আগুন নাটকের বিষয়বস্তু

আগুন নাটকের বিষয়বস্তু

আগুন নাটকের বিষয়বস্তু
আগুন নাটকের বিষয়বস্তু

‘আগুন’ নাটকটিতে মো পাঁচটি দৃশ্য লক্ষ করা যায়। এটি একটি একাঙ্ক নাটক। এই নাটকে গ্রাম্য সহজ-সরল ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। এই নাটকে সাধারণ পরিবার থেকে কৃষক পরিবার, কারখানার শ্রমিক পরিবার ও সরকারি কেরানি পরিবারের খাদ্যসংকটের চিত্রকে তুলে ধরা হয়েছে। বলে রাখা ভালো, নাট্যকার মন্বন্তরের কঠিন পরিস্থিতিতে রাস্তাঘাটে যা যা দেখেছেন তা-ই নাটকের উপজীব্য বিষয়বস্তু হিসেবে তুলে ধরেছেন।

এখন আমরা নাটকের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব দৃশ্যানুযায়ী-

প্রথম দৃশ্য: নাটকের প্রথম দৃশ্যে নাট্যকার একটি ভোরবেলার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। একটি সংসারের তিনজন মানুষ- একজন পুরুষ, তার স্ত্রী ও পুত্র সন্তান। নাটকের প্রথম দৃশ্যে ওই পরিবারের পুরুষটিকে পুরুষ বলেই চিহ্নিত করেছেন নাট্যকার এবং তার স্ত্রীকে নেত্য বা নিতাই বা নিতুর মা বলেছেন এবং তাদের পুত্রের নাম নিতাই। অত্যন্ত দরিদ্র একটি পরিবার, খাদ্যাভাবে জর্জরিত মানুষগুলো। তাদের পরিবারের কর্তা ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে স্ত্রী-পুত্রকে তাগাদা দেয় তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠার জন্য।

কারণ, তার স্ত্রী ও পুত্র গ্রাম থেকে পাওয়া কিছু জিনিস যেমন কলমি শাক, নিমকাঠি ও কলা বিক্রি করে যা টাকা পাবে তা দিয়ে চালের দোকানে লাইন দিয়ে চাল কিনবে। আবার, দেরি হয়ে গেলে চাল নাও পেতে পারে। পরিবারের কর্তার কথা থেকে জানা যায়,- “বুঝিছো তো ঠেলাডা মণিচাঁদ কাল দেরিতে যাইয়্যে একদম সেই নাইনির পেছনে।

ওদিকি চাল পাতি সেই পাতি বেলা বারোডা। তাতেও আবার কথা আছে, চাল পাবা কি পাবা না। হয় তো পালেই না। কুড়োনের মা তো দ্যাখলাম কাল শুধু হাতে ফিরে অ্যাল্যো।” অর্থাৎ, চালের লাইনে দাঁড়িয়ে দুটো চাল পাওয়াকে নাট্যকার এখানে মুখ্য বিষয় হিসেবে তুলে ধরেছেন।

দ্বিতীয় দৃশ্য: নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যে নাট্যকার যে সকালবেলার চিত্র অঙ্কন করেছেন তা খানিকটা উজ্জ্বল। এখানে কৃষাণ ও কৃষাণির খানিক কথোপকথন তুলে ধরেছেন। কৃষাণ তার স্ত্রী কৃষাণিকে বলেছেন, চৈতালির ফসলটা মাচায় তুলতে পারলে তাদের কষ্ট অনেকটা লাঘব হবে, অর্থাৎ সংসারে খাদ্যাভাব দূরীভূত হবে। এই কথা বলতে বলতে কৃষাণের মুখে খানিকটা সংশয়ও লক্ষ করা যায়। এরপর দেখা গেল, পরবর্তীকালে ওই কৃষাণ তার কৃষাণিকে বলছেন-“কেষ্টর মা-র সঙ্গে আগেভাগে গে নাইনির একেবারে সে পেরথমে দাঁড়াবি।” অর্থাৎ, বাড়িতে চালের অভাব; চালের দোকানে যে লাইন পড়বে সেই লাইনে দাঁড়ালে তবেই তার স্ত্রী চাল পাবে। তবে চাল নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেলা দুটো, তারপর এসে আবার রান্না করা। এই সংকটময় দৃশ্যটা দ্বিতীয় দৃশ্যে নাট্যকার তুলে ধরেছেন।

