ভূমিকা:
বর্তমানে ‘রাজনীতি’ শব্দটির ব্যবহার ব্যাপক। যদি রাজনীতির অর্থ স্বার্থের দ্বন্দ্ব হয়ে থাকে তাহলে বুঝতে হবে যেদিন থেকে একটি এককোশী প্রাণী থেকে আর-একটি এককোশী প্রাণীর জন্ম হয় সেদিন থেকেই রাজনীতির সূচনা ঘটে। রাজনীতি বলতে কী বোঝায় তা বলা কঠিন। রাজনীতির অর্থ ও প্রকৃতি সম্পর্কে ব্যাপক মতপার্থক্য লক্ষ করা যায়। নীচে রাজনীতির অর্থ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা হল।
রাজনীতির অর্থ
রাজনীতির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ :
‘রাজনীতি’ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘পলিটিক্স’ (Politics)। ইংরেজি ‘পলিটিক্স’ (Politics) শব্দটি গ্রিক শব্দ পোলিস (Polis) থেকে এসেছে, যার শব্দগত অর্থ নগর রাষ্ট্র।
রাজনীতির প্রাচীন ধারণা :
রাজনীতি শব্দের প্রথম ব্যবহার শুরু হয় প্রাচীন গ্রিসে। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টট্ল তাঁর ‘Politics’ পুস্তকে রাজনীতির আলোচনার সূচনা করেন। গ্রিক সমাজব্যবস্থা বহু পোলিস (Polis) বা নগর রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। পোলিস (Polis) বা নগর রাষ্ট্র সম্পর্কিত বিষয়ই ছিল রাজনীতি।
রাজনীতির আধুনিক ধারণা :
বিংশ শতাব্দীর প্রথম কয়েক দশক থেকে রাজনীতির ধারণার পরিবর্তন ঘটে। পূর্বে রাজনীতি বলতে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনাকে বোঝানো হত। কিন্তু রাজনীতির আধুনিক ধারণার রাষ্ট্রের পরিবর্তে সমাজের পটভূমিতে বিচার করা হয়। গুরুত্ব দেওয়া হয় ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, বিরোধ, বিরোধ-মীমাংসা, আলাপ-আলোচনা, ভোট-নির্বাচন, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আচার-আচরণ, রাজনৈতিক দল, চাপ-সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী প্রভৃতিকে।
সংকীর্ণ অর্থে রাজনীতি :
সংকীর্ণ অর্থে রাজনীতি বলতে দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কাজকর্মকে বোঝায়। সাধারণ নির্বাচন, আইনসভা, মন্ত্রীসভা, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে ‘রাজনীতি’ কথাটি প্রয়োগ করা হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর রাজনৈতিক আচার-আচরণ বা কার্যকলাপ রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত নয়।
ব্যাপক অর্থে রাজনীতি :
ব্যাপক অর্থে রাজনীতি বলতে এমন কিছু কাজকর্মকে বোঝায় যার মাধ্যমে কয়েকজন ব্যক্তি সাধারণ নিয়মকানুন তৈরি করে, সংরক্ষণ করে এবং সংশোধন করে। এদিক থেকে বিচার করলে রাজনীতি অনিবার্যভাবে দ্বন্দ্ব ও সহযোগিতার সঙ্গে সম্পর্কিত।
সাধারণের ধারণায় রাজনীতি :
সাধারণের ধারণায় রাজনীতি হল জনসভা, সমাবেশ, স্লোগান, দাবিদাওয়া, ধর্মঘট, টিয়ার গ্যাস চার্জ, লাঠি চার্জ, মিথ্যা প্রতিশ্রুতিসহ নির্বাচন এবং কৃতিত্ব সম্পর্কে ভ্রান্ত প্রতিবেদন ইত্যাদি। এককথায় সাধারণ মানুষ ‘দলীয় রাজনীতি’কেই রাজনীতি বলে মনে করেন। এই কারণেই জনসন রাজনীতিকে ‘বদমায়েশদের শেষ আশ্রয়’ বলে বর্ণনা করেছেন।
রাজনীতির সংজ্ঞা নিয়ে মতপার্থক্য :
