নেহ কিংবা মায়ের প্রতি পুত্রের অকৃত্রিম ভালোবাসা যেন জীবনের এক মহার্ঘ আনন্দের স্বাদ বহন করে আনে। তাই মনে হয় এ উপন্যাস কোনো এক বিশেষ যুগের না হয়ে সত্য ও সৌন্দর্যের সংমিশ্রণে হয়ে উঠেছে চিরকালের।
উপসংহার
আমার মনের মণিকোঠায় স্থান পেয়ে যাওয়া উপন্যাসটির নাম ‘পথের পাঁচালী’। এ উপন্যাসে কিন্তু কোনো আদর্শের পরিকল্পনা নেই, সমাজের কোনো গভীর সমস্যাকে এখানে চিহ্নিত করা হয়নি; এমনকি এর পরিধির বিশালতাও নেই-তবুও এ উপন্যাস আমার কাছে অসাধারণ ও প্রিয়। শৈশব থেকে কৈশোরের এই যে কাল আমি অতিক্রম করছি তার সঙ্গী ও ভবিষ্যতের পাথেয় যেন এই ‘পথের পাঁচালী’। জীবনে অনেক আনন্দ আছে, যা অশ্রুপাত ঘটিয়ে মনকে আরও পবিত্র করে তোলে-‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস পাঠের অভিজ্ঞতা আমার কাছে তেমনই। সেইসঙ্গে ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসটি আমার কাছে ‘পথ’ শব্দটির গভীর তাৎপর্য নিয়ে আসে। উপন্যাসটি আমার জীবন অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করে।