থর্নডাইকের প্রচেষ্টা ও ভুলের তত্ত্ব | Thorndike’s Theory of Trial and Error Learning (Class 11 Exclusive )

থর্নডাইকের প্রচেষ্টা ও ভুলের তত্ত্ব [Thorndike’s Theory of Trial and Error Learning]

থর্নডাইকের প্রচেষ্টা ও ভুলের তত্ত্ব
থর্নডাইকের প্রচেষ্টা ও ভুলের তত্ত্ব

(1) প্রচেষ্টা ও ভুল তত্ত্ব সম্পর্কিত থর্নডাইকের পরীক্ষা:

প্রচেষ্টা ও ভুল তত্ত্ব সম্পর্কে থর্নডাইক কুকুর, বিড়াল, মানুষ প্রভৃতির ওপর পরীক্ষা করেছিলেন। তবে ক্ষুধার্ত বিড়ালের ওপর তাঁর পরীক্ষাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একটি ক্ষুধার্ত বিড়ালকে খাঁচার মধ্যে রেখে খাঁচার বাইরে খাবার রাখা হয়। খাঁচাটিতে একটি দরজা থাকে, যার ছিটকিনিটি খোলার জন্য খাঁচার মেঝের নির্দিষ্ট স্থানে চাপ দিতে হয়। খাঁচার মধ্যে ক্ষুধার্ত বিড়ালটি খাবার দেখা মাত্র উদ্দেশ্যহীন ও বিশৃঙ্খলভাবে ছোটাছুটি করতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ বৃথা চেষ্টা করার পর হঠাৎ তার পা নির্দিষ্ট স্থানে পড়া মাত্র দরজা খুলে যায় এবং বিড়ালটি বেরিয়ে এসে খাবার খায়।

দ্বিতীয়বার তিনি একই পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি করেন। বিড়ালটি পূর্বের মতো উদ্দেশ্যহীন এবং পরিকল্পনাহীন আচরণ করে। হঠাৎ তার পায়ের চাপে দরজা খুলে যায় এবং বাইরে এসে সে খাবার খায়। থর্নডাইক লক্ষ করেন বিড়ালটির ওপর, প্রথমবারে সমস্যাসমাধানের কোনো (খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসা) প্রভাব দ্বিতীয়বারে পড়েনি। কেবলমাত্র প্রথমবারের থেকে কম চেষ্টা ও কম সময়ে বিড়ালটি খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসার সমস্যাসমাধান করেছে। তৃতীয়বারের পরীক্ষাটিতে চেষ্টার সংখ্যা এবং সময় আরও কম লেগেছে। এইভাবে পরীক্ষাটি কয়েকবার করে থর্নডাইক দেখলেন বিড়ালটির ব্যর্থ প্রচেষ্টা ক্রমশ কমছে।

অবশেষে এক সময়ে দেখা গেল বিড়ালটিকে খাঁচার মধ্যে ঢোকানোর পরেই অনায়াসে সে নির্দিষ্ট স্থানে চাপ দিয়ে দরজার ছিটকিনি খুলে বেরিয়ে এসে খাবার খায়। কোনো ভুল প্রচেষ্টা নেই। অর্থাৎ, বিড়ালটির শিখন সম্পূর্ণ হয়। বিড়ালটি পরপর প্রচেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে উদ্দীপকের সঙ্গে প্রতিক্রিয়াটির সংযোগ ঘটাতে সমর্থ হয়েছে। প্রচেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে শিখনকে একটি লেখচিত্রের সাহায্যে চিত্রে দেখানো হয়েছে।

  1. থর্নডাইকের পরীক্ষায় প্রাপ্ত শিখন প্রক্রিয়ার স্তর: থর্নডাইকের পরীক্ষার ফলাফলগুলিকে বিশ্লেষণ করলে শিখন প্রক্রিয়ার সবকটি স্তর পাওয়া যায়। এগুলি হল তাড়না, লক্ষ্য,  বাধা, উদ্দেশ্যহীন প্রচেষ্টা, হঠাৎ সাফল্য, সঠিক পদ্ধতি নির্বাচন,  সঠিক পদ্ধতি স্থিরীকরণ।

এখানে ক্ষুধা বিড়ালের মধ্যে তাড়না সৃষ্টি করে। তার লক্ষ্য হল খাঁচার বাইরে রাখা মাংসের টুকরো সংগ্রহ করা। বাধা হল খাঁচা। বাধাকে অতিক্রম করতে বিড়ালটি উদ্দেশ্যহীন প্রচেষ্টা চালায়। বিড়ালটি হঠাৎ লিভারের উপর চাপ দেওয়ায় লক্ষ্যপূরণে সফল হয়। এইভাবে হঠাৎ সমাধান পদ্ধতি নির্দিষ্ট হওয়ার পর বারংবার অনুশীলন করে সঠিক পদ্ধতি নির্দিষ্ট করা হয়। অর্থাৎ প্রাণীটির শিখন সম্পূর্ণ হয়।