রাজনীতি বলতে কী বোঝায় তা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটলের মতে, “রাজনীতি বলতে নগর রাষ্ট্র পরিচালনা এবং নাগরিক সম্পর্কিত জ্ঞানকে বোঝায়”। ডেভিড ইস্টন রাজনীতি বলতে, ‘মূল্যের কর্তৃত্বমূলক বণ্টন’কে বুঝিয়েছেন। হ্যারল্ড ল্যাসওয়েল ‘সমাজে প্রভাব ও প্রভাবশালীদের পর্যালোচনা’কে রাজনীতি বলে অভিহিত করেছেন। অ্যালান বলের মতে, ‘সমাজের যে-কোনো বিরোধ ও তার নিষ্পত্তি হল রাজনীতি’। রবার্ট ডাল ‘ক্ষমতা’কে রাজনীতির মুখ্য বিষয় হিসেবে গণ্য করেন। মার্কসবাদীদের মতে, রাজনীতি হল “সমাজের উপরিকাঠামোর সবচেয়ে গঠনমূলক উপাদান, যে উপাদানটির মূলে আছে শ্রেণিগত দ্বন্দ্ব”। লেনিন বলেছেন, “রাজনীতি হল অর্থনীতির ঘনীভূত প্রকাশ।”
রাজনীতির প্রকৃতি
রাজনীতির অর্থ বিশ্লেষণ করলে এর প্রকৃতি সম্পর্কে যে বিষয়গুলি ফুটে ওঠে তা নীচে আলোচনা করা হল-
বিরোধ ও বিরোধ মীমাংসার তত্ত্ব:
রাজনীতির দুটি দিক। যথা—a. বিরোধ বা সংঘাতের দিক এবং b. মীমাংসা বা সহযোগিতামূলক দিক। একদিকে যেমন মানুষ তার নিজ স্বার্থে ও দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়, অন্যদিকে তা নিরসনের জন্য মীমাংসায় লিপ্ত হয়। কাজেই দ্বন্দ্ব ও তার মীমাংসাই হল রাজনীতি।
প্রভাব ও প্রভাবশালীদের তত্ত্ব :
রাজনীতি কর্তৃত্ব ও প্রভাবের সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িত। এই তত্ত্ব অনুযায়ী একজন প্রভাবশালী তার প্রভাব খাটিয়ে অন্য যে-কোনো ব্যক্তিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজের ইচ্ছামতো কাজ করিয়ে নিতে পারে। অর্থাৎ প্রভাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজনীতির দ্বারা অন্যের কাজ, আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে পরিচালিত করা যায়।
মূল্যের কর্তৃত্বসম্পন্ন বরাদ্দের তত্ত্ব :
মূল্য হল সেই সব বিষয় বা বস্তু যেগুলি জনগণের কাছে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। এইসব বিষয় বা বস্তু নিয়ে সমাজের ব্যক্তিদের মধ্যে বিরোধ বাঁধে এবং এই বিরোধের মীমাংসা করতে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন হয়। কেন-না উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের দ্বারা বরাদ্দ বা ভাগ ঘটলে সকলকে বাধ্যতামূলকভাবে সেই বণ্টন মেনে নিতে হয়।
ক্ষমতার তত্ত্ব :
রাজনৈতিক ক্ষমতা হল রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেকে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে রাজনীতির ভিত্তি হিসেবে মনে করেন। রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বারা নীতি নির্ধারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে পরিচালিত করা যায়।
সমষ্টিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া :
রাজনীতি হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সমষ্টিগত সিদ্ধান্তে উপনীত হন। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিভিন্ন উপায়ে হতে পারে। যেমন—আলাপ-আলোচনা, দর কষাকষি, ভোটাভুটি, প্রচলিত প্রথা বা রীতিনীতি, হিংসা বা বলপ্রয়োগ প্রভৃতি।
উপসংহার :
রাজনীতির অর্থ ও প্রকৃতির উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এ কথা বলা যায় যে, রাজনীতি হল একটি জটিল ও ব্যাপক ধারণা। ফলে সহজে এর অর্থ ও প্রকৃতি নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তবে এ কথা পরিষ্কার বোঝা যায় যে, রাজনীতির মুখ্য উদ্দেশ্য হল ক্ষমতা লাভ করা। আর ক্ষমতা লাভের জন্যই শ্রেণি বা গোষ্ঠী সর্বদা সংগ্রামে লিপ্ত থাকে। আর সংগ্রামের কারণেই রাজনীতির গতিশীলতা বজায় থাকে।