যন্ত্র-সভ্যতা-বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
যন্ত্র-সভ্যতা-বর্তমান ও ভবিষ্যৎ |
যন্ত্র-সভ্যতা-বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
ভূমিকা
মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যন্ত্রের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আদিম যুগে মানুষ যখন বন-জঙ্গলে বাস করত তখন দৈহিক ক্ষমতার সাহায্যে সব কাজ করতে হত। সভ্যতার বিবর্তনে বুদ্ধির প্রয়োগে শ্রমের বোঝা লাঘব করার জন্য যন্ত্রের ব্যবহার শুরু করল। মানুষ চেষ্টা করতে থাকল যন্ত্রের বিপুল শক্তি করায়ত্ত করে প্রকৃতি ও দৈবশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেকে প্রমাণ করবে যে সে অসীম শক্তি ধর। নিজের অজান্তে মানুষ এইভাবে নিজেকে অর্পণ করল হৃদয়হীন যন্ত্রের কাছে। যন্ত্রশক্তিকে করায়ত্ত করে যতই সে হয়ে উঠল শক্তিধর ততই নিজেকে সঁপে দিতে বাধ্য হল যন্ত্রের পদতলে।
যন্ত্রের ব্যবহার ও তার ফল-শ্রুতি
যন্ত্র আবিষ্কার বিজ্ঞানের অবদান। যন্ত্রের জন্মলগ্নে বিজ্ঞানের ছিল সামাজিক কল্যাণ চেতনা। বিপুলা এই পৃথিবীর বুকে রয়েছে তার সন্তানদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জিয়ন-কাঠি। মানুষ দেখল পৃথিবীর বুকে খনিজ- সম্ভার গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন, পৃথিবীকে আরও শস্যশালী করতে হলে শরীরের সীমিত ক্ষমতা পরাজয় স্বীকার করছে, প্রকৃতির দুর্যয় ক্ষমতার কাছে মানুষ নিজেকে অসহায় বোধ করছে, অথচ সুদূর বিস্তৃত নদী-সাগর, গহণ অরণ্য, মহাকাশের ছোঁয়া পেতে চায় সে। মানুষ প্রয়োজন অনুভব করল এমন এক শক্তির যা বিশ্বের সম্পদ হাতের মুঠোয় পৌঁছে দিয়ে বাড়িয়ে দেবে জীবনের শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য। এই প্রয়োজনবোধ থেকেই যন্ত্রের জন্ম। শুরু হল যন্ত্র-যুগ।
যন্ত্রের শক্তি ও মানব-সেবা
য়ুরোপের শিল্প-বিপ্লবরের সময় থেকে পৃথিবীতে যন্ত্রযুগের সুত্রপাত। পরবর্তী কালে ঘটেছে যন্ত্রের যেমন রূপান্তর তেমনি তার শক্তির পরিবর্তন। চালক-শক্তির স্থান নিয়েছে বায়ু, বাষ্প, বাতাস, বৈদ্যুতিক শক্তি, পারমাণবিক, পেট্রল প্রভৃতি। কখনও জীব-জন্তু বা মানুষ চালকের দায়িত্ব পালন করে। যেন আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ, দৈত্যের মতো শক্তিশালী যন্ত্র মানুষের নির্দেশ পালন করতে বাধ্য। যন্ত্রশক্তি জল-স্থল-অন্তরীক্ষ জয় করে মানুষের হাতে তুলে দিয়েছে বিজয় পতাকা। যন্ত্র দূরকে করেছে নিকট, অজানাকে করেছে জানার আনন্দে ভরপুর। যন্ত্র কৃষিকে করেছে শস্যশালিনী, শিল্পকে করেছে উৎপাদনশীল, প্রকৃতির খেয়ালিপনা থেকে নিজেদের রক্ষা, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-ঝড়-ঝঞ্ঝা-বন্যা প্রভৃতির সাথে পাঞ্জা লড়ার ক্ষমতা।
