ভারতীয় নীতিতত্ত্বে ধর্মের সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্ক কী? ধর্মের প্রকারগুলি কী

ভারতীয় নীতিতত্ত্বে ধর্মের সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্ক কী? ধর্মের প্রকারগুলি কী
ভারতীয় নীতিতত্ত্বে ধর্মের সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্ক কী? ধর্মের প্রকারগুলি কী

ভারতীয় নীতিতত্ত্বে ধর্মের সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্ক

ভারতীয় ধর্মতত্ত্ব ও নীতিতত্ত্ব বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ধর্ম ও নীতি কোনোক্ষেত্রেই বিশিষ্টভাবে নেই। অর্থাৎ, একটিকে ছেড়ে আর-একটির অস্তিত্ব লক্ষ করা যায় না। অবশ্য এ কথা ঠিক যে, ভারতীয় নীতিতত্ত্বে কখনো-কখনো দেখা গেছে নীতিভিত্তিক ধর্মকে, আবার কখনো-কখনো দেখা গেছে ধর্মভিত্তিক নীতিকে। যাইহোক না-কেন, এ কথা ঠিক যে, ধর্ম ও নৈতিকতার সম্পর্ক যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ-তা অবশ্যই স্বীকার্য। অগ্নিপুরাণ, ব্রহ্মপুরাণ এবং পদ্মপুরাণে দশ প্রকার নৈতিক নিয়ম তথা ধর্মের উল্লেখ দেখা যায়। এগুলি হল যথাক্রমে- (১) অহিংসা (২) ক্ষমা (৩) শম-দম্ (৪) দয়া (৫) শৌচ (৬) দান (৭) সত্য (৮) তপস্ (৯) অস্তেয় এবং (১০) জ্ঞান। এগুলির মধ্যে অবশ্য অহিংসাকেই পরম ধর্মরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ, অপরাপর ধর্মগুলি অহিংসা নামক ধর্মেরই অন্তর্ভুক্ত। বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনে এই অহিংসাকেই মূলমন্ত্ররূপে উল্লেখ করা হয়েছে। বৌদ্ধদর্শনে তাই বলা হয়েছে-সেই ব্যক্তিই হলেন পরমধার্মিক যিনি কথায়, কর্মে এবং চিন্তায় অহিংসরূপে গণ্য। সুতরাং সৎ চিন্তা, সৎ কর্ম এবং সৎ জীবনধারণই হল মানুষের প্রকৃত ধর্ম এবং এরূপ ধর্ম আয়ত্ত করাই হল মানুষের মৌল উদ্দেশ্য। সে কারণেই ধর্মকে একটি অন্যতম পুরুষার্থরূপে উল্লেখ করা হয়েছে।

দ্বিবিধরূপে ধর্ম

মনুসংহিতায় ধর্মের দুটি রূপ লক্ষ করা যায়-সাধারণ ধর্ম এবং বর্ণাশ্রম ধর্ম। সমাজে যে ধর্ম সাধারণ তথা সার্বিকভাবে পালনীয় তাকেই বলা হয় সাধারণ ধর্ম। সাধারণ ধর্ম তাই অবশ্যই মানুষের সামাজিক অবস্থানসাপেক্ষ এবং তারই আলোকে বিচার্য। কিন্তু বর্ণাশ্রম ধর্ম হল এমনই যা মানুষের সামাজিক অবস্থান নিরপেক্ষভাবে সমানভাবে পালনীয়। বর্ণাশ্রম ধর্ম তাই অবশ্যই সামাজিক অবস্থান নিরপেক্ষতার আলোকে বিচার্য।

সাধারণ ধর্ম

মনুসংহিতায় দশটি সাধারণ ধর্মের উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলি হল যথাক্রমে- (১) ধৃতি (নিজের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা), (২) ক্ষমা (অপরাধের মার্জনা), (৩) দম (সহনশীলতা) (৪) অস্তেয় (অপরের দ্রব্য চুরি না করা) (৫) শৌচ (দৈহিক ও মানসিক শুচিতা) (৬) ধী (জ্ঞানপ্রসূত বিচারশক্তি) (৭) নিগ্রহ (ইন্দ্রিয় সংযম) (৮) বিদ্যা (জীবন ও জগৎ সম্পর্কিত তত্ত্বমূলক জ্ঞান) (৯) সত্য (যথার্থরূপ প্রকাশ) এবং (১০) অক্রোধ (ক্রোধহীনতা)। মনুসংহিতায় এই যে দশটি সাধারণ ধর্মের উল্লেখ করা হয়েছে-এগুলি অগ্নিপুরাণ, পদ্মপুরাণ এবং বন্ধুপুরাণের দশটি নৈতিক নিয়মের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। বর্ণ এবং আশ্রম নির্বিশেষে এই সমস্ত ধর্ম প্রযোজ্য ও পালনীয় বলে এগুলিকে বলা হয় সাধারণ ধর্ম।

বর্ণাশ্রম বর্ণ

সামাজিক পেশার ভিত্তিতে চতুর্বর্ণ: সামাজিক মানুষের বর্ণ এবং ধর্ম-র ওপর ভিত্তি করে যে-ধর্ম গড়ে উঠেছে-তাকেই বলা হয় বর্ণাশ্রম ধর্ম। বর্ণ শব্দের সাধারণ অর্থ হল রং। কিন্তু নীতি ও ধর্মতত্ত্বে বর্ণ শব্দটি জাতিগত সামাজিক পেশা অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে। এরূপ অর্থে সামাজিক মানুষের একপ্রকার মানসিক প্রবণতাকে উল্লেখ করা হয়-যা তার চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের পরিচয় বহন করে। প্রত্যেকটি মানুষের চরিত্র গঠিত হয় সত্ত্ব, রজঃ এবং তমো-এই ত্রিগুণের সমন্বয়ে। কিন্তু এই তিনটি গুণ সকল মানুষের মধ্যেই সমানভাবে থাকে না। কারও চরিত্রে সত্ত্বগুণের প্রাচুর্যতা দেখা যায়, আবার কারও চরিত্রে রজগুণের প্রাবল্যতা পরিলক্ষিত হয়। আবার কারও চরিত্রে তমোগুণের প্রবল প্রভাব লক্ষ করা যায়। গুণত্রয়ের এরূপ প্রাবল্যহেতু সামাজিক মানুষের মধ্যে চতুর্বর্ণের সৃষ্টি ও ভেদ করা হয়েছে। এই চতুর্বর্ণ হল যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র।

Leave a Comment