থর্নডাইকের মতে, শিখন প্রক্রিয়া যান্ত্রিকভাবে ঘটে। এতে চিন্তা বা বুদ্ধির কোনো ভূমিকা নেই। কীভাবে সমস্যা- সমাধান করা যাবে তার কোনো পূর্ব পরিকল্পনা নেই। অনুশীলনের মাধ্যমে ভুল প্রতিক্রিয়াগুলিকে বাদ দিয়ে সঠিক প্রতিক্রিয়া নির্বাচন করাই হল শিখন।

(2) প্রচেষ্টা ও ভুল তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য: 

থর্নডাইকের প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন হল একটি যান্ত্রিক অনুশীলননির্ভর প্রক্রিয়া। প্রাণীর প্রচেষ্টাগুলির মধ্যে ভুল প্রচেষ্টাগুলি ক্রমশ হ্রাস পায় এবং সঠিক প্রচেষ্টাটি ক্রমশ নির্দিষ্ট হয়। এইভাবে শিখন হয়। এই পদ্ধতিটি বিশ্লেষণ করলে যেসব বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, সেগুলি হল-

  • শিক্ষার্থীর সক্রিয়তা এবং চাহিদার ওপর নির্ভরশীলতা: প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখনপদ্ধতিটি শিক্ষার্থীর সক্রিয়তার ওপর নির্ভর করে। আর শিক্ষার্থীর সক্রিয়তার জন্য প্রয়োজন চাহিদা। থর্নডাইকের পরীক্ষার বিড়ালটি যদি ক্ষুধার্ত না হত তাহলে খাদ্যের জন্য বাইরে আসতে সক্রিয় হত না।
  • লক্ষ্য সম্পর্কে ধারণা: লক্ষ্য সম্পর্কে শিক্ষার্থীর স্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক।
  • যান্ত্রিকতা: এই প্রক্রিয়ায় চিন্তা, বুদ্ধি, পরিকল্পনা ইত্যাদির কোনো ভূমিকা নেই। সম্পূর্ণ যান্ত্রিক উপায়ে ভুল  প্রচেষ্টাগুলি বাতিল হয় ও সঠিক প্রক্রিয়া নির্দিষ্ট হয়। 
  • পুনরাবৃত্তি: সমস্যামূলক পরিস্থিতিতে উদ্দীপক এবং প্রতিক্রিয়ার মধ্যে বারবার সংযোগ ঘটিয়ে উপযুক্ত প্রতিক্রিয়াটি শনাক্ত করা হয়।
  • ক্রমহ্রাস: প্রচেষ্টার সংখ্যা এবং সময় ক্রমশ হ্রাস পায়।
  • বহুমুখী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি: প্রচেষ্টা ও ভুলের পদ্ধতিতে শিখনের সময় প্রাণী একই পরিস্থিতিতে নানারকমের প্রতিক্রিয়া করে।
  • ফলের ওপর নির্ভরশীলতা: এই প্রকার শিখনে কোন্ প্রতিক্রিয়াগুলি বর্জিত হবে এবং কোন্ প্রতিক্রিয়াটি গৃহীত হবে তা প্রচেষ্টার ফলের ওপর নির্ভর করে।
  • প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তা: এই প্রকার শিখনে প্রাণীর বা শিক্ষার্থীর প্রস্তুতির দরকার হয়।
  • জানা থেকে অজানা দিকে এগোনো: এই পদ্ধতির শিখনে প্রাণী বা শিক্ষার্থী জানা থেকে অজানার দিকে অগ্রসর হয়।
  • আংশিক প্রতিক্রিয়া: এই পদ্ধতিতে প্রাণী সামগ্রিকভাবে প্রতিক্রিয়া করে না, আংশিকভাবে করে। প্রথমে খাঁচার যে অংশ দেখেছে সেখানেই বিড়ালটি ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পরের বারে অন্য অংশ দেখে সেখানে লাফ দিয়েছে।
  • সর্বজনীনতা: সমস্যামূলক এবং জটিল পরিস্থিতিতে মানুষসহ সমস্ত প্রাণীই এই পদ্ধতির সাহায্য নেয়।

(3) প্রচেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে শিখনের নীতি: 

