সপ্তম শতকে ‘ভক্তিবাদ’-এর উত্থান বলতে তুমি কী বোঝ – আজকের পর্বে সপ্তম শতকে ‘ভক্তিবাদ’-এর উত্থান বলতে তুমি কী বোঝ তা আলোচনা করা হল।
সপ্তম শতকে ‘ভক্তিবাদ’-এর উত্থান বলতে তুমি কী বোঝ
সপ্তম শতকে ‘ভক্তিবাদ’-এর উত্থান বলতে তুমি কী বোঝ |
প্রাচীনকালে দক্ষিণ ভারতে পল্লব বংশের রাজত্বকাল (খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতক থেকে খ্রিস্টীয় নবম শতক) হিন্দুধর্মের পুনরুত্থানের যুগ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এই সময় ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্মের মাধ্যমে দাক্ষিণাত্যে আর্য সভ্যতার ধর্মীয় আদর্শের প্রসার ঘটে। পল্লব রাজাদের সহায়তায় সপ্তম শতক থেকে দাক্ষিণাত্যে বহু হিন্দু মঠ ও মন্দির স্থাপিত হয়। কাঞ্চি বিশ্ববিদ্যালয় দাক্ষিণাত্যে হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃত ভাষা প্রচারের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়।
ভক্তিবাদের প্রসার
পল্লব রাজারা বিষ্ণু ও শিবের উপাসক ছিলেন। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় পল্লব যুগে বৈয়ব ও শৈব ভক্তি সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। সপ্তম শতক ও তার পরবর্তীকালে দাক্ষিণাত্যের শৈবধর্মের অনুরাগী নায়নার ও বৈয়ব ধর্মের অনুরাগী আলবার সম্প্রদায় প্রচার করে যে, ভগবানের প্রতি ভক্তিই হল ভক্তের সঙ্গে ভগবানের মিলনের একমাত্র পন্থা। সাধকগণ সাধারণ মানুষের সহজবোধ্য তামিল ভাষায় তাদের মতাদর্শ প্রচার করতেন। তাঁদের উদ্যোগে সমাজে ভক্তিধর্ম ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তামিল ভাষায় বিভিন্ন ভক্তিগীতি রচিত হয়। ভক্তিবাদী সাধকদের উদ্যোগে এই ভক্তিগীতিগুলি সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। নায়নারপন্থী আপ্পর, সুন্দরর, সম্বন্দর, মনিক্কবসগর প্রমুখ ভক্তিবাদী সাধক ভক্তিবাদের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
জাতিভেদের বিরোধিতা
তামিল ভক্তিবাদী সাধকগণ ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বর্ণ বা জাতিভেদ প্রথাকে স্বীকার করেননি। দাক্ষিণাত্যে ভক্তিবাদী সাধকদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন নিম্নবর্ণের হিন্দু। ভক্তি সাধনার দ্বারা তাঁরা সাধনার উচ্চমার্গে পৌঁছাতে সক্ষম হন। সমাজের পতিত শ্রেণির মানুষ ভক্তিধর্মের মাধ্যমে সামাজিক মুক্তির আনন্দ অনুভব করে। সপ্তম শতকের ভক্তিধর্মের দ্বারা প্রাচীন ব্রাহ্মণ্য বৈদিক ধর্ম ও নতুন ভক্তি সাধনার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান সম্ভব হয়।
গুরুত্ব
সপ্তম শতকে বিকশিত তামিল ভক্তিধর্মের বিভিন্ন গুরুত্ব ছিল।
(i) ড. রোমিলা থাপারের মতে, এই ভক্তিধর্ম ছিল বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া। (ii) ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায়ের প্রাধান্য এবং যাগযজ্ঞের বিরুদ্ধে এই ভক্তিধর্মের বিকাশ ঘটে। এর ফলে ভক্তিধর্মের সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে আপোষ করতে হয়।
(iii) ভক্তিধর্মের প্রসারে নারী সাধিকারাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। ভক্তিধর্মের প্রসারে সাধিকা অন্ডাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ‘তিরুপ্পাভই’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি ‘দক্ষিণের মীরাবাঈ’ নামে পরিচিত। (iv) ভক্তিবাদের প্রভাবে জাতিভেদ প্রথা বাধাপ্রাপ্ত হলে সমাজে অস্পৃশ্যদের স্পৃশ্য হওয়ার এবং তাদের স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণের সুযোগ আসে। (v) কেউ কেউ মনে করেন যে, নায়নারদের ভক্তিবাদী ধর্ম ছিল তামিল অঞ্চলে আর্য প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে অনার্য প্রক্রিয়া।