তৃতীয় দৃশ্য। নাটকের তৃতীয় দৃশ্যে দেখা যায়, বস্তিবাসী কারখানার শ্রমিক সতীশ খুব সকালে উঠে তার ঘুমন্ত মেয়ে ফুলকির কাছে খাবার চায়। অবশ্য সে জানে গতকাল তার স্ত্রী আর মেয়ে সারাদিন লাইনে দাঁড়িয়ে চাল না পেয়ে খালি হাতে ফিরেছে। রাতে কাজ থেকে ফিরে সে পাশের বাড়ি থেকে প’ দেড়েক চাল কর্জ নিয়ে তবে রাতে আধপেটা খেয়েছে। বাড়িতে চাল নেই। সুতরাং, খাবার পাওয়া সম্ভব নয়। তবুও কাজে বেরোনোর সময় খাবার না পেয়ে অকারণে সতীশ স্ত্রীর সঙ্গে ঝামেলা শুরু করে। স্ত্রীর উত্তরে বিরক্ত হয়ে সতীশ স্ত্রী ক্ষিরিকে লাথি মেরে কাজে বেরিয়ে পড়ে। খাদ্যের অভাবে এভাবে সতীশের সংসারে অশান্তি ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। সহকর্মী জুড়োনের সঙ্গে সতীশের কথোপকথনে এই খাদ্যসংকটের চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

চতুর্থ দৃশ্য: নাটকের চতুর্থ দৃশ্যে নাট্যকার সাধারণ অফিসকর্মী হরেকৃষ্ণ ও তার স্ত্রী মনোরমার কথোপকথনের মধ্য দিয়ে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের খাদ্যসংকটের চিত্রকে তুলে ধরেছেন। অফিস থেকে অফিস কর্মীদের সস্তায় খাবার দেওয়ার কথা বললেও বাবুদের নামে চাল-ডাল তুলে সেসব কালোবাজারে চড়া দামে বিক্রি করেছে কোম্পানি। ফলে সাধারণ মধ্যবিত্ত অফিস কর্মীদের সাংসারিক জীবন সংকটময় হয়ে উঠেছে।

পঞ্চম দৃশ্য: পঞ্চম দৃশ্য, অর্থাৎ নাটকের শেষ দৃশ্যে নাট্যকার বেশ কয়েকটি চরিত্র অঙ্কন করেছেন। চরিত্রগুলি হল-হরেকৃষ্ণ, ১ম পুরুষ, ২য় পুরুষ, ৩য় পুরুষ, ৪র্থ পুরুষ, মুসলমান, ওড়িয়া, সিভিক গার্ড, যুবক ও দোকানি। পঞ্চম দৃশ্যে নাট্যকার জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে সবাইকে চালের লাইনে দাঁড় করিয়েছেন।

কর্তব্যরত সিভিক গার্ড যখন লাইন থেকে অন্যায়ভাবে লোককে বের করে দিচ্ছে তখন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যান্য লোক গর্জে ওঠে এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষারত সকলের দৃষ্টি চালের দোকানের দিকে। কারণ, জীবনের প্রাথমিক ও প্রথম দাবি হল খাদ্য। খাদ্য ছাড়া জীবন শূন্য, জীবনের কোনো মূল্য থাকে না। তাই তো নাট্যকার ওড়িয়ার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে যে ভাবদর্শন ফুটিয়ে তুলেছেন তা হল- “যে হিন্দু অছি সেও চাল খাইব, আর যে মুসলমান অছি সেও চাল খাইব।

সাহেব লোকও খাউচি, গুঁড়া করি পাউরুটি বনায়েরে খাউচি। সব্ব চাউড় খাউচি। এবে সব্ব এক হৈ গিলা। চাউড়ের কথা বড় মস্ত কথা আছে রে দাদা।”-অর্থাৎ, হিন্দু, মুসলমান, সাহেব যেই হোক-না-কেন সবাইকেই চাল খেয়ে বেঁচে থাকতে হবে। হয়তো খাওয়ার ধরন আলাদা হতে পারে কিন্তু খাওয়া সবার চাই। এখানেই তো সবার মিল, সে যে ধর্মই হোক, বিবিধের মাঝে এটাই মিলন।

নাটকের শেষ অংশে নাট্যকার সবাইকে জীবন সংগ্রামে ব্রতী হতে আহ্বান করেছেন। সবার সম্মিলিত, পুঞ্জীভূত শক্তির একত্রকরণের আহ্বান করেছেন। নাটকের পঞ্চম দৃশ্যে ৩য় পুরুষের কণ্ঠে শোনা যায়- “এখন বাঁচতে হবে। বাঁচতে হলে মিলিমিশে থাকতে হবে ব্যাস্।”

আরও পড়ুন- ছুটি গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment