চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রধান শর্তগুলি লেখো | ভারতীয় অর্থনীতিতে এর প্রভাব কী ছিল
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উদ্দেশ্য
১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্ণওয়ালিশ বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পিছনে বেশ কিছু উদ্দেশ্য ছিল, যেমন—
(i) সুনিশ্চিত আয়
কোম্পানি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভারতে নির্ধারিত রাজস্ব থেকে সরকারের আয় সুনিশ্চিত করতে চেয়েছিল। তারা অনুভব করেন এর ফলে তাদের আয়ের অনিশ্চয়তা দূর হবে।
(ii) অনুগামী অভিজাত শ্রেণির উদ্ভব
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের মাধ্যমে কোম্পানির অনুগ্রহপুষ্ট একটি নতুন অভিজাত শ্রেণির উত্থান ঘটবে, যারা তাদের প্রধান সমর্থক হিসেবে কাজ করবে।
(iii) দেশের সমৃদ্ধি
জমিতে স্থায়ী অধিকার পেয়ে জমিদাররা কৃষি ও কৃষকের উন্নতির জন্য যথেষ্ঠ চেষ্টা করবেন। ফলে দেশের সমৃদ্ধি বাড়বে এবং পরোক্ষে কোম্পানিরই লাভ হবে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শর্তাবলী
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শর্তে বলা হয়—
(i) জমিদাররা বংশানুক্রমিকভাবে জমি ভোগদখল করতে পারবেন।
(ii) জমিদার ইচ্ছামত জমি দান, বিক্রি বা বন্ধক রাখতে পারবেন।
(iii) নির্ধারিত ভূমি-রাজস্বের শতকরা ৯০ ভাগ সরকার ও ১০ ভাগ জমিদার পাবেন।
(iv) সূর্যাস্ত আইন অনুসারে জমিদাররা নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের মধ্যে সরকারের প্রাপ্য রাজস্ব পরিশোধ করবে এবং তাতে ব্যর্থ হলে জমিদারকে সমগ্র জমিদারি বা তার অংশ বিক্রি করে রাজস্ব মেটাতে হবে। অন্যথায় জমিদারি বাজেয়াপ্ত হবে।
(v) খরা, বন্যা, মহামারি বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও রাজস্বের হার অপরিবর্তিত থাকবে।
(vi) ভূমি-রাজস্বের পরিমাণ ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের হারেই বহাল থাকবে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব
বাংলার ইতিহাসে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। মার্শম্যান-এর মতো অনেকে এই ব্যবস্থার সাফল্যের কথাও বলেছেন। অপরদিকে হোমস-এর মতো কোনো কোনো ঐতিহাসিক এই ভূমি বন্দোবস্তের বেশকিছু ত্রুটি তুলে ধরেছেন।
(1) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ইতিবাচক প্রভাব
(i) সুনিশ্চিত আয়
এই ব্যবস্থার ফলে এতদিন পর্যন্ত কোম্পানির রাজস্ব সম্পর্কে যে অনিশ্চয়তা ছিল তার অবসান হয়। কোম্পানি তার স্থায়ী আয় সম্পর্কে সুনিশ্চিত হয়।
(ii) অনুগত জমিদার শ্রেণির উদ্ভব
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ভারতে রাজকীয় অনুগ্রহপুষ্ট একটি নতুন অভিজাত শ্রেণি গড়ে ওঠে যারা সরকারের প্রধান সমর্থক ছিলেন। এদের সহযোগিতায় ভারতে ব্রিটিশ শাসনের স্থায়িত্ব ও বিস্তার ঘটতে থাকে।
(iii) বানিজ্যিক মূলধনের জোগান
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সংগৃহীত অর্থ থেকে কোম্পানি তার বাণিজ্যিক বিনিয়োগের মূলধন সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়।
(iv) কৃষির উন্নতি
জমিদারগণ স্থায়ীভাবে জমির মালিকানা পাওয়ার জন্য কৃষিজমির উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধির প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। কৃষির উন্নতি ঘটে, ফলে জমি থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় বাবদ আয় ক্রমশ বাড়তে থাকে। আবাদি কৃষিজমির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
