বন সংরক্ষণ অথবা পরিবেশ রক্ষায় বনসৃজনের ভূমিকা
শ্যামল সুন্দর সৌম্য, অরণ্যভূমি, মানবের পুরাতন বাসগৃহ তুমি; তুমি দাও ছায়াখানি, দাও ফুল ফল দাও বস্ত্র, দাও শয্যা, দাও স্বাধীনতা নিশিদিন মর্মরিয়া কহ কত কথা অজানা ভাষার মন্ত্র;
ভূমিকা :
বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে বৃক্ষই আদি প্রাণ। নিষ্প্রাণ মরুপ্রান্তরের অব্যক্ত বেদনাকে দূর করে বৃক্ষই প্রথম প্রাণের সবুজ শিহরন জাগালো ধরার বুকে। রূপকথার রাজকন্যার মতো যার ঠাঁই ছিল সমুদ্রের অতলে, সূর্যের আহ্বানে সে আজ প্রকৃতির বুকে আপন শ্যামল রূপটি তুলে ধরল। রচনা করল সভ্যতার আনন্দ নিকেতন। সুস্থ সভ্যতা গড়ে তোলার জন্য বৃক্ষের এই নিরলস অবদান অনস্বীকার্য।
প্রাচীন ভারতে অরণ্য :
প্রাচীন ভারতে সমাজ-সংস্কৃতিতে বৃক্ষ ছিল দেবতার মতো। মানুষ ছিল অরণ্যচারী। প্রাচীনকালে মুনিঋষিদের তপোবনেই শিক্ষার্থী পাঠগ্রহণ করত। বৃক্ষ শুধু মাতৃস্নেহের মতো ছায়া দিয়ে, ফুল-ফল দিয়ে নয়, জীবন পরিচর্যা ও রোগ প্রতিরোধের ঔষধপত্র তৈরির উপাদান তুলে দিত প্রাচীন ভারতের চিকিৎসকগণের হাতে। প্রাচীন রূপকথা, উপকথা রচিত হয়েছে বৃক্ষকে ঘিরেই। ভারতীয় মহাকাব্যে শিল্প-সাহিত্যে অরণ্যেরই জয়গান। সেখানে রয়েছে পঞ্চবটী, দণ্ডকারণ্য, নৈমিষারণ্য, কাম্যকবন প্রভৃতি অরণ্যভূমির বর্ণনা।
মানবকল্যাণে অরণ্য :
প্রাচীন যুগের মানুষ একদিন হাতে পেল বিজ্ঞানের চাবিকাঠি, যার ছোঁয়ায় অনেক অসাধ্য, অধরাকে ধরার বুকে স্থাপিত করল। মানুষ জানে উদ্ভিদ ও মানুষ একে অন্যের পরিপূরক। পরিবেশকে কেবল সুন্দর শ্যামলিমায় সাজাতে নয়, বৃক্ষ পরিবেশকে বিভিন্ন দূষণের হাত থেকে রক্ষা করে। তা ছাড়া ঔষধপত্র তৈরিতে; আসবাবপত্র নির্মাণে, জ্বালানির কাজে এর ভূমিকা অগ্রগণ্য। বৃক্ষ ক্লান্ত জীবকুলকে সুশীতল ছায়া দান করে, পশুপক্ষীকে আশ্রয় দিয়ে, মানবজাতিকে ফল-ফুল দান করে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় বিশ্বাসী বন্ধুর জায়গা করে নিয়েছে। খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান ও ঔষধপত্রের জন্য বৃক্ষের কাছে আমরা বিশেষভাবে ঋণী। সৌন্দর্যপ্রিয় মানুষ বৃক্ষ বা অরণ্যের সৌন্দর্যে চঞ্চল হয়। তাই মানবমনের সঙ্গে বৃক্ষের একাত্মতা বেড়েছে। কাব্য সাহিত্য শিল্পেও বৃক্ষ আপন স্থান করে দিয়েছে। বিশ্বকবি বলেছেন
“মরুবিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে,
হে প্রবল প্রাণ, ধুলিরে ধন্য কর করুণার পুণ্যে
হে কোমল প্রাণ।”
নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা ও বৃক্ষচ্ছেদন :
আধুনিক জীবন ব্যস্তময় । বাড়ছে জনসংখ্যা। তাই দিকে দিকে নিত্যনুতন অট্টালিকা, গগনচুম্বী প্রাসাদ গড়ে উঠছে। তাই একদিন শুরু হল অরণ্যনিধন। নিষ্ঠুর কুঠারাঘাতে শক্তিগর্বী মানুষ নির্বিচারে অরণ্যনিধন করে চলেছে। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে অরণ্য নিধনেই আজ ধরণি দূষিত। কলকারখানার ধোঁয়া, জল, আবহাওয়ার পরিবর্তন সবই বৃক্ষ নিধনেরই ফলশ্রুতি। বাতাসের ভারসাম্য রক্ষার জন্য, বৃষ্টির জন্য, সুস্থ আবহাওয়ার জন্য, সর্বোপরি সুস্থভাবে বাঁচার জন্য অবিলম্বে আমাদের বৃক্ষের অবদান সম্বন্ধে সচেতন হতে হবে; বন্ধ করতে হবে বৃক্ষনিধনের অপপ্রয়াস ।
পরিবেশরক্ষায় বনসৃজন :
সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বাঁচার জন্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কিছু মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং সরকারের উদ্যোগে আজ দিকে দিকে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তার মহিমা প্রচার করা হচ্ছে। নিষিদ্ধ করা হচ্ছে যথেচ্ছ বৃক্ষচ্ছেদন। নতুন করে বন-সংরক্ষণের বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে। চলছে বনমহোৎসব, বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ উদ্যাপনের আয়োজন। রবীন্দ্রনাথই বৃক্ষরোপণ উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। তিনি শান্তিনিকেতনে নৃত্যগীতের মধ্যে দিয়ে এই অনুষ্ঠানটিকে এক আনন্দময় উৎসবের মর্যাদা দিয়েছিলেন। সরকারি উদ্যোগে বনমহোৎসবের সূচনা ১৯৫০ সালে। এখন পালিত হচ্ছে অরণ্যসপ্তাহ।
উপসংহার :
অরণ্যই শ্যামল সুষমামণ্ডিত করে দেশের শ্রী ও সমৃদ্ধি এনে দিতে পারে। প্রয়োজন বৃক্ষ সম্বন্ধে জনসচেতনতা। ছাত্রছাত্রীদের বোঝাতে হবে একটি গাছ অনেক প্রাণকে রক্ষা করে। গ্রাম এবং নগর উভয় স্থানেই গাছ লাগাতে হবে। গাছ না কেটে বরং গাছ লাগিয়ে পৃথিবীকে সবুজ শ্যামল করে প্রাণ ভরে তাজা বায়ুসেবনের জন্য দায়িত্ব নিতে হবে।
এই প্রবন্ধের অনুসরণে লেখা যায় : (১) অরণ্য ও মানুষের সম্পর্ক, (২) মানবসভ্যতায় বন-সংরক্ষণ, (৩) দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর, (৪) একটি গাছ একটি প্রাণ, (৫) পরিবেশ পরিসেবায় অরণ্য।