ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের বিপক্ষে যুক্তি দাও

ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের বিপক্ষে যুক্তি দাও

ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের বিপক্ষে যুক্তি দাও
ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের বিপক্ষে যুক্তি দাও

ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র: বিপক্ষে যুক্তি

ঐতিহাসিক মহম্মদ হাবিব, কে এম আশরাফ, সতীশচন্দ্র, ড. মুজিব, • ড. হাবিবউল্লাহ, ড. নিজামি, ড. ইফতিকার আলম খান, ইশতিয়াক হোসেন কুরেশী প্রমুখ ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের বিপক্ষে বিভিন্ন মত প্রদান করেছেন। যুক্তি- তথ্য দ্বারা তাঁরা প্রমাণ করেছেন যে, ইসলামীয় ধর্মরাজ্যের তত্ত্ব অনুসারে দিল্লি সুলতানির আমলে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ধর্মাশ্রয়ী বা পুরোহিততান্ত্রিক বলা যায় না।F, তাঁরা তাঁদের বক্তব্যের সমর্থনে যেসকল জোরালো যুক্তিগুলি পেশ করেছেন তা হল নিম্নরূপ-

জিয়াউদ্দিন বারানির অভিমত

বারানি ইসলামকে ধর্মপথে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনে ধর্মমুখী রাজতন্ত্রের কথা বলেছিলেন। কিন্তু তিনিও নিশ্চিত ছিলেন যে, ধর্মীয় অনুজ্ঞা বা অস্ত্রের জোরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু অধ্যুষিত ভারতে ধর্মীয় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তাই ‘ফতোয়া’ গ্রন্থের অন্যত্র তিনি ইহজাগতিক রাজ্যকে তিনভাগে বিভক্ত করেছেন। তৃতীয় শ্রেণির রাজ্য হিসেবে তিনি সেইসব রাজ্যের কল্পনা করেছেন যেখানে রাজা স্বৈরাচারী এবং তাঁর শাসনপ্রণালী কোরান বা শরিয়তের আদর্শের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তিনি শাসকের অন্তরের সৌন্দর্য প্রকাশের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।

খলিফার প্রতি বাহ্যিক আনুগত্য

দিল্লির সুলতানদের খলিফার প্রতি আনুগত্য ছিল বাহ্যিক এবং প্রয়োজনভিত্তিক। সুলতানরা ব্যক্তিগত প্রতিভা ও উদ্যোগে ভারতে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন। মুসলিম মিল্লাতকে পক্ষে রাখার প্রয়োজনে কেউ কেউ হয়ত খলিফার অনুমোদন নিয়েছিলেন। কিন্তু তা ধর্মীয় আদর্শ বা প্রেরণা থেকে নয়, বাস্তব রাজনৈতিক প্রয়োজন থেকে। সুলতানদের কেউ কেউ নিজের নামে খুতবা পাঠ করেছেন। মুবারক শাহ নিজেকেই খলিফা বলে দাবি করেছেন। অর্থাৎ এক্ষেত্রে ধর্মীয় আনুগত্য নয়; খলিফার অনুমোদন নিয়ে নিজের স্বৈরাচারী ক্ষমতাকে একটা বৈধতা দেওয়ার ইচ্ছা সক্রিয় ছিল মাত্র।