শিখনের প্রচেষ্টা ও ভুল কৌশলের পাশাপাশি থর্নডাইক শিখনের কয়েকটি নীতির কথা উল্লেখ করেন। এর মধ্যে তিনটি প্রধান বা মৌল নীতি ও পাঁচটি গৌণ নীতি। 

  • প্রধান নীতি: থর্নডাইকের শিখন সংক্রান্ত প্রধান নীতিগুলি হল-(i) ফললাভের নীতি, (ii) অনুশীলনের নীতি এবং [iii] প্রস্তুতির নীতি।
  • ফললাভের নীতি: এই নীতিতে বলা হয়েছে, একটি উদ্দীপক ও তার প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সংশোধনযোগ্য সংযোগ স্থাপিত হলে সেই সংযোগের ফল যদি প্রাণীর কাছে তৃপ্তিদায়ক হয় তবে সেই সংযোগ শক্তিশালী হয়। আর যদি সংযোগফলটি প্রাণীর কাছে বিরক্তিকর হয়, তবে সেই সংযোগ দুর্বল হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে এই নীতির ব্যাপক প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন-

[a] শ্রেণিশিখন আনন্দদায়ক প্রণালী: কোনো বিষয়ে শিখন যদি শিক্ষার্থীকে আনন্দ ও তৃপ্তি দেয়, তবে সেই বিষয় শিখতে শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক প্রেরণা দেখা দেয়। আবার বিরক্তিদায়ক শিখন অনুপ্রেরিত করে না এবং ওই শিখন স্থায়ী হয় না। সেইজন্য শ্রেণিকক্ষকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যাতে পাঠ্যবস্তু, শিখনপদ্ধতি এবং পরিস্থিতি শিক্ষার্থীর প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়। বিষয়বস্তু যাতে দুর্বোধ্য ও অর্থহীন না হয় এবং শিখনপদ্ধতি যাতে চিত্তাকর্ষক হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে।

[b] দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার সঙ্গে শিক্ষার্থীর বিষয়ের সম্পর্ক স্থাপন: থর্নডাইকের মতে, শিক্ষার বিষয়কে জীবনের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। শিক্ষার্থী যদি বিষয়বস্তুর সঙ্গে দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার মিল খুঁজে পায়, তাহলে স্বাভাবিকভাবে শিখনে শিক্ষার্থীর আগ্রহ প্রকাশ পায় এবং শিখনের ফল স্থায়ী হয়।

[c] সহজ থেকে কঠিন বিষয়বস্তু নির্বাচন: শিক্ষার্থীর দৈহিক ও মানসিক ক্ষমতা অনুযায়ী বিষয়বস্তু নির্বাচন করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থী বিষয়বস্তু আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়। বিষয়বস্তুকে সহজ থেকে কঠিনের দিকে ক্রমশ বিন্যস্ত করে শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থিত করতে হবে।

[d] আকর্ষণীয় শিক্ষণ পদ্ধতি: শিক্ষণপদ্ধতি শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় ও প্রীতিকর করে তুলতে হবে। প্রয়োজনমতো শিক্ষাসহায়ক উপকরণের ব্যবহার করতে হবে।

[e] ফিডব্যাক প্রদান: শিক্ষার্থী কী পরিমাণে বিষয়বস্তু আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়েছে সে সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করে নিয়মিত ফিডব্যাকের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

  • অনুশীলনের নীতি: এই সূত্রের দুটি অংশ। প্রথম অংশটি ব্যবহারের নীতি। এতে বলা হয়েছে, অন্য সবরকম ব্যবস্থা ঠিক রেখে যদি একটি উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সংশোধনযোগ্য সংযোগ বা বন্ধন তৈরি করা যায় তাহলে প্রতিক্রিয়াটি শক্তিশালী হয়। দ্বিতীয়টি হল অব্যবহারের নীতি। এখানে বলা হয়েছে, উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সংশোধনযোগ্য বন্ধন তৈরি না হলে বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ে। শ্রেণিকক্ষে অনুশীলনের নীতিটির প্রয়োগ উল্লেখ করা হল-

[a] অনুশীলন: শিক্ষক পড়ানোর সময় বিষয়গুলি, বিশেষ করে জটিল ও নতুন অংশগুলি একাধিকবার উপস্থিত করবেন, যার ফলে শিক্ষার্থীরা বারবার অনুশীলনের সুযোগ পাবে। তবে অনুশীলন যাতে যান্ত্রিক না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। বর্তমান শিক্ষাবিদগণ যান্ত্রিক অনুশীলনের পরিবর্তে বিতর্কসভা, শিক্ষামূলক ভ্রমণ ইত্যাদির মাধ্যমে অনুশীলনের সুপারিশ করেন।

