শৈশবের স্মৃতি রচনা
ভূমিকা
মানুষের জীবনের চারটি অধ্যায় হল- শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও বার্ধক্য। শিশুর জন্মের পরে চার-পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত সময়কে তার শৈশবকাল বলা হয়। শৈশবে জীবনে প্রথম চলার শুরু। বিপুল পৃথিবীর সব কিছু অজানা, সব কিছু অচেনা শিশুর কাছে। যা কিছু দেখে, তার কাছে সব যেন বিস্ময়। অজানাকে জানার ও অচেনাকে চেনার কল্পলোকের ডানায় ভর করে তার মন হারিয়ে যেতে চায় স্বপ্ন-রাজ্যে। শৈশবের সেইসব স্মৃতি জীবনের মণিকোঠায় চিরকাল অমর হয়ে থাকে, কখনও মানুষ ভুলতে পারে না তার শৈশবকে জীবনের পরবর্তী অধ্যায়েও।
জীবনে প্রথম বিদ্যারম্ভ
শৈশবে মাতৃ ক্রোড়ই শিশুর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। শিশুর প্রথম হাতেখনি হয় শৈশবে, বর্ণপরিচয়ের মধ্যমে শুরু হয় শিক্ষা। মা-বাবা, ঠাকুরমা-ঠাকুরদাদার কোলে বসে সে শুনতে ভালোবাসে রাজা-রানি, রাক্ষস- খোক্কোসের গল্প, আধো আধো উচ্চারণ করে বলে মজার মজার ছড়া। সে পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চেপে পৌঁছাতে চায় রাজপুত্র হয়ে, যেখানে রাজকন্যা বন্দিনী রাক্ষসের গুহায় তাকে মুক্ত করে আনার জন্য। এসব তার পরবর্তী জীবনে বাস্তবের মুখোমুখি হওয়ার এক কল্পচিত্র।
এসব স্মৃতি মন থেকে কখনও মুছে যায় না, মুছে যেতে পারে না। ধীরে ধীরে কল্পনার সাথে শিশুর শৈশবের মেলবন্ধন হয়, সম্পর্ক গড়ে ওঠে বাস্তবের সাথে, বিস্ময়ভরা বিশ্বের গোপন চাবির খোঁজে তার মন ব্যাগ্র হয়ে ওঠে। তার পরিচয় ঘটতে থাকে পারিপার্শিক পরিবেশ লোকজনের সাথে। তার মনে হয় সবকিছু যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে, সেও তাকিয়ে থাকে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে। দূরে আকাশ যেখানে দিগন্তরেখায় গাছপালার সাথে গল্পে ব্যস্ত সেখানে সে ছুটে যেতে চায় কচি পায়ে ধীরে ধীরে। নতুনকে দেখে কখনও তার ফোকলা দাঁতের ফাঁকে ঝরে পড়ে হাসির ঝিলিক কখনও ভয় পেয়ে জড়িয়ে ধরে মাকে।
বিদ্যালয়ের স্মৃতি
বিদ্যালয়ের আঙিনায় পা রাখা সে তো জীবনের এক স্মৃতিময় মুহূর্ত। আনন্দও ভয় এসে উঁকিমারে মনের জানালায়। শিক্ষকদের তখন মনে হয় সমুদ্রের অতল জলের গভীরের দুজ্ঞেয় কেউ, মন চায় না বিদ্যালয়ের চার দেয়ালের মধ্যে নিজেকে বন্দী রাখতে। কখন ব্যস্ত হয়ে পড়ে ঘরের বাইরে যাওয়ার জন্য, সে চায় ঘুড়ি হয়ে আকশে মনের আনন্দে উড়তে বা রামধনুর সাতটা রঙের সাথে মিশে একাকার হয়ে যেতে। প্রথম পরিচয়ে বিদ্যালয় ও সেখানের সহপাঠীদের সাথে, গড়ে ওঠে মধুর সম্পর্ক, গল্পগুজব-পড়াশোনা ও হাসিঠাট্টার মধ্যে কেটে যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। বাড়ি ফিরলে পুতুল-খেলনার সাথে যেন বেশি সখ্যতা। দাদা-দিদি, মা-বাবার সাথে মেলায় যাওয়া, কখনও তাদের হাত ধরে হাঁটা, কখনও তাঁদের কোলে বা কাঁধে। এসব স্মৃতি কি কখনও ভুলা যায়।
রাতের স্মৃতি
রাতের অন্ধকার যেন মনে হত দৈত্য দানব বা ভূত-প্রেতের মতো আমার দিকে বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে আছে। উঠোনের পাশের আমগাছ বা লেবুগাছের ডাল বাতাসে নড়লে মনে হত, হয়তো এসব ভূতের কান্ড। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে হলে মায়ের আঁচল ছিল নিরাপদ আশ্রয়। জ্যোৎস্না রাতে মায়ের কোলে বসে চাঁদকে দেখে খুব আনন্দে বলতে থাকতাম, ‘আয়রে চাঁদ আয়রে আয়, আয়রে তুই মেঘের নায়।’ মেঘগুলো যখন চাঁদের সাথে লুকোচুরি খেলা খেলত তখন খুব আনন্দ পেতাম। ইচ্ছে করত আমার দুটো ডানা থাকলে উড়ে গিয়ে মেঘের দেশে পৌঁছে যেতাম।
শৈশবের স্মৃতি ও শিশুমন
শৈশব হল নিজেকে ভবিষ্যৎ জীবনের প্রস্তুতির অধ্যায়। সেদিনের মনের কল্পনা পরবর্তী জীবনে প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার পথকে সুপ্রশস্থ করতে সাহায্য করে। প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসাই সমাজের বন্ধনকে মজবুত করে, সমাজের পরিবেশকে সুন্দর-পরস্পরের সম্পর্ককে করে মধুর।
উপসংহার
শৈশবে কারও ক্ষমতা থাকে না বুঝার সেই দিনগুলোর গুরুত্ব কত। কৈশোরে এসে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর স্মৃতি বার বার মনের পর্দায় ভিড় করে, মন ফিরে যেতে চায় শৈশবে, জানি সেই শিশু বয়স আর কখনও ফিরে পাবনা। তাই বার বার বলতে ইচ্ছে করে: কৈশোর এসে শৈশবে আমার মন-দরজায়, ওরা আবার পাখা মেলে স্মৃতি হয়ে গর্জায়। চলার নবীন প্রাতে কৈশোর জীবন-প্রভাতী, যায় কি ভোলা তাকে তার গল্পে মাতি!
আরও পড়ুন – যন্ত্র-সভ্যতা-বর্তমান ও ভবিষ্যৎ