উলেমাদের প্রভাব অতিরঞ্জন মাত্র

  1. দিল্লির সুলতানরা ছিলেন ক্ষমতা ও স্বৈরাচারের প্রতীক। কিছু সরকারি পদে উলেমাদের নিয়োগ করলেও, তাঁদের হাতের পুতুল সুলতানরা ছিলেন না।
  2. ইলতুৎমিসের আমলে উলেমারা যমুনাতে হিন্দুদের স্নানযাত্রা বন্ধের অনুরোধ করলে সুলতান তা অগ্রাহ্য করেন। তাঁর আমলে উলেমা শ্রেণি সুলতানকে কঠোর ইসলামীয় আইন প্রয়োগের অনুরোধ জানালে সুলতান তা প্রত্যাখ্যান করেন।
  3. বারানি রচিত তারিখ-ই-ফিরোজশাহী গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বেয়ানার কাজি ও কোরানবিদ মুঘিসউদ্দিন একদা আলাউদ্দিন খলজিকে বলেন যে, সুলতানের কার্যকলাপ শরিয়তের বিধান অনুযায়ী সম্পন্ন হচ্ছে না। তখন প্রত্যুত্তরে আলাউদ্দিন খলজি বলেছিলেন, ‘আমি অন্য কোনও আইন জানি না। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে আমি যা প্রণয়ন করি সেটিই আইন (I do not know what is lawful or unlawful. Whatever I think to be good for the state or emergency, that I decree)।
  4. মহম্মদ বিন তুঘলক, গিয়াসউদ্দিন বলবন প্রমুখের আমলে উলেমাদের ক্ষমতা যথেষ্ট হ্রাস করা হয়। কে এম আশরাফ লিখেছেন যে, দিল্লি সুলতানি ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরশাসন। রাজশক্তির এমন জ্বলন্ত স্বেচ্ছাচারিতার সঙ্গে কোরানের আদর্শের সামঞ্জস্যবিধান অসম্ভব।

উলেমাদের তোষণনীতি

উলেমারাও জানতেন যে দিল্লির সুলতানদের কর্তৃত্ববাদের সঙ্গে আপস করতে না পারলে অস্তিত্ব রক্ষা সম্ভব হবে না। তাই তাঁরা কোরানের নতুন নতুন উদার ব্যাখ্যা দিয়ে সুলতানকে আল্লাহ্ প্রেরিত মান্যব্যক্তি এবং তাঁর নির্দেশকে ঈশ্বরের নির্দেশরূপে গণ্য করার পরামর্শ দেন। অর্থাৎ, দিল্লি সুলতানির শাসনে উলেমাদের প্রভাব ছিল গৌণ।

জাওয়াবিত (নির্দেশনামা) জারির স্বাধীনতা

দিল্লির সুলতানরা বাস্তবে ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। তারা রাষ্ট্রের প্রয়োজনে জাওয়াবিত (নির্দেশনামা) জারি করতেন। এই সকল নির্দেশের অধিকাংশের সঙ্গে ধর্মীয় নির্দেশের আদৌ কোনও সামঞ্জস্য ছিল না। এমনকি অনেক নির্দেশ কোরানের ভাষ্যের বিপরীত ছিল। কোরান ও শরিয়তি আইনের বাইরে আইন বা নির্দেশ জারির এই রাজকীয় অধিকার ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিফলন হতে পারে না।

শরিয়ত বহির্ভূত নির্দেশ

সুলতানি আমলের বহু নির্দেশনামা শরিয়তের ভাষ্যের বিপরীত ছিল। যেমন- শরিয়তের বিধান অনুসারে সুদ গ্রহণ নিষিদ্ধ। কিন্তু সুলতানি আমলে বাণিজ্যের প্রয়োজনে সুদ গ্রহণ স্বীকৃত ছিল। ইসলামের বিধান অনুসারে জিম্মি (যেমন- ইহুদি, খ্রিস্টান, হিন্দু)-রা জিজিয়া প্রদানের বিনিময়ে, মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসের অধিকারী। কিন্তু সুলতানি আমলে হিন্দুরা নাগরিক হিসেবে বসবাস করা ও সরকারি চাকুরি করার অধিকার পেতেন। তাছাড়া সুলতানি যুগে ব্রাহ্মণ, স্ত্রীলোক, শিশু বা অসহায় ব্যক্তিদেরও ‘জিজিয়া’ করপ্রদানের হাত থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। শরিয়তে প্রাণদণ্ড নিষিদ্ধ ছিল, কিন্তু সুলতানি রাষ্ট্রে মুসলমানদের প্রাণদণ্ড দেওয়া হত। অর্থাৎ ইসলাম স্বীকৃত নয় এমন বহু সুযোগসুবিধা সুলতানি আমলে চালু ছিল।

