লালন শাহ ফকিরের গান প্রশ্ন ও উত্তর | একাদশ শ্রেণি 2nd Semester WBCHSE

সূচিপত্র

লালন শাহ ফকিরের গান প্রশ্ন ও উত্তর | একাদশ শ্রেণি 2nd Semester WBCHSE

লালন শাহ ফকিরের গান প্রশ্ন ও উত্তর
লালন শাহ ফকিরের গান প্রশ্ন ও উত্তর

‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’- এই রচনাটিতে লালন শাহের কবিপ্রতিভার যে পরিচয় পাওয়া যায়, তার মূল্যায়ন করো।

ভূমিকা: লালন সাঁই ছিলেন বাংলার বহুজনবিদিত বাউল সাধক। তাঁর সাধনার অবলম্বন ছিল তাঁর গান। লালন শাহ্ তাঁর গানে সহজ ভাষার মোড়কে, রূপক-প্রতীকের ব্যবহারে গভীর জীবনবোধে মানবপ্রেমের সুর সঞ্চার করেছেন।

কবিপ্রতিভার মূল্যায়ন: স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ছিলেন লালন শাহের গুণমুগ্ধ ভক্ত। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় তাঁর গান প্রকাশ করে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন বাংলার প্রতিটি প্রান্তে। আমাদের আলোচ্য ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’-এ দেহবাদী সাধক মানুষের মধ্যে ঈশ্বরপ্রাপ্তির সুলুকসন্ধান দিয়ে মানুষ ভজনার কথা বলেছেন বারংবার। আলোচ্য গানে মানুষের দুটি সত্তা। এক মানুষ চর্মচক্ষুতেই ধরা পড়ে, আর-এক মানুষ ‘অধরা মাধুরী’। অথচ অধরা সেই আলেক সাঁইকে মানুষ খুঁজতে থাকে বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানে। চক্রে বিভাজিত মানবদেহের ভূযুগলের মাঝে ষষ্ঠ চক্রে, যাকে সাধক বলছেন ‘দ্বি-দলের মৃণালে’- তাতেই প্রকট হন সেই আরাধ্য জন। মনকে নির্দেশিত পথে সেই আজ্ঞাচক্রে নিয়ে যেতে পারলে জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন ঘটে। মানুষ সাক্ষাৎ পায় ‘সোনার মানুষ’-এর। ‘মানুষ সত্তা’-র স্বরূপ বর্ণনায় কবি যেমন এনেছেন ‘সোনার মানুষ’, মানুষ গুরু-র মতো চিত্রকল্প বা অলংকারের ব্যবহার তেমনই কাব্যগুণসমৃদ্ধ প্রতীকী শব্দবন্ধ ‘দ্বি-দলের মৃণাল,’ ‘আলেক লতা’ ইত্যাদিরও প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। তবে এ গানের মূল যে বিষয়টি, ভাবের ব্যঞ্জনা, যেমন- ‘এই মানুষে মানুষ গাথা’ বা ‘দ্বি-দলের মৃণালে। সোনার মানুষ উজ্জ্বলে’- তা-ই গানটিকে অনন্য মাত্রা দিয়েছে। মানুষ ভজনাই যে মোক্ষলাভের একমাত্র পথ-এই সাধনসত্যের স্বরূপ বর্ণনায় কবির কবিত্বশক্তি আলোচ্য কবিতাটিকে বাংলা সাহিত্যের এক চিরন্তন সম্পদে পরিণত করেছে।

লালনের মানবতত্ত্বের প্রকৃত স্বরূপ কী এবং তিনি মানবসত্তাকে কীভাবে নির্ণয় করতে চেয়েছেন? ‘লালন শাহ ফকিরের গান’ গীতিকায় মানবতাবাদের যে সুরটি লক্ষ করা যায়, তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

অথবা ‘লালন শাহ ফকিরের গান’ গীতিকাটির মধ্যে রচয়িতার যে মনোভাব ফুটে উঠেছে, তা তোমার ভাষায় সংক্ষেপে লেখো।৫

মানবতত্ত্বের স্বরূপ: লালন শাহের মত অনুসারে মানবতত্ত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ হল দেহতত্ত্ব। সহজিয়া বাউলসাধনায় যাবতীয় পার্থিব কামনা-বাসনাকে অবদমিত করে রচিত হয়েছে মুক্তিপথের সাধনা। কিন্তু এই সাধনা দেহকে কেন্দ্র করেই, মানবদেহ ছেড়ে অন্যত্র পরমাত্মার অনুসন্ধান নিরর্থক-সেই পথে পরমাত্মার সান্নিধ্য লাভ করা যায় না।

মানবসত্তার স্বরূপ: ক্ষিতি-অপ্-তেজ-মরুৎ-ব্যোম-এই পঞ্চভূতে জগৎ সৃষ্ট। আবার মানবদেহেও নিহিত আছে পঞ্চভূত। আর স্রষ্টা যিনি, অর্থাৎ পরমাত্মা ঈশ্বরও নিহিত আছেন এই পঞ্চভূতে। তাইতো সব কিছু তাঁর মধ্যে মিশে আছে, তিনিও মিশে আছেন সর্বত্র। লালন সাঁই তাকেই বলেছেন- ‘এই মানুষে মানুষ গাথা’। গীতিকার এভাবেই মানবসত্তার স্বরূপ নির্ণয় করেছেন।

আলোচ্য গানে মানবতার সুর: ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ গীতিকাটি মূলত মানবতাবাদের মুল সুরে ঋদ্ধ। সাধক লালন আজীবন জাতি-ধর্ম-বর্ণ ইত্যাদি ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে মানুষকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর কাছে মনুষ্যত্ববোধে উত্তীর্ণ হওয়ার যে সাধনা তার মূল উপকরণ-মানুষ। তাঁর গভীর বিশ্বাস, মানুষকে উপাসনা করলে যথার্থ মানুষ হওয়া যায়। মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হলে মনুষ্যত্বও ছিন্ন হয়ে যায়। মানুষ-গুরুর ভজনা করলে তাঁর কৃপায় দ্বি-দল পদ্মচক্রে অর্থাৎ আজ্ঞাচক্রে আলোকিত মানুষের আবির্ভাব ঘটে। বৃক্ষের সঙ্গে আলেক লতার অথবা স্বর্ণলতার অঙ্গীভূত থাকার ন্যায় মানুষের মধ্যেও আর-এক আলোকিত মানুষ, অর্থাৎ অন্তরাত্মা উজ্জ্বল হয়ে আছেন। এই আলোকিত অন্তরাত্মাতেই রয়েছে মহাশূন্যতায় তলিয়ে যাওয়া থেকে উত্তরণের দিশা। তাই গীতিকাটির নিবিড় পাঠে মানবতার মূল সুর ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ ধ্বনিত হয়ে ওঠে, যা রচয়িতা মহাত্মা লালনের মনোগত অভিপ্রায়কে তুলে ধরেছে।

লালন ফকির রচিত ‘লালন শাহ ফকিরের গান’ নামক পাঠ্য গীতিটিতে ব্যবহৃত ‘মানুষ ভজলে’ ও ‘মানুষ ছেড়ে’ বাক্যাংশ দুটির অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝিয়ে দাও।

মানুষ ভজলে: লালন শাহ্ রচিত পাঠ্য ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ গীতিকায় এই শব্দবন্ধ দুটির উল্লেখ পাওয়া যায়। বাউলের সাধনা নরনারায়ণের সাধনা। বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানে ও মানুষের শ্রেণি-জাতি- ধর্মভেদে তাঁরা বিশ্বাসী নন। তাঁদের বিশ্বাস পরমাত্মার আবাসস্থল মানবদেহে। লালন বলছেন-

"ওই ব্রহ্মাণ্ডে যা আছে
শুনি ভান্ডেও তা আছে।"

বাউলতত্ত্ব ভাণ্ডে ব্রহ্মাণ্ড তত্ত্ব। বাউল সাধক বিশ্বাস করেন, ‘আত্মানাং বিদ্ধি’। নিজেকে জানলেই পরমকে জানা। তাঁর কাছে মানুষ মাত্রেই ‘মানবরতন’। তাই গুরুমুখী বাউলতত্ত্ব বিশ্বাস করে গুরু নির্দেশিত পথে মানুষকে ভজনা করে পরমাত্মার সান্নিধ্য লাভ করাই মুক্তি। মানব ভজনাতেই নিহিত মানবের মোক্ষলাভের পথ।

মানুষ ছেড়ে: বাউলের বিশ্বাস, দেহ হল দেহতরি। মানবজীবন নদীপ্রবাহ। নদীর এক তীরে ক্ষণস্থায়ী মানবদেহ, অন্য তীরে পরমসত্তা, মনের মানুষ-যিনি অনন্ত, অসীম, অপার। এ দুইয়ের মাঝে লক্ষ যোজন ফাঁক। মানুষ, মানুষ ছেড়ে ভ্রান্ত পথে চালিত হয় পরমাত্মার সান্নিধ্য পাবে বলে। কিন্তু মানুষ ছেড়ে দিলে মনের মানুষের সান্নিধ্য মেলে না। বরং মানুষ তার সত্তাই হারিয়ে ফ্যালে। মানুষ ভজনা ছাড়া মানবজীবনই বৃথা। তাই লালন সাঁই বলছেন ‘মানুষ ছেড়ে ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি।’

“মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’- কে, কাকে এ কথা বলেছেন? উদ্ধৃতিটির মর্মার্থ বুঝিয়ে দাও।

বক্তা: আলোচ্য অংশটি লালন শাহ্ রচিত ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ পাঠ্য গীতিকার অন্তর্গত। উদ্ধৃতাংশের বক্তা মানবপ্রেমিক, মহাত্মা লালন শাহ্।

উদ্দিষ্ট ব্যক্তি: উদ্ধৃতাংশের বক্তা লালন এ কথা যেমন বুঝিয়েছেন নিজেকে, আবার পরবর্তী প্রজন্মের ভক্ত-সাধকদের প্রতিও তিনি এই নির্দেশ রেখেছেন।

মর্মার্থ: ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ গীতিকায় উল্লিখিত পঙ্ক্তিটি বাউল দর্শনের এক মহান সত্যের প্রকাশক। বাউলরা মানুষের শ্রেণি-জাতি-ধর্মভেদে বিশ্বাসী নয়। তারা ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান, কঠোর রীতিনীতি পালনের কথা বলে না। দেহই তাদের দেবতার মন্দির। পরমাত্মাকে তারা মানবদেহেই খুঁজে পায়।

"ওই ব্রহ্মাণ্ডে যা আছে
শুনি ভান্ডেও তা আছে।”

-লালন

বাউলতত্ত্ব তাই ভাণ্ডে ব্রহ্মাণ্ড তত্ত্ব। মানবদেহই পরমাত্মার আবাসস্থল। তিনিই বাউলের মনের মানুষ, অলখ-নিরঞ্জন। তিনি জীবদেহেই বিরাজ করেন। গুরুর দেখানো পথে সাধনা করে তাঁকে পাওয়ার মধ্য দিয়েই মানুষের মুক্তিলাভ। মানুষের তাই উচিত মানুষ ভজনা করা। মনের মানুষের সাধনা ছেড়ে দিলে মানবজীবনই বৃথা।

পাঠ্য গীতিকায় মানুষ ভজার কথা কেন উল্লিখিত হয়েছে? মানুষ ছেড়ে দিলে কী হবে?

অথবা, ‘মানুষ ভজলে কী কী ঘটবে? মানুষ ছাড়লে কী হতে পারে?

মানুষ ভজনায় যা ঘটবে: লালন ফকির রচিত ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ শীর্ষক পাঠ্য গীতিকাটি মানবপ্রেমের বন্দনাগীতি। প্রকৃত ঈশ্বর বিরাজ করেন মানুষের অন্তরে। তাই মানুষকে ভালোবাসার অর্থ ঈশ্বরকে ভালোবাসা। সুতরাং, ‘মানুষ ভজলে’ সোনার মানুষ অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ মানবে পরিণত হওয়া সম্ভব। মানুষের অন্তরে বসবাসকারী ঈশ্বরকে একবার চিনতে পারলে, তাঁর স্পর্শ পেলে তবেই ভক্ত-সাধক ‘সোনার মানুষ’-এ পরিণত হবেন। মানুষের মধ্যে প্রস্ফুটিত দ্বি-দল চক্রে অর্থাৎ আজ্ঞাচক্রে মানবাত্মা ও পরমাত্মার মিলনে সোনার মানুষের স্বর্ণপ্রভা লাভ করা যায়।

মানুষ ছাড়া-র পরিণতি: মানুষের মধ্যেই বিরাজ করেন পরম আরাধ্য মনের মানুষ। অথচ মানুষ আপন ঘরে তাঁর সন্ধান না করে অন্যত্র তাঁকে খুঁজে বেড়ায়। সাধনপথের এই ভ্রান্তিই সমাজে কুসংস্কার, বৈষম্য, ভেদাভেদ, জাতি-ধর্ম-বর্ণের বিচার তৈরি করে। সমাজ কলুষিত হয়। ফলত, মানবতাবোধের অবক্ষয় ঘটে। কিন্তু ঈশ্বরপ্রাপ্তি অধরাই থেকে যায়।

মানুষ ভজনা তথা মানবপ্রেম ব্যতীত সাধকের উত্তরণের অন্য কোনো পথ নেই। লালন ব্যাকুল সাধককে সতর্ক করেছেন, মানুষের সান্নিধ্য ত্যাগ করলে আপন সত্তা তথা মনুষ্যত্ব হারাবে বাউল। মনের মানুষ ঈশ্বর নিহিত আছেন মানুষেরই মধ্যে, তাই তাঁকে নিজের মধ্যে না খুঁজে অন্যত্র খুঁজতে যাওয়া বৃথা। মানুষ-গুরুর কৃপাদৃষ্টিতেই সিদ্ধিলাভ সম্ভব। মানুষকে অবহেলা করলে বাউল সাধকের সকল সাধনাই শূন্য, নিষ্ফল।

“মানুষ ছেড়ে ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি।।”-কাকে, কেন ‘ক্ষ্যাপা’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে? ‘মূল’ কী এবং তা কীভাবে হারিয়ে যেতে পারে?

লালন ফকির রচিত পাঠ্য ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ আলোচ্য গীতিকায় এই উদ্ধৃতিটির উল্লেখ আমরা পাই।

‘ক্ষ্যাপা যে: ‘বাউল’ শব্দের উৎস বাতুল শব্দ, যার অর্থ উন্মাদ বা ভাবে উন্মত্ত ব্যক্তি। বাউল সাধকগণ দিব্যোন্মাদ অবস্থায় বা ভাবে ব্যাকুল হয়ে ‘মনের মানুষ’-এর সন্ধান করেন। আত্মতত্ত্বের গভীর অর্থকে জানতে মন রূপসাগরে ডুব দিতে এমন উন্মত্ত ভাব ধারণ করে-লালন সেই মনকেই ‘ক্ষ্যাপা’ বলেছেন।

‘ক্ষ্যাপা বলার কারণ: ‘ক্ষ্যাপা’ শব্দের প্রতিশব্দ হল ক্ষিপ্ত, জ্ঞানশূন্য, পাগল ইত্যাদি। আবার, ‘বাউল’ শব্দটি এসেছে ‘বাতুল’ থেকে; যার অর্থ পাগল বা খ্যাপা। তবে মনে রাখতে হবে, বাউল সাধকদের মন সর্বদা পাগল থাকে মনের মানুষের জন্য। এই মনের মানুষের অনুসন্ধান এবং তাঁকে উপলব্ধি করাই হচ্ছে বাউলসাধনার মূলভিত্তি। কিন্তু এই সাধনার পথ মোটেই সহজ নয়। গুরুর কৃপাধন্য হয়েই অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে দেহতাত্ত্বিক সাধনার মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের ঈপ্সিত মনের মানুষকে উপলব্ধির সীমায় বাঁধতে পারেন। যেহেতু মনের মানুষের অনুসন্ধানের জন্য বাউল সাধকদের মন সবসময় পাগলপারা থাকে, তাই তাদের মনকে ‘ক্ষ্যাপা’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে।

মূল-এর অর্থ: ‘মূল’ বলতে এখানে ভিত্তি, মানুষের মূলসত্তা, সেটা যে আসলে মনুষ্যত্ব সেই কথাই বলা হয়েছে। মানুষরূপে জন্ম নিলেই মানুষ হওয়া যায় না। মানুষের অন্তরাত্মাকে জাগ্রত করে মনের মানুষের সন্ধান করতে হয়। মনের মানুষ মানবদেহের মাঝেই বিরাজ করেন। তাই মানবপ্রেমের জাগরণে, মানবতাবোধের বিকাশেই প্রকৃত ‘মানুষ’ হয়ে ওঠা। মানুষের প্রতি অবহেলা সেই মূল তথা মনুষ্য পরিচয় থেকে ছিন্ন হওয়া।

যেভাবে হারাতে পারে: বাউলের ঈশ্বরসাধনা দেহবাদী সাধনা। তাই লালন সাঁই বারে বারে বলেছেন মানুষ ভজনার কথা। ভক্তিতে উন্মত্ত যে জন আপন ঘরে অর্থাৎ নিজের মধ্যে বা মানুষের মধ্যে পরমাত্মা পরমপুরুষের সন্ধান না করে বহির্জগতে তাঁকে খুঁজে ফেরেন, তার কাছে ঈশ্বর অধরাই থেকে যান। উপরন্তু, মানুষ ভজনা না করলে মানুষ তার মূলসত্তা বা মনুষ্য পরিচয় হারিয়ে মনুষ্যেতর হয়ে পড়ে; যা কাম্য নয়।

দ্বি-দলের মৃণাল কী এবং ‘দ্বি-দলের মৃণাল কোথায় অবস্থিত? “দ্বি-দলের মৃণালে সোনার-মানুষ উজ্জ্বলে”-উদ্ধৃতিটির তাৎপর্য লেখো।

দ্বি দলের মৃণাল-এর অর্থ: ভক্তকবি লালনের রচনাসংকলন ‘লালন- গীতিকা’-র ৩৯১ সংখ্যক পদটি বাউল দর্শনের পরমতত্ত্ব পর্বের পদ। ‘দ্বি- দল মৃণাল’ শব্দবন্ধটি বাউলসাধনায় এক গভীর তাৎপর্য বহন করে নিয়ে আসে। নাকের উপরে দুটি ভূ-র সংযোগস্থলই দ্বি-দল মৃণাল বা ত্রিবেণী।

অবস্থান: বাউলসাধনা দেহবাদী সাধনা। মানবদেহে রয়েছে সাতটি চক্র। সাধক নিম্নচক্র থেকে সাধনার সাহায্যে মনকে ঊর্ধ্বচক্রে নিয়ে যান। মানবদেহের উপরিভাগে দুই ভূ-র মাঝে অর্থাৎ নাকের ঊর্ধ্বে রয়েছে আজ্ঞাচক্র। সাধকের কল্পনায় পদ্মের ন্যায় বিরাজিত এই আজ্ঞাচক্রের দুই দল-তাই ‘দ্বি-দল মৃণাল’।

তাৎপর্য: বাউলের পরমাত্মা ‘ভক্তের ভগবান’ নন, তিনি বাউলের চেতনায় আধ্যাত্মিক সত্তা। এই পরমাত্মা লীলাময়, হৃদয়বিহারী। জাগতিক ধর্মাচরণ পদ্ধতিতে নয়, একান্ত সুকঠিন সাধনায় তাঁকে পাওয়া যায়। নদী যেমন সমুদ্রে লীন হয় আত্মাও তেমনই মিশে যায় পরমাত্মায়। জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলনেই মুক্তিলাভ সম্ভব হয়।

বাউলতত্ত্বে ষচক্রের উল্লেখ করা হয়েছে। বাউল সাধক বলেছেন, এই মানবদেহ ছয়টি চক্রে বিভাজিত। সেই ছয় চক্রের অন্যতম হল আজ্ঞাচক্র। পদ্মরূপে কল্পিত এই চক্রসমূহের অন্তর্গত আজ্ঞাচক্র দুটিই দলে বিভক্ত। এই আজ্ঞাচক্রেই লীলাময়ের লীলার প্রকাশ। সাধনার মাধ্যমে ভক্তমন সেই চক্রে উপনীত হলেই মানুষ ঈশ্বর সান্নিধ্যের পরমসুখ উপলব্ধি করতে পারে।

“মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি” এবং “দ্বি-দলের মৃণালে সোনার মানুষ উজ্জ্বলে”-এই দুই পঙ্ক্তিতে ‘সোনার মানুষ’ শব্দবন্ধটি কোন্ কোন্ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে?

প্রথম অর্থে: লালন শাহ্ রচিত ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ পাঠ্যাংশে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ‘সোনার মানুষ’ শব্দবন্ধটি ব্যবহৃত হয়েছে। “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি”- এই পঙ্ক্তির ‘সোনার মানুষ’ হল মনুষ্যত্ববোধে উন্নীত আলোকিত মানুষ, খাঁটি মানুষ।

‘যত্র জীব, তত্র শিব’। জীবের মধ্যেই ঈশ্বরের বাস। বাউল ধর্মের বীজমন্ত্রই হল মানুষকে খুঁজে বের করা। মানুষকে খুঁজে পেলেই সিদ্ধিসাধন পূর্ণতা পাবে এবং সাধারণ জন হয়ে উঠবে মানবশ্রেষ্ঠ তথা সোনার মানুষ। পরশমণির স্পর্শে লোহা যেমন সোনায় পরিণত হয়, কঠোর সাধনা দ্বারা পরমাত্মার সান্নিধ্যলাভে সাধারণ মানুষও সোনার মানুষে, খাঁটি মানুষে তথা মানবশ্রেষ্ঠে পরিণত হতে পারে।

দ্বিতীয় অর্থে: অপরদিকে, “দ্বি-দলের মৃণালে সোনার মানুষ উজ্জ্বলে” -এই পঙ্ক্তির ‘সোনার মানুষ’-এর অর্থ, মনুষ্যত্ববোধের দীক্ষাদাতা, অধরা মাধুরী মনের মানুষ অর্থাৎ অন্তরাত্মা, পরমপুরুষ ঈশ্বর। বাউলের ঈশ্বর টা বাউলের জীবনদেবতা। তিনি মন্দির, মসজিদ, গির্জার মতো উপাসনালয়ে যে অধিষ্ঠিত নন। তিনি থাকেন জীবদেহের অন্তরে। সাধনা ছাড়া তাঁকে লাভ করা যায় না। মানবদেহের ছয় চক্রের অন্যতম আজ্ঞাচক্রে জীবাত্মা স্পর্শ পায় পরমাত্মার। পরমাত্মাই সোনার মানুষ।

“মানুষ-গুরু কৃপা হ’লে / জানতে পাবি।”- ‘মানুষ-গুরু’ কে এবং বাউলসাধনায় তাঁর গুরুত্ব কোথায়? মানুষ-গুরুর কৃপায় কী জানা যাবে?

মানুষ-গুৰু যিনি: লালন ফকির রচিত ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ পাঠ্যটিতে উল্লিখিত ‘মানুষ-গুরু’ হলেন বাউলমতে, গুরু বা সাঁই অর্থাৎ যিনি সিদ্ধপুরুষ।

মানুষ-গুরু’র গুরুত্ব: সাধনা ও তথাকথিত ধর্ম শব্দটি একার্থক নয়।

সনাতন ধর্ম হিন্দু-ইসলাম-খ্রিস্টান। কিন্তু সাধনা হল সুফি-সহজিয়া-বাউল- ফকির-তন্ত্রসাধনা ইত্যাদি। সাধকরা পরমাত্মার সন্ধানী। কিন্তু তাঁরা মনে করেন, ঈশ্বরের চেয়ে মানুষই বড়ো। মনে করেন, মানবদেহেই পরমাত্মার বাস। কিন্তু পরমাত্মার অনুভব সাধারণের সাধ্যে নেই। এইজন্যই অন্যান্য সাধক সম্প্রদায়ের মতোই বাউল দর্শনেও প্রাধান্য পেয়েছে গুরুবাদ। এই গুরু মানুষ-গুরু, সিদ্ধপুরুষ, গুরুর নির্দেশমতো সাধন-ভজনই মনের মানুষকে পাওয়ার একমাত্র পথ। গুরুর কাছে আত্মসমর্পণ করলে গুরুই মুক্তির পথ দেখান। লালন তাই অন্য এক গানে বলেছেন-

“ভবে মানুষ-গুরু নিষ্ঠা যার সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার।”

যা জানা যাবে: বাউল মতাদর্শ গুরুবাদী। গুরুর কাছে দীক্ষাগ্রহণ ও গুরুর নির্দেশমতো পথে না চললে, সাধন-ভজন না করলে বাউল হওয়া যায় না। গুরুই মুক্তিদাতা। তাঁর নির্দেশিত পথেই বদ্ধজীব মানুষ মুক্তজীবে রূপান্তরিত হয়। গুরু সিদ্ধপুরুষ। তিনি ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করেছেন। তাই তিনিই পারেন ব্যাকুল ভক্তকে সঠিক পথে চালনা করে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করাতে।

লালন নিজেও তাঁর গুরু সিরাজ সাঁইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন বারবার। গুরুর চরণই বাউলের একমাত্র আশ্রয়। ‘মানুষ-গুরু’-র কৃপায় আত্মা মিলিত হয় পরমাত্মার সঙ্গে। গুরুই তার যোগসূত্র। তাই গুরুবাদী বাউলসাধনা গুরুকৃপা প্রার্থনা করে।

“এই মানুষে মানুষ গাথা – মন্তব্যটি বাউল দর্শনের কোন্ ইঙ্গিত বহন করে আনে, বুঝিয়ে দাও।

মন্তব্যটির দার্শনিক ইঙ্গিত: লালন শাহ্-এর গীতিসংকলন ‘লালন- গীতিকা’-র ৩৯১ সংখ্যক রচনা আমাদের পাঠ্য ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ থেকে আলোচ্য উদ্ধৃতিটি গৃহীত হয়েছে।

"পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
মূর্তি ভাবে 'আমি দেব'-হাসে অন্তর্যামী।”

অর্থাৎ, মানুষ ভাবে বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের আড়ম্বরের মধ্যেই ঈশ্বর নিহিত। কিন্তু বাউল সাধক আড়ম্বরে নয়, অনাড়ম্বর সাধনায় বিশ্বাসী। তাঁদের সাধনা মানবসাধনা। তাঁদের আরাধ্য পরমাত্মা, জীবাত্মাতেই বাস করে। তাই ‘আত্মানাং বিদ্ধি’ অর্থাৎ তাঁদের ঈশ্বর অনুসন্ধান, আত্মানুসন্ধানের নামান্তর। সাধক বলেছেন-

"সেই আপনা খবর জানলে পরে রে
ওরে যাবে অচেনারে চেনা।"

এই অচেনাই আরশিনগরের পড়শি- মনের মানুষ। আসলে বাউল দর্শনে মানুষের দুটি রূপ। এক মানুষ রক্তমাংসের জীবাত্মা- অপরজন নিরাকার পরমাত্মা। এই পরমাত্মার স্থান দেবালয়ে নয়, জীবাত্মার মাঝেই এই সোনার মানুষের অধিষ্ঠান। বাউলের সাধনা তাঁকেই খুঁজে নেওয়ার সাধনা। এই সাধনসত্য বোঝাতেই ‘মানুষে মানুষ গাথা’ মন্তব্যটির অবতারণা। বাউল দর্শনে মানুষের দুটি রূপ। প্রথম বার ‘মানুষ’ বলতে লালন সাঁই বোঝাতে চেয়েছেন রক্তমাংসের মানুষকে। সে বদ্ধজীব। অন্যজন মনের মানুষ বা পরমাত্মা ঈশ্বর। বাউলের বিশ্বাস তাঁর বাস রক্তমাংসের শরীরেই। অর্থাৎ এক দেহেই সাধ্য-সাধকের অবস্থান। বাউল সাধক এবং ‘মনের মানুষ’ একই খাঁচার অচিন পাখি। তাই মানবসেবাই ঈশ্বরসেবা। এই সাধনসত্যই প্রকাশ পেয়েছে আলোচ্য পঙ্ক্তিতে।

“দেখ না যেমন আলেক লতা- ‘আলেক লতা’ শব্দবন্ধটির রূপকার্থ বুঝিয়ে দাও। কবি তাঁর সান্নিধ্য চেয়েছেন কেন?

আলেক লতা-র অর্থ: উদ্ধৃত শব্দবন্ধটি লালন শাহ্ রচিত ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ পাঠ্য থেকে গৃহীত। ‘আলেক লতা’ আক্ষরিক অর্থে পরজীবী উদ্ভিদকে বোঝায়, যা বিশালাকার বৃক্ষদেহকে জড়িয়ে জীবনধারণ করে। অন্তর্নিহিত অর্থে, ‘আলেক লতা’ হল অলখ-নিরঞ্জন, নিরাকার পরমাত্মা- যাঁর স্বরূপ অলৌকিক, অপার্থিব। যিনি জীবাত্মার মাঝে অধিষ্ঠান করেন। মানবদেহকে জড়িয়েই যাঁর প্রাণপ্রতিষ্ঠা। বাউল দর্শনে ‘পরমাত্মা’- কে মনের মানুষ, সোনার মানুষ, আলেক সাঁই, অলখ-নিরঞ্জন, অচিন পাখি ইত্যাদি নামে ডাকা হয়।

সান্নিধ্যলাভের আকাঙ্ক্ষা: সত্যসন্ধানী, মরমি কবি, বাউল সাধক লালন সাঁইয়ের আজীবনের স্বপ্ন ছিল, মানুষের পৃথিবী হবে মানবধর্মের চারণক্ষেত্র। • তাই মানুষের মধ্যে তিনি সন্ধান করেছেন অরূপরতন। ‘আত্মানাং বিদ্ধি’- আপন ঘরের আয়নাতেই মুখ দেখা যায় আরশিনগরের পড়শির। তাই • সাধক বলছেন- ‘মানুষে মানুষ গাথা।’ এখানে এক মানুষ বদ্ধজীব। অন্যজন পরমাত্মা। রক্তমাংসের মানুষই নিজের অন্তরে ধারণ করেছেন মনের মানুষকে। আলেক লতা বা স্বর্ণলতা যেমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে মহিরুহকে, জীবাত্মা-পরমাত্মাও তেমনই একই দেহে অভিন্ন হয়ে জড়িয়ে থাকে। মানুষ ভজনাতেই আলেখ পুরুষ বা অলক্ষের সেই নিরাকার মনের • মানুষ সাকাররূপে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। আর তাঁর সাক্ষাৎ পেলেই মানুষের মুক্তিলাভ হয়। মানুষ হয়ে ওঠে খাঁটি মানুষ বা সোনার মানুষ। এই কারণেই লালন সাঁই আলেক লতার সান্নিধ্যলাভে ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন।

“জেনে শুনে মুড়াও মাথা”-উদ্ধৃতিটিতে যেন আক্ষেপের সুর ধ্বনিত হয়েছে-এর কারণ কী?

আক্ষেপের কারণ: সাধক লালন ফকির রচিত “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি” গীতিকাটিতে গীতিকার আক্ষেপ করে, নতুন প্রজন্মের বাউলদের প্রতি এই সাবধানবাণী শুনিয়েছেন।

আসলে বাংলা তথা ভারতীয় সমাজে মাথা মুড়ানো বিষয়টি ত্যাগের প্রতীক হিসেবে প্রতিভাত কিন্তু মাথা মুড়ানো জাতিগত উত্তরণের একমাত্র পথ নয়। অথচ বেশিরভাগ মানুষই মাথা মুণ্ডিত করে অর্থাৎ মাথা ন্যাড়া করে ঈশ্বরসাধনার জন্য বৈরাগী হয়।

লালন ফকির নির্দেশিত সাধনমার্গে কোনো সাধক যদি সিদ্ধিলাভ করতে চান তবে তাঁকে জেনে রাখতে হবে যে, এ পথ মোটেই সহজ নয়। মানুষ তথা জীবাত্মার অন্তরে গুপ্ত ও সুপ্ত পরমাত্মাকে চিনতে পারা কঠিন কাজ, মানুষ স্বভাবত ধূর্ত ও কৌশলী। সেইসব মানুষই ধর্মাচারের নামে অন্যের প্রতি অত্যাচার ও অন্যায় করেন, যারা নিজের ও অপরের অন্তরে বসবাসকারী ঈশ্বরের সন্ধান জানেন না। আসলে অনেক সাধকই ভাবেন বাহ্যিক আচার, রীতিনীতি পালন ও মাথা মুণ্ডনেই বোধহয় মহিমান্বিত আধ্যাত্মিক সত্তায় রূপান্তরিত হওয়া যায়। কিন্তু অন্তঃসারশূন্য সংস্কারকে গ্রহণ করাটাই জেনে-শুনে মাথা মুড়ানো। সেইসব অন্যায়কারী মানুষকে ভালোবেসে কাছে টেনে অন্তরের ঐশ্বরিক সত্তাকে জাগ্রত করার কাজটি খুব সহজ নয়। এই কারণে লালন তাঁর পরের প্রজন্মের বাউলদের প্রতি এই সাবধানবাণী উল্লেখ করেছেন।

‘জাতে তরবি।’-এখানে ‘জাত’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে? কীভাবে সেই জাতে উত্তরণ ঘটে?

জাত-এর অর্থ: লালন ফকির রচিত আলোচ্য ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ গীতিকা থেকে ‘জাতে তরবি’ শব্দবন্ধটি নেওয়া হয়েছে। সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসে মানবজাতিকে জাতের পরিচয় বলে এক বিশেষ অভিধা দেওয়া হয়ে থাকে, যেখানে মনুষ্যত্বকে অমর্যাদা করা হয়। কিন্তু লালন আজীবন ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও সম্প্রদায়হীন মনুষ্যজাতির স্বপ্ন দেখেছেন। তাঁর গানের ব্যাখ্যানুসারে, ‘জাত’ বলতে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মনুষ্যত্বের কথা বলা হয়েছে।

জাতে উত্তরণের উপায়: মানুষের মধ্যে নিহিত আছে চৈতন্যশক্তি ও আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। নিজের ভিতরের চৈতন্যশক্তিকে বিকশিত করে জৈব ধর্ম ও জৈবচক্রের ঊর্ধ্বে নিজেকে স্থাপন করাই মনুষ্যত্ব। সব মানুষের ভিতরেই রয়েছেন ‘সোনার মানুষ’, অথচ মানুষ তাঁকে উপলব্ধি করতে পারে না। হিংসা, সংকীর্ণ স্বার্থপরতা, কামনা-বাসনার প্রাবল্যে চিৎ (চিত্ত, জ্ঞান, চৈতন্য) এবং আনন্দের স্বরূপ আমাদের বোঝার অতীতই থেকে যায়। দেহের ভিতরেই আত্মার বসতি-তাকে জানতে হবে। মনের মানুষ আত্মারূপে কিংবা অচিন পাখিরূপে দেহ-খাঁচায় অবস্থান করছেন। তাঁকে দেখতে পেলে বা জানতে পারলেই মহিমান্বিত আধ্যাত্মিক স্তরে উত্তরণ ঘটে।

“মানুষ ছাড়া মন আমার পড়বি বে তুই শূন্যকার লালন বলে, মানুষ-আকার ভজলে তরবি।।” – উদ্ধৃতিটিতে শূন্যতার অর্থ কী? উদ্ধৃতিটির মূলভাব বিশ্লেষণ করো।

শূন্যতা-র অর্থ: লালন সাঁই রচিত ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ পাঠ্যাংশে সাধক বলেছেন, মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর বিরাজ করেন। তাই মানুষের সঙ্গ ছাড়লে, মানুষ ঈশ্বরের সঙ্গচ্যুত হয়। ফলে, অদ্ভুত একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয় মনে। পরমাত্মার সান্নিধ্যচ্যুত মহাশূন্যতার কথাই আলোচ্য উদ্ধৃতিতে প্রকাশ পেয়েছে। মনকে বিশেষ অর্থে বাঁধলে মুনি হয়। কবি মনকে বেঁধেছিলেন মানবপ্রেমের সূত্রে। কবি নিজেকে খণ্ড করে নিজের অন্তরাত্মাকেই ‘তুই’ বলে সম্বোধন করে বলেছেন, অন্তরাত্মা যদি মানুষ ভোলে অর্থাৎ মানুষকে উপেক্ষা করে, তাহলে ঈশ্বরের অন্বেষণ ব্যর্থ হয়। মানুষ তার মনুষ্যত্ব হারিয়ে কেবল নিষ্ফল হাহাকার করে বেড়ায়।

মূলভাব: মানুষের দুটি সত্তা-একটি বাইরের, অন্যটি ভিতরের। বাইরের মানুষটিকে চোখে দেখা গেলেও ভিতরের মানুষটিকে চর্মচক্ষুতে দেখা যায় না। ভিতরের মানুষ বাস করে মানুষেরই ভিতরে। মানুষ যদি মানুষকে উপেক্ষা করে, মনের মানুষের সন্ধানে বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানে মত্ত হয়, তাহলে সেই সাধনায় ঈশ্বরের সান্নিধ্য মেলে না। মন অদ্ভুত এক শূন্যতায় ভরে ওঠে। এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে মানবপ্রেম, মানুষের প্রতি ভালোবাসা। মানুষকে ভালোবাসলেই মানসচক্ষুতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সোনার মানুষের এক আলোকিত আকার। তাঁর সান্নিধ্যে সাধারণ জীবাত্মা হয়ে ওঠে ‘সোনার মানুষ’। উদ্ধৃতাংশে এই সাধনসত্যই প্রকাশ পেয়েছে।

‘লালন বলে…’- আলোচ্য গীতিকাটিতে ‘লালন বলে’ অংশটির তাৎপর্য কী? লালন কী বলেছেন?

লালন বলে অংশটির তাৎপর্য: লালন ফকির রচিত ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ পাঠ্য কবিতায় আলোচ্য শব্দবন্ধটি আমরা পাই। মূলত মধ্যযুগীয় পদ, গীতি ইত্যাদিতে কবির নাম কবিতা বা পদের শুরুতে লেখা হত না। কবিতার শেষ পঙ্ক্তিতে কবি তাঁর নিজের নাম বিনয়ের সঙ্গে ঘোষণা করতেন। এই আত্মপরিচয় অংশটিকে বলা হয় ভণিতা। পাঠ্য ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ গীতিকার শেষ চরণে লালন সাঁই তাঁর আত্মপরিচয় দিয়েছেন-“লালন বলে, মানুষ-আকার ভজলে তরবি।।”

যা বলেছেন: লালন সাঁই রচিত ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ পাঠ্যাংশে সাঁই বলেছেন, মানবদেহেই পরমাত্মা বা মনের মানুষের বাস। সুতরাং, মানুষ ভজনাতেই ঈশ্বরসাধনার ফল মেলে। তাই সাধক ‘মানুষ-আকার ভজা’-র কথা বলেছেন।

বাউলসাধনা ‘ভাণ্ডে ব্রহ্মাণ্ড’ তত্ত্বে বিশ্বাসী। সাধনায়, দেহসাধনা করে বাউল সাধক। ‘মানুষ-আকার’ অর্থাৎ মানবদেহ, সে দেহেই মনের মানুষের বা সোনার মানুষের বা অচিন পাখির অধিবাস। দেহসাধনের চূড়ান্ত পর্যায়ে তাঁকে অনুভব করা যায়। রক্তমাংসের মানুষ ষড়রিপুর বন্ধনে আবদ্ধ। এই বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে সাধনাই একমাত্র পথ। সেই পথে পথ দেখান মানুষ-গুরু। এই পথেই জীবাত্মা মিলিত হয় পরমাত্মার সঙ্গে। পরমাত্মা জগদ্ব্যাপী। তিনি-

"ক্ষণেক থাকে শূন্যের ওপর
সে ক্ষণেক ভাসে নীরে।"

নিরাকার তিনি। ব্যাকুল ভক্ত সেই নিরাকারের সাধনায়, সেই অলখ- নিরঞ্জনের আরাধনাতেই পরমাত্মার সান্নিধ্যলাভের মধ্য দিয়ে মুক্তি লাভ করে।

বাউল কাদের বলা হয়? লালন ফকিরের বাউল সাধনদর্শন সম্বন্ধে যা জানো লেখো।

বাউলের পরিচয়: লালন সাঁই রচিত পাঠ্য ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ গীতিকায় ‘বাউল’ শব্দটির উল্লেখ আমরা পাই। ‘বাতুল’ শব্দটি সংস্কৃত, তার থেকে বাংলা শব্দভাণ্ডারে বাউল কথাটি আসে। বাউলেরা ধর্মীয় সংস্কারমুক্ত আধ্যাত্মিক গায়ক। এরা প্রচলিত হিন্দু-মুসলমানের আচার অনুসারে চলে না। এরা বাংলার পথে পথে ঘোরে ও গান গায়। এরা নিজের ভিতরে ক্ষিপ্ত, ব্যাকুল। সাধারণের দৃষ্টিতে এরা পাগল। বাংলার মাটির সংস্কৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছে এই বাউল সাধকগণ। এরা ক্রমান্বয়ী জ্ঞানের বিষয়বস্তুকে দেশ-গাঁয়ের হৃদয়ে হৃদয়ে পৌঁছে দিয়েছে। গ্রামগঞ্জে নবজাগরণ এসেছে তাদের গানের কলিতে। এটাই বাউলের লোক ঐতিহ্য।

লালনের সাধনদর্শন: মানবদেহে মোট ৭০০০ নাড়ি রয়েছে যার মধ্যে প্রধান হল ১৪টি এবং আরও সংক্ষিপ্ত ক্ষেত্রে ৩টি- ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না। সুষুম্নাকে বলা হয় জ্ঞানের নাড়ি বা ব্রহ্মদ্বার। এর শেষভাগে কুলকুন্ডলিনী অবস্থিত। মেরুদণ্ডের শেষ অংশ হল মূলাধার। ভূযুগলের ঠিক মধ্যখানে দ্বি-দল পদ্মের অবস্থান। সাধকের লক্ষ্য হল, কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত করা। অধ্যাত্মতত্ত্বের পঞ্চভূত অর্থাৎ ক্ষিতি-অপ্-তেজ-মরুৎ-ব্যোম দিয়ে গঠিত মানবদেহ ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। দেহের গুহ্যমূল অর্থাৎ মূলাধারচক্রে ক্ষিতি, লিঙ্গমূল অর্থাৎ স্বাধিষ্ঠানচক্রে অপ্, নাভিমূল অর্থাৎ মণিপুরচক্রে তেজ, হৃদয় অর্থাৎ অনাহতচক্রে মরুৎ এবং কণ্ঠ অর্থাৎ বিশুদ্ধচক্রে ব্যোম অবস্থান করে। লালন শাহ্ তাঁর গানে কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত করে সপ্তচক্র ভেদের কথা বলেছেন বারবার। এই কাজ অত্যন্ত কঠিন। কঠোর সাধনার দ্বারাই এ কাজ করা সম্ভব। কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হলে তবেই দেহের অভ্যন্তরে বসবাসকারী ঈশ্বরসত্তার নাগাল পাওয়া সম্ভব।

লালন শাহ ফকিরের গান – গীতিকায় বারংবার ‘মানুষ’ শব্দের ব্যবহারের তাৎপর্য বুঝিয়ে দাও।

ভূমিকা: মানবপ্রেমের আর-এক নাম লালন ফকির। তাঁর দীর্ঘ জীবনসাধনায় মানুষের জায়গাটা বড়ো করেই আঁকা। তিনি একাধারে কবি, সাধক, সর্বোপরি তিনি একজন উদার হৃদয়ের মানুষ। তাই তাঁর কবিতায় মানুষের মহিমা ঘোষিত তো হবেই। আলোচ্য কবিতাটি তারই একটি অসামান্য নিদর্শন।

মানুষ প্রসঙ্গে গুরুত্ব: ‘মানুষ’ এই শব্দটিই এই কবিতার অন্তর ও অলংকার। কবি তাঁর শব্দব্রহ্মেই কবিতাকায়া নির্মাণ করেন। এ যেন মহাশিল্পীর শব্দসজ্জিত চিত্রপট। পাঠক তাঁর বোধ এবং বোধির অভ্যন্তরে কবিসৃষ্ট শব্দব্যঞ্জনাতেই কবিতার সারসত্য বুঝতে পারেন, অনুভব করেন। কবিতাটির চারটি স্তবকে ‘মানুষ’ প্রসঙ্গ এসেছে মোট নয় বার এবং প্রত্যেকটি স্তবকেই ‘মানুষ’ পদটির সুচারু উপস্থিতি। কবিহৃদয়ের দ্যুতি, যার দীপ্তি আধুনিক কালের মনস্বী পাঠককে ভাবিয়ে তোলে-

"মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি। 
মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি।।"

‘মানুষ’, শুধু ‘মানুষ’। ঘুরে ঘুরে এই শব্দটাই পাঠকের অন্তরে রণিত হয়। মানুষই শেষ কথা। জাত-ধর্মের বেড়াজাল ভেঙে ধ্বনিত হোক মুক্তির বাণী। মানুষের দরবারে মানুষ হয়ে আসা হয়েছে; মানুষ হয়েই যাওয়া হবে। তবে কৃত্রিম জাত-ধর্মের আস্ফালন কেন? এই মানুষেই মানুষ গাঁথা হয়ে আছে-চোখ মেললেই তা অনুভব করা যায়। তাই মিথ্যে ছলনার মায়াপাশে নিজেকে বন্দি করা অর্থহীন। মানবপ্রেমের মধ্যেই তো শ্রেয়কে পাওয়া যায়। নইলে-

"মানুষ ছাড়া মন আমার
পড়বি রে তুই শূন্যকার।"