(v) বাজেট তৈরির সুবিধা
কোম্পানি তার স্থায়ী আয় সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়ার জন্য তাদের পক্ষে বাৎসরিক আয়ব্যয়ের একটা সুনির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরি করা সহজ হত ।
(vi) উৎখাতের সম্ভাবনা হ্রাস
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে প্রজারা নীলামদারদের শোষণ ও ঘন ঘন উচ্ছেদের হাত থেকে রেহাই পায় ।
(vii) গ্রামীণ এলাকার উন্নয়ন
এই বন্দোবস্তের ফলে জমিদারগণ অনেক ক্ষেত্রে গ্রামের মধ্যমণি হয়ে গ্রামগুলির সর্বাঙ্গীন উন্নতির প্রতি যত্নবান হয়েছিলেন ।
(2) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নেতিবাচক প্রভাব
প্রকৃতপক্ষে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল অপেক্ষা কুফল অনেক বেশি ছিল। বিভিন্ন ঐতিহাসিক এই বন্দোবস্তের বিভিন্ন কুফলগুলি উল্লেখ করেন। যেমন—
(i) কৃষকদের উচ্ছেদ
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদারকে জমির স্থায়ী মালিকানা দেওয়া হলেও জমিতে কৃষকের কোনো অধিকার ছিল না। ফলে জমিদার বেশি রাজস্ব পাওয়ার আশায় চাষিকে ঘন ঘন জমি থেকে উৎখাত করত। চাষির রাজস্ব বাকি পড়লে জমিদার সেই চাষির জিনিসপত্র নিলাম করত।
(ii) জমির উন্নতি ব্যহত
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা জমির মালিকানা না পাওয়ায় চাষিরা জমির উন্নতির জন্য বিশেষ চেষ্টা করত না। জমিদাররাও জমির আয় নিজেদের বিলাসব্যসনে ব্যয় করত। ফলে জমি কৃষির উন্নতি দারুণভাবে ব্যাহত হয়।
(iii) সরকারের লোকসান
জমিদাররা সরকারকে যে পরিমাণ রাজস্ব প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজস্ব তারা কৃষকদের কাছ থেকে আদায় করত। অন্যদিকে সরকারের রাজস্ব নির্ধারণ সুনির্দিষ্ট হওয়ায় ভবিষ্যতে রাজস্ব থেকে সরকারের আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা বন্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া কৃষিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, পতত জমি উদ্ধার প্রভৃতি থেকে জমিদাররের আয় বহুগুণ বাড়লেও এই বাড়তি আয়ের কোনো অংশ সরকার পেত না।
(iv) কৃষকদের দুরবস্থা
কৃষকদের কাছ থেকে নির্ধারিত রাজস্বের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে তাদের ওপর তীব্র শোষণ ও অত্যাচার চালানো হয়।
(v) পুরানো জমিদারদের উচ্ছেদ
‘সূর্যাস্ত আইন’ অনুসারে নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের মধ্যে সরকারি কোশাগারে রাজস্ব জমা দিতে ব্যর্থ হয়ে বহু পুরানো জমিদার তাদের জমিদারি হারান।
(vi) নতুন জমিদারদের উত্থান
পুরানো বহু জমিদার তাদের জমিদারি হারালে শহুরে ধনী বণিকরা এই জমিদারিগুলি কিনে নেন। এসব ভুঁইফোঁড় নতুন জমিদারদের কৃষক ও জমির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক বা প্রজাকল্যাণের কোনো ইচ্ছা ছিল না। প্রজাদের শোষণ করে বেশি অর্থ উপার্জনই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য।
(vii) মধ্যস্বত্বভোগীর উত্থান
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে সরকার ও জমিদারের মাঝখানে পত্তনিদার, দর-পত্তনিদার প্রভৃতি মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এসব মধ্যস্বত্বভোগীরা সীমাহীন আর্থিক শোষণ চালিয়ে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।
আরও পড়ুন – ভারতে রেলপথ প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ও প্রভাব আলোচনা করো