স্বাধীন ভারতের প্রথম তিনটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ও গুরুত্ব আলোচনা করো

স্বাধীন ভারতের প্রথম তিনটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ও গুরুত্ব আলোচনা করো

স্বাধীন ভারতের প্রথম তিনটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ও গুরুত্ব আলোচনা করো
স্বাধীন ভারতের প্রথম তিনটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ও গুরুত্ব আলোচনা করো

বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা

প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর উদ্যোগে ভারতে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এর ফলে অতি দ্রুত ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটে। ভারতের বিভিন্ন পবার্ষিকী পরিকল্পনা সম্পর্কে নীচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।

প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৫১-৫৬ খ্রি)

স্বাধীনতা লাভের পর ভারত যে বহুমুখী অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল তা দূর করার উদ্দেশ্যে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম পার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।

লক্ষ্য:

প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য ছিল দুটি। এগুলি হল—[i] যুদ্ধ ও দেশবিভাগের ফলে সৃষ্ট ভারতের অর্থনৈতিক সংকট দূর করা। [i] উন্নয়নমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধি করা এবং ভারতীয়দের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটানো।

পদক্ষেপ:

এই পরিকল্পনায় কৃষি, সেচ, শক্তি উৎপাদন, গোষ্ঠী উন্নয়ন, পরিবহণ, পুনর্বাসন প্রভৃতি বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত করার জন্য মোট ব্যয় ধরা হয় ২,০৬৯ কোটি টাকা। পরে তা বাড়িয়ে ২,৩৭৮ কোটি টাকা করা হয়।

অগ্রগতি:

প্রথম পরিকল্পনার লক্ষ্যগুলি মোটামুটিভাবে সফল হয়েছিল। এই পরিকল্পনার ফলে ভারতের জাতীয় আয় ১৮ শতাংশ, মাথাপিছু আয় ১০৮ শতাংশ, কৃষি উৎপাদন ২২ শতাংশ এবং শিল্প উৎপাদন ৩৯ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। সেচ, বিদ্যুৎ উৎপাদন, যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভৃতিও যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।

ত্রুটি:

যথেষ্ট সাফল্যলাভ সত্ত্বেও প্রথম পবার্ষিকী পরিকল্পনায় ২,৩৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষমাত্রা ধরা হলেও পুরো টাকা কাজে লাগানো যায়নি। বাস্তবে ব্যয় হয় ১,৯৬০ কোটি টাকা। কৃষির ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়ার ফলে শিল্পের অগ্রগতিও আশানুরূপ হয়নি।

মূল্যায়ন:

কিছু ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। [১] প্ৰথম পবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারতীয় অর্থনীতিতে দীর্ঘকাল ধরে চলা স্থিতাবস্থার অবসান ঘটে। [২] প্রথম পবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারতে পরিকল্পিত অর্থনীতির পথচলা শুরু হয়। [৩] এই পরিকল্পনার ফলে ভারতবাসীর মধ্যে দেশের উন্নয়ন সম্পর্কে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখা দেয়।

দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৫৬-৬১ খ্রি.)

প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় খাদ্য ও কাঁচামালের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু অৰ্থনৈতিক ক্ষেত্রে সামাজিক কল্যাণসাধন এবং বেসরকারি উদ্যোগ উভয়কেই সমান গুরত্ব দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন।

নেহেরু মহলানবিশ মডেল:

নেহরুর আদর্শকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইন্সটিটিউট-এর প্রখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্তচন্দ্ৰ মহলানবিশ (১৮৯৩-১৯৭২খ্রি) ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার একটি রূপরেখা বা মডেল তৈরি করেন। প্রধানমন্ত্রী নেহরু কিছু সংশোধনের পর এই মডেলটির প্রয়োগ ঘটান। এই মডেল নেহরু মহলানবিশ মডেল’ নামে পরিচিত।

লক্ষ্য:

দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল- [১] জনসাধারণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের উদ্দেশ্যে জাতীয় আয় ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা। [২] ভারী শিল্প ও যন্ত্রপাতি নির্মাণ শিল্পের ওপর গুরুত্ব দিয়ে শিল্পায়নের গতি বৃদ্ধি [৩] কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা। [৪] কুটির শিল্পের বিকাশ ঘটানো।

পদক্ষেপ :

দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ভারী শিল্প ও প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি, কুটিরশিল্পের প্রসারের মাধ্যমে অন্তত ১ কোটি কর্মসংস্থানে সুযোগ তৈরি করা প্রভৃতি উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর জন্য ব্যয় ধরা হয় ৪৮০০ কোটি টাকা।

