প্রতিবন্ধীদের প্রতি সামাজিক দায়িত্ব রচনা
প্রতিবন্ধীদের প্রতি সামাজিক দায়িত্ব রচনা
ভূমিকা
প্রতিবন্ধীদের প্রতি এই পৃথিবীর মানুষের কর্তব্য আছে, কর্তব্য আছে পরিবারের, সমাজের এবং রাষ্ট্রের। অথচ দেখা যায় বিশ্বের মানুষ প্রতিবন্ধীদের প্রতি অত্যন্ত হৃদয়হীন এবং কোথাও কোথাও দেখা যায় বিশ্বের মানুষ প্রতিবন্ধীদের প্রতি উদাসীন এবং কোথাও কোথাও তারা অবহেলিত।শারীরিক মানসিক দিক থেকে যারা পঙ্গু প্রতিবন্ধী, তাদের দুঃখ-বেদনা, তাদের অন্তরের ব্যথা ক’জন বা উপলব্ধি করে। এই নিষ্ঠুরতা মানবিক দিক থেকে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
প্রতিবন্ধী বলতে কী বুঝায়
কেউ হয় আজন্ম পঙ্গু বা প্রতিবন্ধী, আবার কেউ সুস্থভাবে জন্মগ্রহন করেও রোগ-ব্যাধি, অপুষ্টি, সামাজিক, পারিপার্শ্বিক কারণে বিকলাঙ্গ বা পঙ্গু হতে পারে। পঙ্গুতা কোন অভিশাপ নয়, যেকোন মানুষের জীবনে যেকোন সময় তা ঘটতে পারে। দৈহিক বা মানসিক দিক থেকে যে স্বাভাবিক জীবনের পূর্ণতা পায় না তাদের জীবনে নেমে আসে প্রতিবন্ধকতা-তাকে আমরা বলি প্রতিবন্ধী। সমাজে যারা মূক-বধির জড়বুদ্ধি তারা প্রতিবন্ধী বলে অভিহিত হয়।
প্রতিবন্ধীদের সমস্যা
প্রতিবন্ধীরা সমাজের কাছে গুরুত্ব হারায়, তারা বঞ্চি ত হয় পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ থেকে, তাদের জীবনে নেমে আসে হতাশা, অনিশ্চয়তা, গভীর অন্ধকার। কর্মক্ষেত্রে তারা হয় উপেক্ষিত। স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারায় বলে অর্থনৈতিক দিক থেকে তারা দূর্বল হয়, তাদের জীবন হয়ে ওঠে আনন্দহীন। তাদের প্রতি কঠোর আচরণ, নির্মম উদাসিনতা তাদের জীবন ভরিয়ে দেয় হতাশায়। যুগ যুগ ধরে সমাজ প্রতিবন্ধীদের প্রতি অত্যন্ত হৃদয়হীন আচরণ করে আসছে। এই প্রসঙ্গে হৃদয়হীন স্পার্টার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। কিন্তু ভারতের পথ স্বতন্ত্র। মানুষের প্রতি মানুষকে ভালোবাসার, প্রেমের বাণী শুনিয়েছেন ভারত ভূমিতে জন্মগ্রহণ করে স্বামী বিবেকানন্দ, শ্রীচৈতন্য, গৌতমবুদ্ধ। তাঁরা বলেছেন জীবে প্রেমের মাধ্যমে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করা যায়। তাই যদি হয় প্রতিবন্ধীরা কি অন্য মানুষের থেকে স্বতন্ত্র।
প্রতিবন্ধী বর্ষের ঘোষণা
বর্তমানে বিশ্বে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা প্রায় পঁয়তাল্লিশ কোটির ও বেশী। নানা ভাবে প্রমাণিত হয়েছে এই প্রতিবন্ধীদের মধ্যে সুপ্ত আছে বিশ্বজয়ী প্রতিভার স্ফুলিঙ্গ। মিলটন ছিলেন অন্ধ, বায়রণ ছিলেন খঞ্জ, কীট্স, আর.এল. স্টিভেনসন, নিক্সে ছিলেন চির রুগ্ন। অথচ তাঁদের প্রতিভার অবদানে সমৃদ্ধ হয়েছে বিশ্বসাহিত্য এবং বিশ্বের চিন্তাপ্রবাহ। বর্তমানে সমাজে প্রতিবন্ধীদের প্রতি মানুষের আচরণ যথেষ্ট মানবিক নয়। তাই বিংশ শতাব্দীর অপরাহ্নে প্রতিবন্ধীদের প্রতি পৃথিবীর সমাজ ও রাষ্ট্র সমূহকে দায়িত্বশীল করার জন্য ১৯৮১ সালকে বিশ্ব-প্রতিবন্ধী বর্ষরূপে ঘোষণা করতে হল রাষ্ট্রেসংঘকে।