[b] পুনরালোচনা: পঠিত বিষয়গুলি উপযুক্ত সময়ের ব্যবধানে শিক্ষক পুনরালোচনা করবেন, যাতে শিক্ষার্থী বিষয়গুলি ভুলে না যায়।

[c] ভ্রান্তি পরিত্যাগ: ভুল এবং অপ্রয়োজনীয় অংশগুলি যাতে প্রথম সুযোগেই বাদ দেওয়া হয় শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সেদিকে লক্ষ রাখবেন।

[iii] প্রভৃতির নীতি: এই নীতিতে বলা হয়েছে, প্রাণী যখন উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সংযোগ তৈরি করার জন্য প্রস্তুত হয়, তখন সংযোগ ঘটলে সে তৃপ্ত হয় এবং না ঘটলে বিরক্ত হয়। অন্যদিকে, যখন সংযোগ তৈরির জন্য প্রস্তুত নয়, তখন সংযোগ ঘটলে সে বিরক্ত হয়।

শিক্ষাক্ষেত্রে প্রস্তুতি নীতির তাৎপর্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শিক্ষক পড়ানোর আগে শিক্ষার্থীদের দৈহিক ও মানসিক প্রস্তুতির ওপর গুরুত্ব দেবেন। শিক্ষার্থীদের চাহিদা ও আগ্রহ নির্ভর করে তার পরিণমনের বা পরিণত- মনস্কতার ওপর। শিক্ষার্থীর দৈহিক ও মানসিক পরিণমন সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরে তিনি শিক্ষাদান করবেন।

  • গৌণ নীতি: শিখন সংক্রান্ত প্রধান নীতিগুলি ছাড়াও থর্নডাইক পাঁচটি গৌণ নীতিরও উল্লেখ করেন। নীচে এগুলি আলোচনা করা হল-

[i] বহুমুখী প্রতিক্রিয়ার নীতি: যতক্ষণ না বারবার চেষ্টা ও ভুলের মধ্য দিয়ে প্রাণী সঠিক প্রতিক্রিয়াটি নির্দিষ্ট করতে পারছে, ততক্ষণ পর্যন্ত একই উদ্দীপকের প্রতি সে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া করে।

[ii] মানসিক অবস্থা ও দৃষ্টিভঙ্গির নীতি: যে-কোনো কাজ করার ক্ষেত্রে ইতিবাচক মানসিক অবস্থা ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন। অর্থাৎ, শিখনের জন্য প্রাণীর অনুভূতি, আগ্রহ ও মনোভাব সদর্থক হওয়া প্রয়োজন।

[iii] আংশিক প্রতিক্রিয়ার নীতি: প্রাণী সামগ্রিকভাবে নয়, আংশিকভাবে প্রতিক্রিয়া করে।

[iv] আত্তীকরণ বা সাদৃশ্যের নীতি: যখন কোনো প্রাণী কোনো নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, তখন আগে ওই ধরনের পরিস্থিতিতে সে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া করেছে তার পুনরাবৃত্তি করে।

[v] অনুষঙ্গমূলক সঞ্চালনের নীতি: মূল উদ্দীপক যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, মূল উদ্দীপকের সঙ্গে যুক্ত গৌণ উদ্দীপকগুলিও সেই একই প্রতিক্রিয়া ঘটায়।

(4) প্রচেষ্টা ও ভুল তত্ত্বের শিক্ষাগত তাৎপর্য: 

থর্নডাইকের প্রচেষ্টা ও ভুল তত্ত্ব শিক্ষাজগতে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করে। শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতার অভাবের কারণগুলি সম্পর্কে নতুনভাবে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। এই তত্ত্বের শিক্ষাগত তাৎপর্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-

