ভূমিকা :
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা নির্ণয় করা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র- ছাত্রীদের কাছে একটি বিরাট সমস্যা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অজস্র সংজ্ঞা বর্তমানে প্রচলিত আছে। এগুলিকে সাধারণভাবে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- i. রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সনাতনী সংজ্ঞা এবং ii. রাষ্ট্র নিরপেক্ষ সংজ্ঞা। এগুলি নীচে বিশ্লেষণ করা হল-
i. রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সনাতনী সংজ্ঞা :
অ্যারিস্টট্ল থেকে শুরু করে বহু রাষ্ট্রবিজ্ঞানীই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তার মূল বা কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু হল রাষ্ট্র, তাই এগুলি হল রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞা। রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞাগুলির মূল বিষয় হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান। এটি হল এমন একটি শাস্ত্র যা রাষ্ট্রের সংজ্ঞা, উৎপত্তি, প্রকৃতি, উদ্দেশ্য, সংগঠন, কার্যকলাপ প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই সংজ্ঞা আবার সনাতনী বা সাবেকি সংজ্ঞা নামে পরিচিত। অধ্যাপক গার্নার, গেটেল, ব্লুন্টসলি, গিলক্রিস্ট পলজানে, সিলি, লিক প্রমখ হলেন এই ধরনের সংজ্ঞার প্রবক্তা।
গার্নারের ভাষায়, “রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শুরু ও সমাপ্তি রাষ্ট্রকে নিয়েই।”
ব্লুন্টসলির ভাষায়, “রাষ্ট্র সম্পর্কিত বিজ্ঞানই রাষ্ট্রবিজ্ঞান।”
গেটেল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্বরূপ নির্ণয় করতে গিয়ে প্রথমে বলেন, “রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে রাষ্ট্রের বিজ্ঞান বলে অভিহিত করা যায়।” তাঁর মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল এমন এক শাস্ত্র যা অতীত কেমন ছিল তার ঐতিহাসিক অনুসন্ধান, বর্তমানে যা আছে তার বিশ্লেষণ, আর ভবিষ্যতে রাষ্ট্র কেমন হওয়া উচিত— তার ইঙ্গিত প্রদান।
গিলক্রিস্ট বলেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র ও সরকারের আলোচনা করে। ফরাসি দার্শনিক পলজানে বলেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল সমাজবিজ্ঞানের সেই শাখা, যা রাষ্ট্রের মৌল ভিত্তি ও সরকারের নীতিসমূহ নিয়ে আলোচনা করে।
সিলি, লিকক প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে শুধু রাষ্ট্র ও সরকারের কথা বলেছেন।
রাষ্ট্রকেন্দ্রিক বা সনাতনী সংজ্ঞার সমালোচনা
অধ্যাপক রবসন, রবার্ট ডাল, ল্যাসওয়েল, অ্যালান বল, ইস্টন প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ এরূপ সংজ্ঞাকে সংকীর্ণতার দোষে দুষ্ট বলে সমালোচনা করেন। অধ্যাপক ম্যাকেঞ্জি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এরূপ রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনাকে অত্যধিক আইনমুখী, কৃত্রিম ও খামখেয়ালিপূর্ণ বলে মনে করেন। আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এরূপ আলোচনাকে সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক’ বলেছেন।
ii. রাষ্ট্র নিরপেক্ষ সংজ্ঞা :
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে পশ্চিমী আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার যে ধারার ওপর আলোকপাত করেছেন তা রাষ্ট্রনিরপেক্ষ সংজ্ঞা হিসেবে পরিচিত। রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনার তত্ত্বকে বাদ দিয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর আচরণকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁদের মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল সেই শাস্ত্র যা শুধু সরকারই নয়, সেই সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর রাজনৈতিক আচার-আচরণ, চাপ-সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করে। রবার্ট ডাল, ল্যাসওয়েল, অ্যালান বল, ডেভিড ইস্টন, মিলার, ক্যাপলান প্রমুখ হলেন এই ধরনের সংজ্ঞার প্রবক্তা।
রবার্ট ডাল রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে প্রভাব ও প্রভাবশালীদের সম্পর্ক বলে মনে করেন।
ল্যাসওয়েলের মতে, ‘ক্ষমতা’ সম্পর্কিত আলোচনাই হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান।
অ্যালান বলের মতে, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল সেই বিষয় যা সমাজস্থ মানুষের বিরোধ ও বিরোধের মীমাংসা নিয়ে আলোচনা করে।”
ডেভিড ইস্টনের মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল ‘মূল্যের কর্তৃত্ব বরাদ্দের পাঠ।’
রাষ্ট্রনিরপেক্ষ বা অরাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংজ্ঞার সমালোচনা
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই রাষ্ট্রনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির বড়ো সীমাবদ্ধতা হল এরা রাষ্ট্রকে বাদ দিয়েই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা করতে চান। অথচ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল আলোচ্য বিষয়ই হল রাষ্ট্র। রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোনো আলোচনাই পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না।