মানসিক শারীরিক শ্রম লাঘব
বিজ্ঞান ইলেকট্রনিক্স-কম্পিউটার আবিষ্কার করে মানুষের মস্তিষ্ককে দিচ্ছে বিশ্রামের সুযোগ। এর আগে পর্যন্ত যন্ত্র মানুষের দৈহিক শ্রম লাঘব করতে সাহায্য করেছে। বুদ্ধি ও চিন্তন জগতে কম্পিউটারের এখন অবাধ বিচরণ। বিশাল বিশাল সংখ্যা সম্বলিত গাণিতিক যোগ-বিয়োগ-গুণ- ভাগের নির্ভুল হিসাব নিমেষের মধ্যে করে দিতে পারে এই যন্ত্র। শুধু তাই নয়, যখন বিশৃঙ্খল ঘটনাপুঞ্জের অবর্ণনীয় ভিড়ে উদ্ভ্রান্ত মানুষের কাছে সত্য নিরুপণ হয়ে পড়ে দূর-পরাহত, যখন সংগৃহীত বহু বিচিত্র তথ্যাবলীর পুঞ্জীভূত স্তূপের মধ্য থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ তার কাছে হয়ে পড়ে সাধ্যাতীত, তখন কম্পিউটার তাকে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো জানিয়ে দেয় নির্ভুল পথ-নির্দেশ, স্নায়বিক চাপ থেকে দেয় তাকে মুক্তি। রোবট বা যন্ত্র-মানব মানুষের হুকুমে অনেক শ্রমসাধ্য কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে দিচ্ছে।
যন্ত্র ও তার অভিশাপ
মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্য করেছে যন্ত্রযুগ শুরু হওয়ার ফলে যে তা যেমন সত্যি কথা তেমনি আলোর তলায় যে অন্ধকার আছে যন্ত্র আবির্ভূত হওয়ায় মানুষ তার নিজস্ব কর্মশক্তি হারিয়ে ফেলছে একথাও ঠিক। যন্ত্র-দানবের ধুমময় বিষাক্ত নিঃশ্বাসে মানব-জীবনের সাবলীকতাকে বিধবংস করে ছড়িয়ে দিয়েছে মরুভূমির কঠোর ধূসরতা, শরীরের দৈহিক ক্ষমতা হরণ করে তার হাতে তুলে দিয়েছে অন্ধকার-বিষময় এক পরিবেশ। মানুষ আজ অসহায়, যন্ত্রনির্ভর।
মানুষই খুঁড়ছে নিজের কবর
মানুষই বিজ্ঞানের স্রষ্টা, যন্ত্রের প্রাণ-প্রতিষ্ঠাতা। সে তিল তিল করে তার জ্ঞানবুদ্ধি ও ক্লান্তিহীন তপস্যার মাধ্যমে সমৃদ্ধ করে তুলেছে তাকে। আধুনিক সভ্যতা হয়ে উঠছে প্রাণোচ্ছল বিজ্ঞানের সমৃদ্ধির ফলে। কিন্তু মানুষ বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে অপব্যবহার করে নিজেদের বিনাশ সাধনের জন্য খুঁড়ছে কবর। বিজ্ঞান সৃষ্টি করেছে অত্যাধুনিক অস্ত্র নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্য। মানুষ তা ব্যবহার করছে যুদ্ধ ক্ষেত্রে বা অন্যত্র মানুষকে নিধন যজ্ঞে মেতে উঠে, ‘স্টার-ওয়র’ বা নক্ষত্র-যুদ্ধের আয়োজন করে, বিধাতার সৃষ্টির শিয়রে মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে সে হাজির হয়েছে। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে অজান্তে যন্ত্র মানুষের হাতের কাজ কেড়ে নিয়েছে, হরণ করেছে তার জীবন-কাঠি। প্রাচীন সভ্যতার সনাতন- জীবন-ছন্দের তার গিয়েছে ছিঁড়ে, মৃত্যু হচ্ছে মানবিক সুকোমল চিন্তা-বোধের, প্রাচীন বন্য-যুগের হিংস্র জীবনের চেয়ে ও মানুষ বিবেক হারিয়ে হয়ে উঠছে হিংস্রতর।