তোমার জীবনের একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতা

তোমার জীবনের একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতা
তোমার জীবনের একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতা

ভূমিকা : 

মানুষের জীবন নানান ঘটনায় মোড়া। কোনোটা সুখের অনুভূতিতে রঙিন, কোনোটা দুঃখের বেদনায় ভারাক্রান্ত, কোনোটা হাড় হিম করা ভয়ের, কোনোটা বা গভীর বিস্ময়ের। তবে সমস্ত ঘটনাই যে স্মৃতিতে গভীরভাবে ধরা থাকে তা নয়, কিন্তু দু-একটি ঘটনা হৃদয়ে মনের অন্তঃস্থলে এতটাই চাপা পড়ে থাকে, যা সামান্য স্মৃতি-সূত্রের টানে মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। এমনি একটা ঘটনার কথা আজ বলব।

ঘটনার পূর্বস্থান : 

দেওঘরে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের তিথি উৎসবে গিয়েছিলাম বাবা-মায়ের সঙ্গে। উৎসব শেষে বাবা ঠিক করলেন রাজগির বেড়াতে যাওয়া হবে। আমার বয়স তখন তেরো-চোদ্দো হবে। মা-বাবা ছাড়াও ছিলেন আমার ঠাকুমা। তিনদিন বুদ্ধগয়া, গয়া, পাওয়াপুরী, নালন্দা দেখলাম মন ভরে।

ঘটনার সূত্রপাত : 

ঘটনা তখনও ঘটেনি। যেদিন ফিরে আসার পালা, সেদিন বাড়ি ফেরার তাগিদে জিনিসপত্র গোছাতেই ব্যস্ত বাবা-মা। বাসের টিকিটও কাটা ছিল। বাস ছাড়ল সন্ধ্যা ৬টায়। ভিডিয়ো দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই। হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। বাসটা অন্ধকার। ঠাকুমা পাশেই ছিলেন। বললাম ভিডিয়ো চলছে না কেন? বাসে এত অন্ধকার কেন? ঠাকুমা আমার মুখে হাত দিয়ে চেপে বললেন, এত জোরে কথা বলো না। এখন আমরা কোডার্মার জঙ্গল দিয়ে যাচ্ছি। এখানে বাসে খুব ডাকাতি হয়। ডাকাত শব্দটা শুনে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। চুপ করে ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকলাম।

গভীর রাতের হাড়-হিম করা ঘটনা : 

তারপর একসময় মনে হল বাসটার গায়ে কোনো কিছু দিয়ে আঘাত করা হচ্ছে। বাবা-মাকে সামনের বসার আসনে দিয়ে আমরা ছিলাম পিছনে। হঠাৎ বাবা দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে পিছন ফিরে বললেন মনে হয় কিছু একটা ঘটেছে। তোমরা চুপ করে বসে থাকো আমি দেখছি। ঠাকুমা বাবাকে বললেন, তুমি বাস থেকে নামবে না যেন! বাবা বললেন, না-না আমি নামছি না। অন্ধকার বাস কাউকে দেখাও যাচ্ছে না।

বাবার কথা শুনে মনে স্বস্তি, ভীতি-আতত্ত্বের অবসান :

আমি ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে ‘মা’ কোথায় বলে ডাকলাম। মা বললেন, আমি এখানে আছি, তুমি ঠাকুমার কাছে বসে থাকো। হ্যাঁ, আওয়াজটা মার কানে পৌঁছালো বলে মনে হল না। বাসের গায়ে খুব জোরে লাঠির আওয়াজ পড়ছে তখনও। বাসটার গতি তখন খুবই কম। কিন্তু চিৎকার কোলাহল অনেক বেড়ে গেছে। বাসের আলো জ্বলে উঠল। কয়েকজন পুলিশ বাসে উঠে বললেন – কোথায় বাসের চালক? কোথায় বাসের মালিক? কনডাক্টার বললেন, এখানেই তো ছিল। ছিল তো কোথায় গেল’ – এসব কথা শুনব না। না-বললে বাস এখানেই থাকবে। ঘণ্টাখানেক নানা রকম চিৎকার, কোলাহল হওয়ার পর যেন আওয়াজ একটু কমল। বাবাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। মাকে বললাম, মা, বাবা কোথায়? তোমার বাবা আসছেন। বলতে বলতে বাবাকে দেখলাম বাসের গেট দিয়ে উঠছেন। বাবা বললেন, সকাল না হলে কোনো ব্যবস্থা হবে না। আমরা এখন থানায়।
        বাসের কোনো রুট পারমিট ছিল না বলে এস. ডি.ও চেকিং-এ এসে বাসটাকে আটক করেছে। তবে আমাদের যাওয়ার কী ব্যবস্থা হবে? বাবা বললেন, থানার অফিসার বলেছেন, আপনাদের কোনো চিন্তা নেই। অন্য বাসের ব্যবস্থা করে কলকাতায় পৌঁছে দেওয়া হবে। ঠাকুমা বললেন, সবই শ্রীশ্রীঠাকুরের কৃপা। আমি তো ভাবছিলাম ডাকাত পড়েছে। বাসের যাত্রীরা প্রত্যেকেই একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।

উপসংহার : 

পূর্বদিগন্তে রক্তিম আভা। সকালের সূর্য উকি দিচ্ছে। জলখাবার খেয়ে বাসে উঠলাম। সরকারি বাস। গাড়ি ছাড়ল তখন ৭টা। হাড়-হিম করা রাতের ঘটনাটা আমার বারবার মনে পড়ে। একটি রাত যেন একটি বছর। একটি ঘটনা শত ঘটনার ভিড়েও আমার মনের আয়নায় বারেবারেই ভেসে ওঠে।

Leave a Comment