ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কীভাবে দেওয়ানি লাভ করে? এর গুরুত্ব বা ফলাফলগুলি আলোচনা করো |
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কীভাবে দেওয়ানি লাভ করে? দেওয়ানি লাভের গুরুত্ব বা ফলাফলগুলি আলোচনা করো |
কোম্পানির দেওয়ানি লাভ
ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভ করে প্রভূত ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী হলেও সেই ক্ষমতার কোনো আইনগত ভিত্তি ছিল না। এই লক্ষ্যে কোম্পানি আইনানুগ স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য দেওয়ানি লাভের উদ্যোগ নেয়।
নৃপতি স্রষ্টা
ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পলাশির যুদ্ধে (১৭৫৭ খ্রি.) জয়লাভ করে বাংলাদেশে নৃপতি স্রষ্টা-র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ফলে কোম্পানির বাণিজ্যিক সুবিধা ও রাজনৈতিক প্রভাব বেড়ে যায়।
বক্সারের যুদ্ধ
বাংলার নবাব মির কাশিম-এর সঙ্গে বাণিজ্য শুল্ক সংক্রান্ত প্রশ্নে কোম্পানির বিরোধ বাধে যা যুদ্ধে পরিণত হয়। কাটোয়া, গিরিয়া ও উদয়নালার যুদ্ধে মির কাশিম পরাজিত হয়ে প্রতিবেশী অযোধ্যা রাজ্যে আশ্রয় নেন। এরপর মির কাশিম, অযোধ্যার নবাব সুজা উদ-দৌলা ও দিল্লির মুঘল সম্রাট শাহ আলমের মিলিত জোটশক্তি বক্সারের যুদ্ধে (১৭৬৪ খ্রি.) কোম্পানির কাছে পরাজিত হয়।
সন্ধি স্থাপন
বক্সারের যুদ্ধ জয়ের পর কোম্পানি সুজা উদ-দৌলার সঙ্গে এলাহাবাদের প্রথম সন্ধি (১৭৬৫ খ্রি.) স্বাক্ষর করে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫০ লক্ষ টাকা এবং কারা ও এলাহাবাদ প্রদেশ লাভ করে। তারপর সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সঙ্গে এলাহাবাদের দ্বিতীয় সন্ধির (১২ আগস্ট, ১৭৬৫ খ্রি.) মাধ্যমে কোম্পানি সম্রাটকে কারা ও এলাহাবাদ অঞ্চল ও বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা কর প্রদানের বিনিময়ে লাভ করে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি বা রাজস্ব আদায়ের অধিকার।
দেওয়ানি লাভের গুরুত্ব বা ফলাফল
বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে বিভিন্ন দিক থেকে কোম্পানির দেওয়ানি লাভের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষেত্রে গুরুত্ব
রাজনৈতিক : নামসর্বস্ব হলেও মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম ছিলেন ভারতের আইনসম্মত বা বৈধ শাসক। দেওয়ানি লাভের ফলে বাংলা তথা ভারতের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় কোম্পানির আইনগত বৈধতা প্রতিষ্ঠিত হয়। পূর্বে মুঘল শাসনব্যবস্থায় সুবা বা প্রাদেশিক প্রশাসনে সর্বোচ্চ শাসক ছিলেন সুবাদার বা নবাব নাজিম। তাঁর অধস্তন ছিলেন দেওয়ান। কিন্তু ইংরেজ কোম্পানি দেওয়ান নিযুক্ত করে নবাব নাজিমকে হাতের পুতুল ও বৃত্তিভোগীতে পরিণত করে। এভাবে কোম্পানি একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত হয়।
অর্থনৈতিক : এর পাশাপাশি এলাহাবাদের দুটি চুক্তি স্বাক্ষর ও দেওয়ানি লাভের ফলে প্রাপ্ত বিপুল অর্থকে কাজে লাগিয়ে ইংরেজরা তাদের বাণিজ্য বৃদ্ধি ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করে এবং আর্থিক দিক থেকে সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে।
বাংলা তথা ভারতের ক্ষেত্রে গুরুত্ব
রাজনৈতিক : কোম্পানির দেওয়ানি লাভের ফলে বাংলায় দ্বৈত শাসনব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল। এই ব্যবস্থায় নবাবের হাতে ছিল নিজামত বা ক্ষমতাহীন দায়িত্ব আর কোম্পানির হাতে ছিল দেওয়ানি বা দায়িত্বহীন ক্ষমতা।
অর্থনৈতিক : দেওয়ানি লাভের ফলে কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার লাভ করে। এ ছাড়া কোম্পানি বেশি অর্থ উপার্জনের জন্য ভূমিরাজস্বের হার বৃদ্ধি করে, নতুন নতুন কর কৃষকদের ওপর চাপিয়ে দেয় এবং জমি থেকে পুরোনো কৃষকদের উচ্ছেদ করে নতুন কৃষককে জমি বন্দোবস্ত দিতে থাকে। ফলে বাংলার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং তা চরম আকার ধারণ করে বাংলার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে, যা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (১৭৭০ খ্রি.) নামে পরিচিত।