চিনে চৌঠা মে আন্দোলনের কারণগুলি বিশ্লেষণ করো। এই আন্দোলনের প্রভাব আলোচনা করো।
চিনে চৌঠা মে আন্দোলনের কারণ
৪ঠা মে আন্দোলনের কারণগুলি হল –
(১) ইউয়ান-সি-কাই এর নৃশংসতা
ইউয়ান-সি-কাই রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে চিনে সামরিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। সমস্ত সাংবিধানিক পদ্ধতি বাতিল করে তিনি আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলির কাছ থেকে কয়েকটি শর্তে ঋণ নেওয়ার কথা বলেন। যারা বিরোধিতা করেন তাদের তিনি নৃশংসভাবে হত্যা করেন।
(২) কুয়ো-মিং-তাং দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা
ইউয়ান-সি-কাই এর এই অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে কুয়ো-মিং-তাং দল ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে আন্দোলনের ডাক দিলে বিদ্রোহীদের কঠোরভাবে দমন করা হয়। কুয়ো-মিং-তাং দলকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয় এবং কুয়োমিনতাং দলের নেতা সুং-চিয়াও-জেন সহ বহু বিরোধী নেতাকে হত্যা করা হয়, যা চীনের জনগণকে ক্রুদ্ধ করে তোলে।
(৩) কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতা
কিছুদিনের মধ্যে চীনের কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমরনায়কদের প্রভাব দারুনভাবে বৃদ্ধি পায় । উত্তর চীনে সমরনায়করা প্রায় স্বাধীনভাবে শাসন পরিচালনা করতে থাকে।
(৪) ২১ দফা দাবির প্রতিবাদ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান জার্মানির কাছ থেকে চীনের শান-টুং প্রদেশ দখল করে। এরপর সেখানে নিজেদের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে সমগ্র চীনকে নিজেদের উপনিবেশে পরিণত করতে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে জাপান চীনের কাছে ২১ দফা দাবি পেশ করে। যা স্বাধীন চীনের পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব ছিল।
(৫) বিদেশি পণ্যের বাজার
এই সময় চীনে জাতীয় শিল্পের কিছু বিকাশ ঘটে। কিন্তু চীনের অভ্যন্তরে জাপানসহ অন্যান্য পুঁজিপতি দেশগুলি বাজার দখলের উদ্দেশ্যে প্রবেশ করে ফলে চীনে নতুন গড়ে ওঠা শিল্পগুলি তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। এবং অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যায়।
(৬) সমিতি গঠন
এর প্রতিবাদে চীনে ‘নাগরিকদের দেশপ্রেমী সমিতি’ এবং ‘জাপ বিরোধী কমরেডদের জাতীয় সমিতি’ গড়ে ওঠে। এরা চীনে বিদেশী পণ্যের প্রবেশের প্রতিবাদ জানায় এবং জাপানি পণ্য বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়।
(৭) সমিতি গঠন
ওদিকে সম্রাট পদের লোভে ইউয়ান-সি-কাই জাপানের সঙ্গে গোপন চুক্তি করেন এবং জাপানের পরামর্শে তিনি বয়কট আন্দোলন প্রত্যাহারের নির্দেশ দিলে জনরোষের সৃষ্টি হয়।
প্রত্যক্ষ কারণ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রপক্ষের হয়ে যুদ্ধ করে জয়লাভ করার পর চীনের আশা ছিল যে বিদেশিদের কাছ থেকে চীন তার রাজ্যের অংশগুলি ফেরত পাবে। সে কারণে প্যারিসে শান্তি সম্মেলনে চীন জাপানের ২১ দফা দাবি সহ সব অসম চুক্তি এবং শান-টুং প্রদেশে জাপানের কর্তৃত্ব বাতিলের দাবি জানায়।
কিন্তু ইউরোপিয় নেতৃবর্গ চীনের কথায় কর্ণপাত না করায় চীনের প্রতিনিধিরা শূন্য হাতে ফিরে আসে। ফলে চীনের জনগণ ক্ষোভে ফেটে পরে। এই পরিস্থিতিতে চীনের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চেন-তু-সিউ এর নেতৃত্বে হাজার হাজার ছাত্র ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ৪ঠা মে তিয়েন-আন-মেন স্কয়ারে সমবেত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
গুরুত্ব ও ফলাফল
(১) সরকারের নতিস্বীকার
ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের চাপে চীন সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। আন্দোলনের চাপে সরকার বাধ্য হয়ে ধৃত ছাত্রদের ছেড়ে দেয় এবং ভার্সাই সন্ধি স্বাক্ষর করবেনা বলে ঘোষণা করেন।
(২) কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা
এই আন্দোলনের ফলে চীনে কুয়ো-মিং-তাং দলের পুনর্গঠন করা হয় এবং কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান ঘটে।
(৩) ব্যাপকতা
৪ঠা মে আন্দোলনের প্রভাব ছিল চীনের সর্বত্র এবং এর গণ ভিত্তি ছিল ব্যাপক।
(৪) সাংস্কৃতিক অগ্রগতি
ঐতিহাসিক ইমানুয়েল সু-র মতে, এই আন্দোলন চীনের সাংস্কৃতিক জগতে সুদুরপ্রসারী পরিবর্তন আনে। চীনের বুদ্ধিজীবিদের মাধমে এই আন্দোলন থেকে আধুনিকতা, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল। চীনের বহু বইপত্র , পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হলে সংস্কৃতির অগ্রগতি ঘটে। চীনের পুরনো মতাদর্শের পরিবর্তে নতুন সংস্কৃতিকে সবাই স্বাগত জানায়।
মন্তব্য
চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছিল ৪ঠা মে আন্দোলনের প্রধান প্রাপ্তি। এই আন্দোলনের সময় উল্লেখযোগ্য দুটি সংবাদপত্র চেন-তু-সিউ সম্পাদিত নবতারুন্য ও জ্ঞানের আলো প্রকাশিত হয় । চীনা ঐতিহাসিক হো-কাং-চি এর মতে “৪ঠা মে আন্দোলন নতুন বিপ্লবী ঝড়ের জন্ম দেয় এবং চীনের বিপ্লবকে এক নতুন স্তরে পৌছে দেয়।’’
আরও পড়ুন – ভারতে রেলপথ প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ও প্রভাব আলোচনা করো