বিশিষ্ট বিজ্ঞানী স্টিভেন উইলিয়াম হকিং (১৯৪২-২০১৮) রচনা

বিশিষ্ট বিজ্ঞানী স্টিভেন উইলিয়াম হকিং

বিশিষ্ট বিজ্ঞানী স্টিভেন উইলিয়াম হকিং (১৯৪২-২০১৮) রচনা
বিশিষ্ট বিজ্ঞানী স্টিভেন উইলিয়াম হকিং (১৯৪২-২০১৮) রচনা

ভূমিকা

গ্যালিলিও গ্যালিলেই-এর মৃত্যুর ঠিক তিনশত বছর পরে ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি স্টিভেন হকিংয়ের জন্ম অক্সফোর্ডে এবং বিশিষ্ট ইংরেজ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ হিসেবে বিশ্বের সর্বত্র তিনি পরিচিত ব্যক্তিত্ব। সাধারণ আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম মহাকর্ষ ছিল তাঁর কর্মের বিচরণ ক্ষেত্র। হকিং প্রথম অনিশ্চয়তার তত্ত্ব কুয় বিবর-এর ঘটনা দিগন্তে প্রয়োগ করে দেখান যে কৃষ্ণ বিবর থেকে বিকিরিত হচ্ছে কণা প্রবাহ-যা ‘হকিং বিকিরণ’ নামে বিশ্ববিখ্যাত হয়ে রয়েছে।

শৈশব ও শিক্ষা

হকিং-এর বাবা ড. ফ্রাঙ্ক হকিং একজন জীববিজ্ঞানী ও মা ইসোবেলা হকিং ছিলেন একজন রাজনৈতিক কর্মী। তার মা ছিলেন স্কটিশ। হকিংয়ের বাবা-মা উত্তর লন্ডনে থাকতেন। লন্ডনে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজছে, তখন একটি চিকিৎসা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে তার মা-বাবার পরিচয় হয়। হকিং-এর জন্মের পর তাঁরা আবার লন্ডনে ফিরে আসেন। ফিলিপ্পা ও মেরি নামে হকিংয়ের দুই বোন ছিল। লন্ডনের হাইগেটের বাইরন হাউজ স্কুলে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। পরে সেন্ট অ্যালবান্সে-তে পড়াশোনা করেন। ১৯৫৮ সাল থেকে তিনি ঘড়ির অংশবিশেষ, পুরনো টেলিফোনের সুইচবোর্ড ও অন্যান্য উপাদান দিয়ে কম্পিউটার তৈরি করেন। স্কুলে তিনি ‘আইনস্টাইন’ নামে পরিচিত ছিলেন। বিজ্ঞানে হকিং-এর সহজাত আগ্রহ ছিল। হকিং অক্সফোর্ড-এ পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন নিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন ও স্নাতক হন। এরপর কেম্ব্রিজ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে তাঁর বিয়ে হয় জেন ওয়াইল্ডের সাথে।

কর্মজীবন

তাত্ত্বিক কসমোলজি আর কোয়ান্টাম মাধ্যাকর্ষ হকিং-এর ছিল প্রধান গবেষণা ক্ষেত্র। ১৯৬০-এর দশকে কেম্ব্রিজের বন্ধু ও সহকর্মী রজার পেনরোজের সঙ্গে মিলে হকিং আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব থেকে একটি নতুন মডেল তৈরি করেন এবং এই মডেলের উপর ভিত্তি করে ১৯৭০-এর দশকে ‘পেনরোজ-হকিং তত্ত্ব’ গড়ে ওঠে। এই তত্ত্বের পর প্রথম বোঝা গেল, এককত্বের বীজ লুকোনো ছিল আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বে। ১৯৭৪-এ হকিং রয়্যাল সোসাইটির অন্যতম কনিষ্ঠ ফেলো নির্বাচিত হন। তিনি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল কসমোলজির গবেষণা প্রধান ছিলেন। ১৯৭৯ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসীয় অধ্যাপক ছিলেন। এছাড়া তিনি কেম্ব্রিজের গনভিল ও কেইয়ুস কলেজের ফেলো হিসেবে কাজ করেন।

