উপযোগবাদী হিসেবে জন স্টুয়ার্ট মিলের বক্তব্যসমূহ ব্যাখ্যা করো। মেকলের নীচে চুঁইয়ে পড়ার তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করো।

উপযোগবাদী হিসেবে জন স্টুয়ার্ট মিলের বক্তব্যসমূহ ব্যাখ্যা করো। মেকলের নীচে চুঁইয়ে পড়ার তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করো
উপযোগবাদী হিসেবে জন স্টুয়ার্ট মিলের বক্তব্যসমূহ ব্যাখ্যা করো। মেকলের নীচে চুঁইয়ে পড়ার তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করো।

উপযোগবাদী হিসেবে জন স্টুয়ার্ট মিলের বক্তব্যসমূহ

উপযোগবাদী বা Utiliterian-দের মূল কথা হল Greatest good for the greatest number। অর্থাৎ, সমস্ত কর্মকান্ডের পিছনে প্রধান উদ্দেশ্য হল সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সুখ ও কল্যাণ। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ইতিহাসবিদ জেমস মিলের জ্যেষ্ঠপুত্র জন স্টুয়ার্ট মিল তাঁর ব্যক্তিগত মতাদর্শের ভিত্তিতে উপযোগবাদকে তুলে ধরেন। তাঁর বক্তব্যগুলি হল-

উপযোগবাদ সম্মন্ধে মিলের নিজস্ব মনোভাব: জন স্টুয়ার্ট মিল তাঁর ব্যক্তিগত মতাদর্শের ভিত্তিতে উপযোগবাদকে তুলে ধরেন। পরম সুখভোগের নীতির পরিবর্তে তিনি জ্ঞান, বৌদ্ধিকতা এবং নৈতিকতাকেই সামাজিক মঙ্গলসাধনের ভিত্তিরূপে দেখিয়েছেন।

On Liberty: জন স্টুয়ার্ট মিল তাঁর ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘On Liberty’ নামক গ্রন্থে, ব্যক্তিগত এবং সামাজিক স্বাধীনতা সম্বন্ধে নিজের মত ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের প্রাধান্য বিস্তার হল জনকল্যাণের পরিপন্থী। অথচ অন্য জায়গায় তিনি বলেছেন যে, একটি দুর্বল সেতুতে আরোহণ করছে এমন কোনো ব্যক্তিকে বাধাদান করা যেমন তার স্বাধীনতাকে খর্ব করা নয় তেমনই ব্যক্তির মঙ্গলের জন্য কিছুক্ষেত্রে রাষ্ট্র যদি মৌলিক অধিকারের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপও করে তবে তা অন্যায্য নয়।

উপনিবেশবাদী ধ্যানধারণা: উপনিবেশবাদের সমর্থক। জন স্টুয়ার্ট মিল এশিয়া, আফ্রিকার স্থানীয় অধিবাসীদের ‘বর্বর’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি ভারতবর্ষকে ‘Oriental Societies’-দের মধ্যে পরিগণিত করেছেন। তবে পাশাপাশি মিল এটাও মনে করতেন যে, উপযুক্ত শিক্ষা ও শাসনের মাধ্যমে ভারতীয়দের স্বশাসনের জন্য উপযুক্ত করে তোলা সম্ভব। তাই চার্লস মেটক্যাফ বলেছেন যে, জন স্টুয়ার্ট মিল ভারতীয়দের নীচু করে দেখাননি, বরং তারা যাতে অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যেতে পারে, সেই পথেরই সন্ধান দিয়েছেন তিনি।

মেকলের ‘চুঁইয়ে পড়ার তত্ত্ব’: ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনের ৪৩ নং ধারার ব্যাখ্যাকে কেন্দ্র করে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষাসভায় একটি বিতর্কের সৃষ্টি হয় যার বিষয় ছিল যে, ভারতে আধুনিক শিক্ষার মাধ্যম কী হবে-প্রাচ্য না পাশ্চাত্য? এরকম পরিস্থিতিতে মেকলে এই বিতর্ককে কেন্দ্র করে তাঁর বিখ্যাত মিনিট বা বক্তব্য পেশ করেন।

মেকাল মিনিট: মেকলে তাঁর মিনিটে বলেন-

  • সাহিত্য বলতে কেবলমাত্র সংস্কৃত বা আরবি সাহিত্য নয়, ইংরেজি সাহিত্যকেও বোঝায়।
  • শিক্ষিত ভারতীয় বলতে শুধুমাত্র সংস্কৃত বা আরবি জানা পণ্ডিত ও মৌলবী নয়, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিকেও বোঝায়।
  • ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিল তা শুধু ভারতীয় পণ্ডিতদের বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রেই নয়, ব্রিটিশ প্রজাদের মধ্যে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারেও তা ব্যয়িত হবে।

ভারতে শিক্ষার মাধ্যম কী হবে- দেশীয় ভাষা বা মাতৃভাষা, সংস্কৃত বা আরবি ভাষা নাকি ইংরেজি ভাষা-এই নিয়ে তিনটি মতের উত্থান ঘটেছিল। মেকলে তাঁর মিনিটে লেখেন যে, দেশীয় ভাষা এত হীন যে তার মাধ্যমে কখনই পাশ্চাত্য শিক্ষাদান করা যায় না। তাঁর মতে, একমাত্র ইংরেজি ভাষাই পারবে ভারতীয়দের পাশ্চাত্য রুচি, মতাদর্শ, নৈতিকতা ও বুদ্ধির দ্বারা কর্মক্ষম ও উজ্জীবিত করে তুলতে। মেকলে মনে করতেন যে, সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি যদি এইভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে, তবে সেই শিক্ষা অবধারিতভাবেই নীচু শ্রেণির মানুষদের কাছেও পৌঁছে যাবে। মেকলের এই নীতিকেই চুঁইয়ে পড়ার নীতি বা অভিস্রবণ তত্ত্ব বলা হয়।

প্রতিষ্ঠার কারণ:
প্রাচ্যবাদীদের (যারা দেশীয় ভাষায় শিক্ষাদানকে সমর্থন করেছিলেন) যাবতীয় প্রতিবাদ সত্ত্বেও ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চ একটি সরকারি নির্দেশনামায় লর্ড বেন্টিঙ্ক মেকলের এই প্রস্তাবগুলিকে অনুমোদন করেন। তাঁর এই নীতি প্রবর্তনের পিছনে অনেক কারণ থাকতে পারে, যেমন- ইংরেজরা ভারতীয়দের মধ্য থেকে একদল ব্রিটিশ অনুরক্ত এলিট শ্রেণি তৈরি করতে চেয়েছিলেন যারা বর্ণে ও রক্তেই শুধু ভারতীয় থাকবে, কিন্তু নীতি, রুচি ও বুদ্ধিতে হবে ইংরেজ। আবার এও হতে পারে যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সুবিধার্থে কয়েকজন কেরানি তৈরির উদ্দেশ্যেই তিনি এই নীতি প্রবর্তন করেছিলেন।

Leave a Comment