অগ্রগতি:

দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সাফল্য আশানুরূপ হয়নি। তবে এর দ্বারা জাতীয় আয় ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, বিদ্যুৎ উপাদন যথেষ্ট বাড়ে, দুর্গাপুর, ভিলাই ও রাউরকেল্লায় ইস্পাত কারখানা স্থাপিত হয়, ভারী ইঞ্জিনিয়ারিং ও যন্ত্রপাতি নির্মাণ শিল্পের সূচনা হয় ইত্যাদি।

ত্রুটি :

দ্বিতীয় পার্ষিকী পরিকল্পনার প্রধান ত্রটিগুলি ছিল— [১] মুদ্রাস্ফীতি ও অন্যান্য কারণে মাঝপথে এই পরিকল্পনার নির্ধারিত ব্যয়ের পরিমাণ কমিয়ে ৪,৬০০ কোটি টাকা করা হয়। [২] কৃষি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছোতে পারেনি। [৩] কয়লা এবং ইস্পাত উৎপাদনও তার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম ছিল।

মূল্যায়ন:

বিভিন্ন ব্যর্থতা সত্ত্বেও দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কয়েকটি কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এগুলি হল—[১] এই পরিকল্পনায় শক্তি উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল। [২] ভারী শিল্প ও শিল্পপ্রযুক্তির অগ্রগতিও যথেষ্ট হয়েছিল। [৩] অন্তত ৯০ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছিল।

তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৬১-৬৬ খ্রি):

সরকার ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

লক্ষ্য:

তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্যগুলি ছিল—[১] প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে জাতীয় আয় বাড়ানো, [২] খাদ্যোৎপাদনে স্বনির্ভর হওয়া, [৩] শিল্প ও রপ্তানির চাহিদা মেটাতে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা, [৪] ইস্পাত, রাসায়নিক দ্রব্য, শিল্পযন্ত্রপাতি, শক্তি প্রভৃতির উৎপাদন বৃদ্ধি করা [৫] কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা। [৬] বৈষম্য দূর করে অর্থনৈতিক ক্ষমতার সুষম বণ্টন ইত্যাদি।

পদক্ষেপ:

এই পরিকল্পনা রূপায়ণে ব্যয় ধরা হয় ১১৬০০ কোটি টাকা। এই পরিকল্পনায়- [১] কৃষি উৎপাদনে গুরুত্ব বাড়ানো হয়। [২] গ্রামীণ অর্থনীতির পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে গ্রাম পঞ্চায়েত, জেলাপরিষদ, সমবায় সমিতি প্রভৃতির সম্প্রসারণ ঘটানো হয়। [৩] ক্ষুদ্র ও ভারী বুনিয়াদি শিল্পের বিকাশে উদ্যোগ নেওয়া হয়। [৪] শিক্ষার প্রসার ও কর্মসংস্থানের ওপর গুরুত্ব বাড়ানো হয়।

অগ্রগতি:

তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বহু ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছিল। চিনের ভারত আক্রমণ (১৯৬২ খ্রি.), পাক-ভারত যুদ্ধ (১৯৬৫-৬৬ খ্রি), ব্যাপক খরা (১৯৬৫ খ্রি) প্রভৃতি ঘটনা এই ব্যর্থতার জন্য বহুলাংশে দায়ী ছিল।

ত্রুটি:

এই পরিকল্পনার প্রধান ত্রুটিগুলি ছিল–[১] জাতীয় আয়, মাথাপিছু আয় তার লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয়। [২] কৃষিক্ষেত্রে শোচনীয় ব্যর্থতা দেখা দেয়। ড. অমলেশ ত্ৰিপাঠী বলেন যে, “এই পরিকল্পনায় কৃষি উৎপাদন হল একটি হতাশাজনক ব্যর্থতা” (a dismal failure)। [৩] ইস্পাত, কয়লা, সিমেন্ট, বিদ্যুৎ প্রভৃতি উৎপাদনও আশানুরূপ হয়নি। [৪] পরিকল্পনার শেষে বেকারসংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়।

মুল্যায়ন

এই সমস্ত ঘটনাগুলি তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকে তার লক্ষ্যমাত্রায় পৌছানোর পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।

আরও পড়ুন – ভারতে রেলপথ প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ও প্রভাব আলোচনা করো

Leave a Comment