গবেষণা

তাঁর ‘হকিং বিকিরণ’-এর তত্ত্ব ও সূত্রগুলি হল-পেনরোজ ‘হকিং তত্ত্ব’, বেকেনস্টাইন হকিং সূত্র, হকিং শক্তি, গিবব্দ-হকিং শক্তি, গিবল-হকিং আনসাৎজ, গিবল-হকিং প্রভাব, গিবন্স-হকিং মহাশূন্য, গিবন্স-হকিং-ইয়ক বাউন্ডারি টার্ম, ধর্ন-হকিং-পেঙ্কিল বাজি প্রভৃতি তত্ত্বের জন্য তিনি বিখ্যাত হয়ে রয়েছেন।

পুরস্কার

তাঁর Properties of Expanding Universes’ গ্রন্থটি কেম্ব্রিজ থেকে পুরস্কৃত হয়। তিনি রয়াল সোসাইটি অব আর্টস-এর সম্মানীয় ফেলো এবং পন্টিফিক্যাল একাডেমি অব সায়েন্সের আজীবন সদস্য ছিলেন। ২০০৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার, ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’ খেতাবে ভূষিত হন। তাঁর নিজের তত্ত্ব ও বিশ্বতত্ত্ব নিয়ে রচিত বই ‘কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ বইটির বাণিজ্যিক সফলতাও ছিল ঈর্ষণীয়। তিনি ১৯৬৬-তে অ্যাডামস পুরস্কার, ১৯৭৫-এ এডিংটন পদক, ১৯৭৬-এ ম্যাক্সওয়েল পদক, হিউ পদক, ১৯৭৮-এ আলবার্ট আইনস্টাইন পদক ছাড়াও অন্যান্য অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন। তাঁর প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-‘Black holes and baby universes and other essay’s (১৯৯৩), ‘The universe in a Nutshell’ (২০০১), ‘On the shoulders of Giants’ (২০০২) প্রভৃতি।

মতাদর্শ

২০০৬ সালে হকিং প্রশ্ন তুলেছিলেন-রাজনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগতভাবে বিশৃঙ্খল এই পৃথিবীতে, মানবজাতি কীভাবে আরও একশ বছর টিকে থাকবে? তিনি পরে এই প্রশ্ন সম্পর্কে জানিয়েছিলেন-যাতে মানুষ এই বিষয় নিয়ে ভাবে এবং এখন আমরা যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি তা সম্পর্কে সতর্ক থাকে। পৃথিবীর বর্তমান অবস্থার কথা ভেবে তিনি জানিয়েছিলেন, মানবজাতির ভবিষ্যতের জন্য। মহাশূন্যে ভ্রমণ ও মহাশূন্যে উপনিবেশ স্থাপন করা প্রয়োজন।

উপসংহার

তাঁর ‘দ্য থিওরি অব এভরিথিং’ বইটি ২০১৪ সালে মুক্তি প্রাপ্ত ব্রিটিশ জীবনীমূলক প্রণয়ধর্মী নাট্য চলচ্চিত্র। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পটভূমিতে নির্মিত ছবিটিতে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ স্টিভেন হকিং-এর জীবনী ও তার স্ত্রী জেনের সাথে তার সম্পর্ক, তার দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসা ও পদার্থ বিজ্ঞানে তার সাফল্যের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ২০১৮-র মার্চ কেম্ব্রিজে নিজের বাড়িতেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। তবে এই মৃত্যু শারীরিক, তাঁর সৃষ্টির কোনো মৃত্যু নেই, তা বহুদিন বিজ্ঞান অনুসন্ধিৎসু মানুষদের উৎসাহিত করবে।

আরও পড়ুন – সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী রচনা

Leave a Comment