শেষকথা: শুধু শব্দসুষমা কিংবা অলংকারের মহিমা নয়; ‘মানুষ’ শব্দের ব্যবহারে কবির মানবপ্রেমের রূপকেও অনুভব করা যায়। এভাবেই উক্ত শব্দটির বারংবার ব্যবহারে কবিতাটির রসধ্বনি সার্থকতা লাভ করেছে।

মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।”- কবিতাটি একটি মানুষতত্ত্বের কবিতা, বিচার করো।

মানুষতত্ত্ব: আলোচ্য অংশটি লালন ফকির রচিত ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ গীতিকার অন্তর্গত। লালনের কাছে জ্ঞান ও সত্য অলৌকিক বা ঐশ্বরিক নয়। জ্ঞানের উৎস মানব-গুরু। মানুষের কাছ থেকেই মানুষ যথার্থ জ্ঞান লাভ করে। এই কারণেই লালনের মানবতাবাদ কাল্পনিক ঈশ্বর, পরলোককে অস্বীকার করেছে। তিনি মানুষকে মর্যাদা দিয়েছেন। মানবদেহকে নিত্য ভেবে বস্তুর অমৃতসন্ধানী তিনি। জন্মসূত্রে মানুষ জৈব স্বভাবসম্পন্ন। ষড়রিপুকে সংস্কার করে অর্জন করতে হয় মনুষ্যত্ব।

অতীতে উপলব্ধি: প্রাচীন ভারতবর্ষে উপনিষদেই বলা হয়েছিল ‘আত্মানাং বিদ্ধি’। প্রাচীন ল্যাটিন বলেছে-Knoweth thyself এবং উভয়েরই অর্থ নিজেকে চেনো। হাদিসে আছে “মান আরাফা নাফসাহু ফাকাদ আরাফা রব্বাহু” অর্থাৎ যে নিজেকে চিনতে পেরেছে সে প্রভু আল্লাকে চিনেছে। গানটি যখন নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যসূচকভাবে ‘আলেক লতা’ শব্দটি উচ্চারণ করে তখন সেই উপলব্ধি পূর্বে উল্লিখিত বক্তব্যসমূহকেই সমর্থন করে।

বিচার: ‘মানুষ’ শব্দের এক অর্থ-জীবাত্মা রক্তমাংসের মানুষ। অপর অর্থ-যিনি সর্বত্র বিরাজ করছেন-সেই পরমাত্মা, তিনিও মানুষ। সোনার মানুষ, মানুষ-আকার এক মানুষেই বিরাজমান। রক্তমাংসের মানুষের ভিতরে মনের মানুষ, মানুষ-রতন, লা-শরিক, অচিন মানুষ, অলখ-নিরঞ্জন, পড়শি, কাছের মানুষ নির্বিশেষ হয়ে গিয়েছেন।

তথাগত বুদ্ধদেব বলতেন যে, মনুষ্যদেহ ছাড়া মুক্তিলাভ সম্ভব নয়। সুফিমতে, আলাহ্ নিজের প্রতিরূপে আদম গঠন করে তার মধ্যেই মিশে আছেন। চণ্ডীদাস জানালেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ রাজসভাকবি দৌলত কাজীর ভাষায়, ‘নর সে পরম দেব, নর সে ঈশ্বর।’ আর লালন বললেন, ‘মানুষ ছেড়ে ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি।’ লালনের মানুষতত্ত্বে ইহ এবং দেহতত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ।

‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ গীতিকায় লালন সাঁইয়ের ঈশ্বরচিন্তার যে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, তা আলোচনা করো।

ঈশ্বরচিন্তার বহিঃপ্রকাশ: পাঠ্য ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ কবিতায় লালন তাঁর আনন্দচিত্তে চরম ভালোবাসা আর বিশ্বাসের জায়গা থেকে মানুষের জয়গান করেছেন। মানুষকেই তাঁর পদের পরতে পরতে পরমাত্মার অংশ হিসেবে মানবিক, আধ্যাত্মিক ও দার্শনিকভাবে তুলে ধরেছেন। মানুষকে তিনি ভক্তি ও পরমগুরু জ্ঞান করেছেন। মানুষের ভিতরে লুকিয়ে থাকা অধরা সেই পরমাত্মারূপে বিরাজমান মনের মানুষকে খুঁজে বেড়িয়েছেন এবং সাধন-ভজনের জন্য গুরুতত্ত্বে একমাত্র মানুষের মুক্তির কথা বলেছেন।

মানুষ ভজনার মধ্য দিয়েই সিদ্ধিলাভ এবং পরমাত্মার সঙ্গে মিলন হয়। লালন বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীর সকল মানবসন্তানের ভিতরে অধরা মনের মানুষ বিরাজ করেন। নিরিখ বেঁধে সত্যমনে সাধনের মধ্য দিয়ে • তাঁকে লাভ করতে হবে- নইলে মূল হারাতে হবে। মানুষের প্রধান পরিচয় • তার মনুষ্যত্বে। লালন গুরুবাদী ধর্মে সাধন-ভজনে সেই মনুষ্যত্বকেই জাগ্রত করতে চেয়েছেন। তাই লালন বলেছেন-

"সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন। 
সত্য সুপথ না চিনিলে পাবিনে মানুষের দর্শন।।"

‘লালন শাহ ফকিরের গান’ গীতিকায় ধর্মদর্শনতত্ত্বের আড়ালে মানবজীবনকথা প্রকাশ পেয়েছে, বুঝিয়ে দাও।

ভূমিকা: বাংলার বাউল সাধক-কবি লালন ফকির তাঁর আজীবন অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে মানবতার পাঠ নিয়েছেন। তিনি হিন্দুও নন, মুসলিমও নন। আবার তিনি হিন্দুরও, মুসলিমেরও। লালনপন্থায় এই সারসত্যটাই প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর গানগুলিতে দর্শনকথা রয়েছে, রয়েছে মানবজীবনের মূলকথা। তত্ত্ব ধর্মের রূপকটা সরালেই এ কথা সত্য হয়ে ওঠে।

তত্ত্বকথা: বাউলতত্ত্বে মানবদেহই সাধনগৃহ। এই দেহ ভজলেই সাধকের দিব্যজ্ঞান হয়। তিনি স্বর্গসুখ লাভ করেন। বাউলেরা মনে করে ‘human body is the highest temple of the god.’ এই দেহসাধনায় নারীকেও তাঁরা সঙ্গ করেন। সাধনসঙ্গিনীর সঙ্গে সাধনক্রিয়ার তৃতীয় দিনে সাধক ‘দ্বি-দলের মৃণালে’ সোনার মানুষ হয়ে ওঠেন। আর এই যুগ্ম সাধনতন্ত্রের পথ বলে দেন স্বয়ং গুরু-

"দ্বি-দলের মৃণালে 
সোনার মানুষ উজ্জ্বলে 
মানুষ-গুরু কৃপা হ'লে
জানতে পাবি।"

কবিতায় বর্ণিত ‘সোনার মানুষ’ হলেন বাউল সাধক। এটাই এই কবিতার বাউল দর্শনতত্ত্ব।

মানবজীবনের চিত্র: তত্ত্বকথা যাই হোক-না-কেন, সাধারণ পাঠকের কাছে কবিতাটির রসমাধুর্য আস্বাদনীয় বিষয়। বাউলেরা ধর্ম মানেন না। ধর্ম • না মানাটাই তাঁদের ধর্ম। মানবপ্রেমই তাঁদের ঐশ্বর্য। মানুষে-মানুষে মিলনের কথাই তাঁরা বলে থাকেন। মানবসেবার মধ্য দিয়েই মনের মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়।

এই কথাই তো যুগে যুগে মহাপুরুষেরা বলে এসেছেন। মানুষ এবং একমাত্র মানুষই পারে মানুষের পাশে দাঁড়াতে। তবেই তো সে সোনার মানুষ হয়ে ওঠে-

"মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি। 
মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি।।"

মানুষকে বাদ দিয়ে কে কবে সাধক হয়েছে? এটাইতো জীবনবেদ। এ কথা চিরনূতন এবং চিরপুরাতন। মানুষের মধ্যেই সোনার মানুষ হওয়ার বীজ রয়েছে। শুধু সময়ে তা প্রয়োগ করতে হবে। তত্ত্বের বাইরে এই সহজ কথাটা বুঝে নিতে পাঠকের অসুবিধা হয় না।

শেষকথা: শুধু দর্শনতত্ত্ব নয়, মানবজীবনের সারকথাটাও সত্য। তত্ত্বরসিক না হলেও জীবনতত্ত্বের অংশ হওয়া যায়। কবিতা পাঠের শেষে এই অনুভবটা থেকে যায়। সুতরাং, দর্শনতত্ত্বের আড়ালে এ কবিতায় মানবজীবনকথাই প্রকাশ পেয়েছে-এ কথা সর্বাংশে সত্য। বাউলগানে মানুষটাই বড়ো: ধর্ম নয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের উক্তিতে তার সমর্থন পাওয়া যায়- “… এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে, কোরানে পুরাণে ঝগড়া বাঁধেনি।”

“মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।”- কবিতায় কবি সমাজ- সংসার থেকে পাওয়া কোন্ অভিজ্ঞতাটিকে উল্লেখ করেছেন? অভিজ্ঞতাটি থেকে কবির কোন্ মনোভাব জেগে উঠেছে?