ন্যায়বিচার তত্ত্ব

ইলতুৎমিস ন্যায়বিচার প্রদানকেই তাঁর চূড়ান্ত রাজনৈতিক লক্ষ্য বলে ঘোষণা করেন। অধ্যাপক নুরুল হাসান তাঁর মধ্যযুগের ভারতে রাষ্ট্র ও ধর্মসংক্রান্ত কিছু সমস্যা শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন যে, ইলতুৎমিস ঘোষিত ‘ন্যায়বিচার’-এর অর্থ হল সামাজিক ভারসাম্য বজায় রাখা। সমাজের কোনও অংশ যেন অপর অংশের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে তা সুনিশ্চিত করা। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষ সাম্যবাদী সমাজ গড়ে তোলাই ছিল সুলতানি শাসনের লক্ষ্য।

হিন্দুদের প্রতি আচরণ

বাস্তববাদী দিল্লির সুলতানগণ উপলব্ধি করেছিলেন যে ঐতিহ্যশালী হিন্দুধর্মকে ধ্বংস বা উপেক্ষা করে ভারতে সুশাসন প্রবর্তন অসম্ভব। তাই সুলতানদের অনেকেই হিন্দুদের অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন, হিন্দুদের রাজকার্যের উচ্চপদে নিয়োগও করতেন। স্থানীয় ও গ্রামীণ প্রশাসনে হিন্দুদের একাধিপত্য ছিল লক্ষণীয়। দেশের সর্বত্র অসংখ্য হিন্দু সামন্তরাজ্যের অস্তিত্ব ছিল।F

মূল্যায়ন

  1. বাস্তবে দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ছিল পার্থিব বা ধর্মনিরপেক্ষ (জাহান্দারি)। ড. নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে, প্রাথমিকভাবে সুলতানরা ধর্মনির্ভর রাজনীতিকে মান্যতা দিতেন। কিন্তু ইলতুৎমিসের সময় থেকেই ভারতের সামাজিক পরিস্থিতির দাবি মেনে তাঁরা ‘ব্যাবহারিক জীবনে সহাবস্থানের নীতি নেন, ধর্ম হয়ে ওঠে গৌণ।’ বারানির বক্তব্যেও এই মতের সমর্থন পাওয়া যায়।
  2. সতীশচন্দ্র লিখেছেন, ‘জিজিয়ার চাপ দিয়ে হিন্দুদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হত না, এমনকি তরবারির ভয় দেখিয়েও নয়।’
  3. সুলতানরা ছিলেন ভাগ্যান্বেষী সৈনিক। বিলাসবৈভবের মধ্যে ক্ষমতাসীন থাকাই ছিল তাঁদের মূল লক্ষ্য। তাই ধর্ম বা রাজনীতির খুঁটিনাটি নিয়ে তাঁরা ভাবিত ছিলেন না।
  4. সুলতানি আমলে ধর্মান্তরের ঘটনার সাথে সুলতান বা রাষ্ট্রনীতির সম্পর্ক ছিল ক্ষীণ, প্রায় শূন্য। ধর্মান্তরের জন্য জিজিয়ার চাপ বা শাসকের রক্তচক্ষু যতটা দায়ী ছিল, তার থেকে অনেক বেশি দায়ী ছিল মুসলিম শাসনে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সুবিধালাভের জন্য হিন্দুদের স্বতঃপ্রণোদিত ইচ্ছা ও উদ্যোগ।
  5. অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, সুলতানি আমলে রাষ্ট্রের প্রকৃতি ছিল সামরিক ও অভিজাততান্ত্রিক (Military and Aristocratic)। আসলে রাষ্ট্র ছিল সামরিক শক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, অভিজাতগোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত, সুলতান কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত একটি সংগঠন, যা তত্ত্বগতভাবে এককেন্দ্রিক, কিন্তু কার্যত স্ব-স্ব স্বাধীন কতকগুলি অঞ্চলের সমন্বয় (a confederation of Semi-Independent territorial units.) I

আরও পড়ুন –একাদশ শ্রেণির বাংলা বিষয়ের ১ম সেমিস্টারের অন্যান্য অধ্যায়

Leave a Comment