  1. শিক্ষকের দায়িত্ব বৃদ্ধি: থর্নডাইকের প্রচেষ্টা ও ভুল মতবাদ শিক্ষাজগতে এক আলোড়ন এনে দেয়। এতদিন শিক্ষায় অকৃতকার্যতার কারণ হিসেবে বৌদ্ধিক ঘাটতিকে দায়ী করা হত। মনে করা হত, এক্ষেত্রে শিক্ষকের বিশেষ কিছু করার নেই। প্রচেষ্টা ও ভুলের মতবাদই প্রথম মন্তব্য করে যে, শিক্ষার্থীর অকৃতকার্যতার জন্য দায়ী শিক্ষকের দক্ষতার অভাব। এর ফলে শিক্ষকের দায়িত্ব আরও বৃদ্ধি পায়।
  2. শিক্ষার্থীর দৈহিক, মানসিক ও প্রাক্ষোভিক প্রস্তুতির উপর গুরুত্ব প্রদান: শিখনের সাফল্য নির্ভর করে পাঠ্য বিষয়বস্তু আয়ত্ত করার জন্য শিক্ষার্থীর দৈহিক, মানসিক এবং প্রাক্ষোভিক প্রস্তুতির ওপর। বিষয়বস্তু নির্বাচনের আগে শিক্ষার্থীর দৈহিক ও মানসিক প্রস্তুতির দিকে নজর দিতে হবে।
  3. পাঠ্য বিষয়কে আনন্দদায়ক করে তোলা: শিখনের ফল যেন শিক্ষার্থীর কাছে প্রীতিদায়ক এবং আনন্দদায়ক হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। শিক্ষার্থীর কাছে পাঠ্য বিষয়কে এমনভাবে উপস্থিত করতে হবে, যাতে সে বিরক্তি বোধ না করে এবং নিজের থেকেই শেখার তাগিদ অনুভব করে। শিক্ষা বাস্তবমুখী হলেই সেটি সম্ভব হয়।
  4. শিক্ষকের আংশিক সহযোগিতা: কোনো সমস্যাসমাধানে শিক্ষক শিক্ষার্থীকে সম্পূর্ণভাবে সাহায্য না করে আংশিকভাবে সাহায্য করবেন, যাতে শিক্ষার্থীর মধ্যে আগ্রহের সঞ্চার হয় ও সমস্যার সমাধানে সে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
  5. বারংবার অনুশীলন: শিখন প্রক্রিয়া অনুশীলনের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। তাই পাঠ্য বিষয় শিক্ষার্থীরা যাতে বারে বারে অনুশীলন করার সুযোগ পায় সেদিকে অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে। অনুশীলন যাতে যান্ত্রিক উপায়ে না হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে।
  6. শিক্ষার্থীর শাস্তি প্রাপ্য নয়: প্রচেষ্টা ও ভুলের তত্ত্বানুযায়ী নতুন শিখনে শিক্ষার্থীর ভুল হওয়াই স্বাভাবিক। কাজেই এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর কোনোরকম শাস্তি পাওয়া উচিত নয়।
  7. পূর্ব-অভিজ্ঞতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সমস্যার উপস্থাপনা: এ ধরনের শিখনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর সামনে এমনভাবে সমস্যা উপস্থিত করতে হবে, যাতে সে পূর্ব-অভিজ্ঞতার সাথে বর্তমান সমস্যার সংযোগ স্থাপন করতে পারে।

(5) প্রচেষ্টা ও ভুল তত্ত্বের ত্রুটি:

থর্নডাইকের প্রচেষ্টা ও ভুল তত্ত্বের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সেগুলি হল-

  1. ভ্রান্ত ধারণা: ফ্রাপ্ত (Franz), ল্যাসলে (Lashley) প্রমুখ শারীরতত্ত্ববিদ দেখেছেন যে, নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনে মস্তিষ্কের সামনের অংশ (Frontal Lobe) দায়ী। তাঁরা ইঁদুরকে নতুন কিছু শিখিয়ে মস্তিষ্কের সামনের অংশ অকেজো করে দেন। ফলে ইঁদুরগুলি নতুন শিখন ভুলে যায়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অল্প কয়েকবার চেষ্টার পর ইঁদুরগুলি শিখতে সক্ষম হয়। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ল্যাসলে বলেন, ফ্রন্টাল লোব অকেজো হওয়ার ফলে মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশ ক্ষতিপূরণে এগিয়ে আসে। অর্থাৎ থর্নডাইকের বক্তব্য অনুযায়ী নির্দিষ্ট উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার বন্ধনই যে শিখন-এ ধারণা সঠিক নয়। উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার বন্ধনে নমনীয়তা দেখা যায়।
  2. যুক্তির ভূমিকা উপেক্ষিত: থর্নডাইকের মতে, শিক্ষার্থীদের শিখনের ক্ষেত্রে যুক্তি, পরিকল্পনা ইত্যাদির কোনো ভূমিকা নেই। কিন্তু মনোবিদ ইয়র্কস্ (Yerks) প্রমাণ করেছেন যে নিম্নতর প্রাণীরাও অনুকূল পরিস্থিতিতে যুক্তি প্রয়োগ করে।

অন্তর্দষ্টির গুরুত্ব উপেক্ষিত: গেস্টাল্টবাদীদের মতে, প্রাণী সবসময় প্রচেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে শেখে না, পরিস্থিতি অনুযায়ী অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমেও প্রাণীর শিখন হয়।

Read More – As You Like It MCQ

Leave a Comment