অভিজ্ঞতার উল্লেখ: কবি লালন দেখছেন আর শুনছেন দেশ-গাঁয়ের মানুষ জাতিগতভাবে সামাজিক অধিকার লাভ করার জন্য খুবই তৎপর হয়ে উঠেছে। জাতিগত ভেদাভেদে সমাজ কালুষিত হচ্ছে। তারা সাধনা-ধর্মাচরণের নামে ভণ্ডামি করে পরিত্রাণের আশা করছে।

কবির মনোভাব: জাতিভেদের বিষবাষ্পে কলুষিত সমাজ কবিকে আহত করেছে প্রতিমুহূর্তে। কবি দেখেছেন, মানুষ পার্থিব বিলাসব্যসনে সংসারের সীমানাটুকুর মধ্যে আবদ্ধ। তাদের মনের কোনো জাগরণ নেই। ষড়রিপুর আবর্তে আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রশ্রয়ে লালিত জীবনটাকেই তারা পছন্দ করে। মানুষের থেকে দূরে সরে গিয়ে তারা পরমসত্তাকে খোঁজার আনন্দ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। কবি তাই মানুষকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে মানুষ ভজনার কথা বলেছেন। আপন অন্তরাত্মায় লুকিয়ে যে মনের মানুষ, তাঁর সন্ধানে নিজেকে সমর্পণ করার কথা বলেছেন বারবার- তবেই মিলবে জীবনযন্ত্রণা থেকে মুক্তিপথের দিশা।

মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।”- সোনার মানুষের বিশেষত্ব বুঝিয়ে দাও। সোনার মানুষ হতে গেলে কী কী বাধা আসতে পারে?

সোনার মানুষের বিশেষত্ব: আলোচ্য অংশটি ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ পাঠ্য গীতিকা থেকে গৃহীত। আলোচ্য গীতিকায় লালন ফকির বলেছেন মানুষ তো পালিত ও বর্ধিত। এইভাবেই সে মানবীয়। সোনার মতোই সে

শোভমান ও মানবদীপ্তিতে ভরপুর। সংসারে তার পৌরুষগুণ ছড়িয়ে পড়ে। অথচ সমাজ-সংসার শ্রেণি পছন্দ করে। শ্রেণিবিন্যাসে মানুষের মনুষ্যোচিত গুণ নষ্ট হতে থাকে। এমন আশ্রয়ে মানুষ কেবল বেঁচেবর্তে থাকে। এই বেঁচে থাকাকে তারা ভালোবাসতে শেখে না। মহাকাল তাদের ভিতরে প্রবেশ করে মরণের ঘরে নিয়ে যায়।

কিন্তু যারা বেঁচে থাকাকে ভালোবাসতে চায়, আদর্শকে প্রশ্রয় দেয়- তারা সময়ের ভিতরে ঢুকে গিয়ে বেঁচে থাকা জীবনকালটুকুকে যোগ্য অর্থেই নির্মাণ করে চলে। তারা চিনতে ও জানতে পারে নির্মল জীবনের গৌরবান্বিত অধ্যায়কে। এটাই সোনার মানুষের বিশেষত্ব।

বাধাসমূহ: সোনার মানুষ হতে গেলে কবির পরামর্শ- মানুষ ভজনা করতে হবে, মানুষকে স্বীকার করতে হবে। আর মানুষকে স্বীকার না করলেই তো কঠিন বাধা। মানুষকে ছাড়লে বা উপেক্ষা করলে মানবের মনুষ্যত্বই মিথ্যা হয়ে যায়। মানুষের ভিতরের যে মানুষ-আকার অন্তরাত্মা তার গুণকীর্তন দূর হয়ে গেলে, সোনার মানুষ হওয়ার পথে বাধা আসে। তাই মানুষ ছাড়লে চলবে না।

মানুষকে মানুষ-গুরুর কৃপা পেতে হবে। তিনি আচার্য এবং উপদেশক- তিনি পথ দেখান। সুতরাং, মানুষ-গুরুর কৃপাধন্য না হলে সোনার মানুষ হওয়া যায় না।

তীব্র বাধা অবশ্য ঈশ্বরের নামে সংস্কারের দোসর হয়ে ওঠা। মাথা মুণ্ডণ করে জাতে ওঠা আচারসর্বস্ব আচরণ। তুচ্ছ আনুষ্ঠানিকতা ঈশ্বরলাভে বাধা বইকি! তাই আচার ছেড়ে মানুষ-আকারে মন দিতে হবে। মানবপ্রেমেই মানবজীবনের মুক্তি।

কবিতা অনুসরণে কবি ও মানুষ-গুরুর মিল ও অমিল নির্ণয় করো।

ভূমিকা: ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’-এ ১৪ টি পঙ্ক্তি আছে। সেখানে পঞ্চম পঙ্ক্তিতে ‘মানুষ-গুরু’ কথাটি রয়েছে। আমাদের কবি ও মানুষ-গুরুর মধ্যে মিলও আছে, অমিলও আছে।

মিল: কবি ও মানুষ-গুরু উভয়ে বিদ্বান এবং পণ্ডিত। দুজনেই প্রিয় ও মান্য। কবি পরামর্শ দিয়েছেন, “মানুষ-আকার ভজলে তরবি।” আবার মানুষ-গুরু কৃপা দেন বলেই মানুষ পরমপুরুষকে জানতে পারে। দুজনেই স্মরণীয় জন। দুজনের দেখানো পথেই মানুষ সোনার মানুষের সান্নিধ্যলাভে গুণান্বিত হয়। আসলে কবি ও মানুষ-গুরু একাকার হয়ে গিয়েছেন।

অমিল: কবি স্রষ্টা। মুখে মুখে গান বাঁধেন। কল্পনাশক্তিতে ভরপুর আবেগ-বেদনা-প্রেমকে বেশি প্রশ্রয় দেন। তাঁর প্রতিভা কবিত্ব। কবি লালন জাতিভেদে জর্জরিত সমাজে নবজাগরণ এনেছেন। তিনি উত্তরণের বিষয় (ভজলে তরবি) জানিয়েছেন, তাঁর মানব-অনুরাগ গভীর ও অগাধ।

গুরু উপদেশক- ধর্মকর্মে পথ দেখান, অবিদ্যা থেকে উদ্ধার করেন। তিনি জ্ঞানের ভাণ্ডার, তাই লোভ ও পাপের নাশক। তিনি সমস্যায় পড়া মানুষকে সাধনার পথে শুদ্ধ করেন, মুক্ত করেন। অনুগ্রহ ও প্রসন্নতা মানুষ- গুরুর প্রধান বিষয়।

লালন শাহ ফকিরের গান সাধনসংগীতটিতে রূপকের আড়ালে গভীর অধ্যাত্মবোধের প্রকাশ ঘটেছে- আলোচনা করো।

ভূমিকা: সুবিখ্যাত বাউল সাধক ও সংগীতস্রষ্টা লালন ফকিরের ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ গীতিকাটিতে রূপকার্থে বাউলতত্ত্বের প্রকাশ ঘটেছে। সংগীত আসলে সাধক তথা গীতিকারের আত্মতত্ত্বের অনুসন্ধান। বাউল সাধকরা সাধনতত্ত্বের গূঢ় মহিমায় নিজের মধ্যে যে পরমেশ্বরের বাস, তাকে আবিষ্কার ও উপলব্ধি করতেই সর্বদা তৎপর।

দেহতত্ত্বের রূপকার্থ: উপনিষদের বাণী হল- ‘আত্মানাং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু’- এর মধ্যে আত্মাকে রথী ও শরীরকে রথ বলে নির্দেশ করা হয়েছে। বাউলসাধনা ‘ভাণ্ডে ব্রহ্মাণ্ড’ তত্ত্বে বিশ্বাসী। তাই লালন বলেছেন ‘মানুষ-আকার’ ভজার কথা। মানবদেহেই পরমাত্মা বা মনের মানুষের বাস। দেহসাধনের চূড়ান্ত পর্যায়ে তাঁকে অনুভব করা যায়। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন ‘দ্বি-দলের মৃণালে’ সোনার মানুষের সান্নিধ্যলাভের কথা। মানবদেহ নানা চক্রে বিভাজিত। সাধক দেহের নিম্নচক্র থেকে সাধনযোগে মনকে ঊর্ধ্বদিকে দুই ভূ-র মাঝে আজ্ঞাচক্রে নিয়ে যাওয়ার সাধনা করেন। এই আজ্ঞাচক্রই দ্বি-দল মৃণাল। এখানেই অবস্থান সোনার মানুষ তথা পরমাত্মার।

ঈশ্বরময়তার রূপকার্থ: বাউলের ঈশ্বর বাউলের জীবনদেবতা, আধ্যাত্মিক সত্তা। আলোচ্য গানে লালন সাঁই তাঁকে বলেছেন ‘সোনার মানুষ।’ এই গানে উল্লিখিত মানুষ দুই রূপে ধরা দিয়েছে। এক, মানুষ জীবাত্মা, আর-এক মানুষ পরমাত্মা। তাই সাঁই বলেছেন, ‘এই মানুষে মানুষ গাথা’। তিনি নিরাকার, জীবাত্মাকে আশ্রয় করেই তাঁর প্রাণপ্রতিষ্ঠা। তাই বাউলের ভাবনায় তিনি আলেক লতা, অলখ-নিরঞ্জন।