যার ফলে মানব জাতির একটি উৎপেক্ষিত দিক বিশ্ব-মানবের দৃষ্টির সম্মুখে গুরুত্ব সহকারে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠার সুযোগ পায়, প্রতিবন্ধীরা আর দেশ জাতির বোঝা হতে পারে না। তাদের অংশগ্রহণে, সহযোগিতায় সমাজপ্রবাহ হয়ে উঠছে প্রাণময়, গতিশীল, প্রতিবন্ধী-বর্ষ পালন তখনই সার্থক হবে যখন সকল শ্রেণীর মানুষের মেলবন্ধনে সমাজের কর্মধারা এগিয়ে যাবে, প্রতিবন্ধীরা সমাজে পাবে সমান অধিকার অন্যদের সাথে।
ভারতে প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা
আর্ন্তজাতিক পরিসংখ্যান অনুসারে বিশ্বের প্রায় পঁয়তাল্লিশ কোটি প্রতিবন্ধীর মধ্যে এক-চতুর্থাংশ শিশু। ভারতের প্রতিবন্ধীর সংখ্যা প্রায় পাঁচকোটি এবং পশ্চিমবঙ্গে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ। সেই সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। ভারত মানবতার পূজারি চিরকাল। রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদ প্রতিবন্ধী বর্ষাপালনের পাঁচ দফা নীতি ঘোষণা করেছেন।
বিশেষ জোর দিয়েছেন প্রতিবন্ধীদের যথাযোগ্য শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ওপর, ভারত সরকার প্রতিবন্ধীদের চাকুরির সংরক্ষণের ব্যবস্থাও বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে প্রতিবন্ধীদের যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে বদ্ধ পরিকর। ১৯৭৬-৭৭ সাল থেকে ১৯৮০-৮১ সাল এই পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১,৩২২ জন প্রতিবন্ধীকে সাত লক্ষ্যধিক টাকার কৃত্রিম অঙ্গ দান করেছে, বৃত্তি পেয়েছে ১,১৫০ জন প্রায় তিন লক্ষ আশি হাজার টাকা ব্যয় করে। এছাড়া পুরস্কার প্রভৃতির মাধ্যমে তাদের কর্মের ক্ষেত্রে উৎসাহ ও দেওয়া হচ্ছে।
বেসরকারী প্রচেষ্টা
বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও সহানুভূতির সাথে এগিয়ে আসছে প্রতিবন্ধীদের সাহায্য করতে। ইউ. এন, ও, আই. এণ্ড এল, বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সচেষ্ট এখন। কলকাতায় প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ডেফ এন্ড ডাম্ব স্কুল, ব্লাইন্ড স্কুল, অমলেন্দু বোধ নিকেতন, বোধ পীঠ, রামকৃষ্ণমিশন, মাদার টেরিজা মিশনারিজ অব চ্যারিটি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান। এছাড়া হাওড়ার রাঘবেন্দ্র ব্যানার্জী ইনস্টিটিউট ফর মেন্টালি রিটায়ার চিলড্রেন্স এন্ড গাইডেন্স সেন্টার জড়বুদ্ধি শিশুর জন্য, বালিগঞ্জে বয়স্ক অন্ধদের জন্য লাইটহাউস ফর দি ব্লাইন্ড প্রভৃতি স্থাপিত হয়েছে।
উপসংহার
প্রতিবন্ধকতার মূলোচ্ছেদের জন্য চাই অশিক্ষা ও দারিদ্র সংহার, অর্থনৈতিক পূর্নবাসন প্রয়োজন। দয়া নয়, করুণা নয়, ভিক্ষা নয়, মৌখিক সহানুভূতি নয়, প্রতিবন্ধীদের জন্য চাই মানুষের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার, মানবিক, সামাজিকও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব বোধের উন্মেষ। এই উপলব্ধির উন্মেষ হলে চিরঅবহেলিত প্রতিবন্ধী খুজে পাবে তাদের জীবনে নতুন আলোরদিশা, জীবন হবে তাদের আনন্দ- সমুজ্জ্বল।
আরও পড়ুন – ড্রাগের নেশা সর্বনাশা রচনা