উপসংহার: আলোচ্য গানে লালনের মানবপ্রেমের সুর নিহিত। তাই বহিরঙ্গের আচার-অনুষ্ঠানে নয়, মানুষ ভজনাতেই মানুষের ঈশ্বরলাভ সম্ভব।

লালন শাহ ফকিরের গান’ গীতিকাটি সার্থক গীতিকবিতা কি না বিচার করো।

গীতিকবিতার সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য: গীতিকবিতা হল এমন এক কবিতা, যে কবিতায় কবি তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতিকে এক সাবলীল ও আন্তরিক গীতিপ্রবণ ভাষায় ব্যক্ত করেন। এটি এসেছে ইংরেজি Lyric poetry থেকে। গীতিকবিতার বৈশিষ্ট্য হিসেবে বলা যায়, কবির ব্যক্তিগত অনুভূতির তীব্রতার জন্যই এতে নিবিড় আত্মময়তা থাকে, যা অনুভূতিশীল মনকে প্রবলভাবে স্পর্শ করে। কবি ও পাঠক যুগ্ম রসসংযোগেই গীতিকবিতার সৌন্দর্য। আবেগ সংযত ও সংহত হয়ে যখন গভীরতা লাভ করে-সেই অবস্থাতেই গীতিকবিতা লেখা হয়। একজন বাউল তার নিজের আত্মশুদ্ধির জন্য গান করার সময় যেভাবে আকুল হন, সেই ভাবের প্রকাশ ঘটে তার গানে। অর্থাৎ যে-কোনো সার্থক গীতিকবিতার মতোই বাউলের গানে সুস্পষ্ট হয় বক্তার ভাবোচ্ছ্বাসের পরিস্ফুটতা।

আলোচ্য গানের বিষয়: অনেক সমালোচক লালনকে পুরোপুরি বাউল বলে স্বীকার না করলেও লালনকে উদাসীন আত্মপরায়ণ বলা যায় না। সংসার আর সমাজের বাস্তব অভিঘাত তাঁকে তথাকথিত প্রথাসর্বস্বতার বিপরীত দিকেই আকৃষ্ট করেছিল। হিন্দু ও মুসলিম এই দুই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিশ্বাস ও আচারসর্বস্বতার বিরোধিতা করেছিলেন লালন। তাঁর গানের অনুভবের পশ্চাতে জীবনসত্যের অন্বেষণ পরিলক্ষিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের মরমি গানের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। লালন সাঁই-এর গানে তিনি খুঁজে পেয়েছেন- ‘Mystic transcendentalism’ I

‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ শীর্ষক গীতিকাটির মধ্য দিয়ে লালন আত্মা ও পরমাত্মার অস্তিত্ব এবং অন্তরোপলব্ধিকেই সুন্দররূপে চিত্রিত করেছেন। মানুষের অন্তরেই পরমাত্মার অধিষ্ঠান অথচ তা অধরা। ষচক্রে বিভাজিত মানবশরীরের আজ্ঞাচক্রে তথা ভূযুগলের মাঝে প্রকট হয় সোনার মানুষ। বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের আড়ম্বরে মুহ্যমান না হয়ে, ব্যাকুল সাধক যদি কেবল মানুষের ভজনা করতে পারে তবেই ঈশ্বরের সান্নিধ্য মেলে। কারণ নিরাকার সেই আলেক সাঁই জড়িয়ে আছে জীবাত্মাকেই। তাই গানে সাঁই বলছেন-“এই মানুষে মানুষ গাথা। দেখনা যেমন আলেক লতা/ জেনে শুনে মুড়াও মাথা / জাতে তরবি।।”

লালন ফকিরের ‘লালন শাহ ফকিরের গান’ পাঠ্য গীতিকাটিতে সুফি ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে বলে অনেকে মনে করেন, এ সম্পর্কে তোমার অভিমত ব্যক্ত করো।

লালনের মুনশিয়ানা: লালন ফকির ছিলেন একাধারে বাউল সাধক এবং বাউল গীতিকারও। একই ব্যক্তির মধ্যে এই দুটি সত্তা যেন একে অপরের পরিপূরক। ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ গীতিকাটিতে তিনি অসাধারণ মুনশিয়ানায় বাউলতত্ত্বের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। আত্মতত্ত্বের আলোকে, ভাষার তির্যকতায় গানটির মধ্যে ইঙ্গিতবাহী একটা রূপকল্পের প্রকাশ লক্ষ করা যায়। স্বভাবকবি লালনের কবিত্বশক্তি ছিল অসাধারণ। • তিনি মুহূর্তমধ্যে গীত রচনায় বাউলতত্ত্বকে সংযুক্ত করতে পারতেন।

পাঠ্য গানটির মধ্যে সুফি ভাবনার প্রক্ষেপণ রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। সুফি ভাবনা হল ধর্মভাবনার মানবায়ন বা মানবপ্রীতির ধর্মপ্রক্ষেপ। এই গানেও দেখা যায় লালন সাঁই একাধিকবার ‘মানুষ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন- বলেছেন মানুষ ভজনার কথা। সুফি ধর্মকে বলা হয় প্রেমধর্ম। এর আরাধ্য দয়িত বা প্রেমিক এবং ভক্ত দয়িতা বা প্রেমিকারূপে – কল্পিত হয়। এই প্রেমসাধনাও গূঢ় ভাবতত্বে সমৃদ্ধ। আলোচ্য গীতিকাটির মূলে রয়েছে মানবপ্রেমের বাণী। নাচ-গান-বাদ্য সহযোগে ধর্মসাধনাই বাউলের সাধনপথ। আরাধ্যকেও এই সাধক সম্প্রদায় কখনও নারীরূপে সাধনা করে। দুটি ধর্মতত্ত্বে মিলের স্থানটি হল-পরমারাধ্যের সান্নিধ্যলাভ, পরমারাধ্যকে অন্তরতম করে দেখা ও তাঁর সাধনায় ক্রমে ক্রমে অন্তর্লীন হয়ে যাওয়া। আলোচ্য গানে লালন বলছেন, ‘দ্বি-দলের মৃণালে’ অর্থাৎ মানবদেহের ভূযুগলের মাঝে আজ্ঞাচক্রে মিলবে সেই সোনার মানুষের সান্নিধ্য। সুফিমতের সঙ্গে বাউল সাধনতত্ত্বের সবচেয়ে বড়ো মিল নিঃসন্দেহে মানুষের মধ্যে থেকেই ভগবৎসাধনা বা ভগবৎ অন্বেষণের দিকটি। এ গানেও তাই সাঁই বলেন, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’। উভয় ধর্মের মানবতাবাদের প্রতি একান্ত টান থেকেই দুইকে এক করে দেখার চেষ্টা হয়। তাই লালনের উপর সুফি ভাবনার প্রভাব কমবেশি ছিল বলেই মনে হয়, যা তাঁর গানেও প্রতিফলিত।

লালন শাহ ফকিরের গান গীতিকাটি সাধক কবি লালন ফকিরের মরমি মনের বহিঃপ্রকাশ আলোচনা করো।

লালনের পরিচয়: লালন ফকির সম্পর্কে জনশ্রুতি আছে, তিনি হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করে পরবর্তীকালে মুসলিম পরিবারের সান্নিধ্যে আসেন। কিন্তু তাঁকে কেউ মুসলিম বলেও চিহ্নিত করতে পারেনি। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দেহ সৎকার কিংবা কবরস্থ হয়নি, বরং কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া গ্রামে যেখানে তাঁর আখড়া ছিল সেই আখড়াতেই দেহ সমাধিস্থ করা হয়।

লালনের বাণীর উৎস: লালনের চেতনার জগৎ ছিল জাতি-ধর্মের ঊর্ধ্বে। মানবপূজারি লালনের গানে তাই বারবার মানুষের কথাই উঠে এসেছে। আলোচ্য গানেও সাঁই বারংবার বলছেন মানুষের কথা। গানটি শুরুই হয় এই বলে যে, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’। মরমি সাধক হলেও তিনি ছিলেন যুক্তিবাদী ও অনুসন্ধানী। তিনি বাংলার লোকায়ত গানের শ্রেষ্ঠ পুরুষ। বাংলা প্রকৃতির আবহমান অশ্রুত সুরের গভীর উৎস থেকেই জন্মলাভ করেছে লালনের বাণী।

‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ গীতিকার মধ্যে আমরা লালনের সংবেদনশীল হৃদয়ের প্রকাশ দেখতে পাই। তাঁর এই গানের উপজীব্য মানবপ্রেমের বাণী। ব্যাকুল ভাবোন্মত্ত সাধক বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানে ঈশ্বর খুঁজে বেড়ান। কিন্তু লালন বলছেন মানুষকে ভালোবাসতে। কারণ মানবদেহই পরমাত্মার অধিষ্ঠানক্ষেত্র। সাধক তাঁর একনিষ্ঠ মনকে দ্বি-দলের মৃণালে তথা মানবদেহের ভূযুগলের মাঝে নিয়ে যেতে পারলেই মিলবে ‘সোনার মানুষ’-এর সন্ধান। নিরাকার সাধনা, মানবপ্রেমই এই মিলনের একমাত্র পথ। মরমিয়া’ সাধনার এই উপলব্ধিকেই মর্মজ্ঞ’লালন অতিক্রম করতে চেয়েছেন তাঁর সহজ সাংগীতিক সাধনার দ্বারা।

আরও পড়ুন – ভাব সম্মিলন কবিতার প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment