ভূমিকা :
হোমোস্যাপিয়েন্স বা আধুনিক মানবের উদ্ভব হয় আজ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ হাজার বছর পূর্বে। উদ্ভবের দীর্ঘদিন আদিম মানব অসভ্য বন্য জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত ছিল। তারা গাছের তলায় ও পাহাড়ের গুহাতে বসবাস করত। বনের পশুশিকার, ফলমূল, পাখির ডিম, নদীর মাছ খাদ্য হিসেবে সংগ্রহ করত। খাদ্য উৎপাদন করতে পারত না। তাই আদিম মানব ছিল খাদ্য সংগ্রাহক (Food-Gatherer)। দীর্ঘকাল ধরে শিকারি আদিম মানুষের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এই সম্পর্ক থেকেই আদিম শিকারি মানবের নিজস্ব সংস্কৃতির উদ্ভব হয়। আদিম মানব উন্নত মস্তিষ্ক ও দুটি হাতের সাহায্যে তাদের সংস্কৃতির চরম বিকাশ ঘটায়।
হাতিয়ার :
আদিম মানব হাতিয়ারের সাহায্যে বন্যপশু শিকার বা বনের ফলমূল সংগ্রহ করত। আধুনিক মানব পাথর ও পশুর হাড় দিয়ে হাতলযুক্ত হাতিয়ার তৈরি করে। যেমন—হাতকুঠার, ছুরি, বড়শি, বর্শা, হারপুন, চামড়া সেলাইয়ের জন্য হাড়ের তৈরি ছুঁচ ও পরবর্তীকালে তিরধনুক।
জীবিকা :
আদিম মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল বন্যপশু শিকার করা। অপর জীবিকা ছিল ফলমূল সংগ্রহ করা।
i. শিকার : আদিম মানুষ বিভিন্ন হাতিয়ার দিয়ে দলবদ্ধভাবে শিকার করত। কারণ এককভাবে বড়ো পশু শিকার করা সম্ভব ছিল না। তারা রক্তের সম্পর্ক যুক্ত শিকারি মানুষদের নিয়ে দল গঠন করে। এই দলগুলি ক্ল্যান (Clan) নামে পরিচিত। একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা দল একটি নির্দিষ্ট এলাকাতেই শিকার করত। সেখানে অন্য কোনো গোষ্ঠীর শিকারের অধিকার ছিল না। অনেক সময় বড়ো বন্যজন্তু শিকারের জন্য কয়েকটি গোষ্ঠী জোটবদ্ধ হত। এই জোটগুলিকে ট্রাইব (Tribe) বলা হত।
প্রথমে নারী ও পুরুষ একসঙ্গে শিকার করত কিন্তু পরবর্তীকালে একমাত্র পুরুষরাই শিকার করত।
খাদ্য :
পশুর মাংসই ছিল আদিম মানবের প্রধান খাদ্য। তবে মাংস ছাড়া তারা বনের ফলমূল, শাকসবজি, পাখির ডিম খেত। প্রথমে কাঁচা মাংস খেত, পরে আগুনের ব্যবহার শেখার পর মাংস পুড়িয়ে খেত।
বাসস্থান :
শিকারি মানুষ প্রথমে গুহাতে বসবাস করত, কিন্তু গুহাগুলি পর্যাপ্ত না হওয়ার জন্য বসবাসের জন্য ডালপালা, লতাপাতা, জন্তুজানোয়ারের হাড় ও মাটি দিয়ে ঘর তৈরি করে। তারা চামড়ার ছাউনিও অনেক সময় দিত। কারণ চেকোশ্লোভাকিয়াতে এইরকম চামড়ার ছাউনি দেওয়া ঘরের নিদর্শন পাওয়া গেছে।
পোশাক :
শিকারি মানুষের পোশাক ছিল পশুর চামড়া দিয়ে তৈরি। শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আদিম মানব পশুর চামড়া গায়ে জড়ানো শুরু করে। এই চামড়া বিবর্তনের মাধ্যমে পোশাকে পরিণত হয়। এর ফলে শিকারি মানুষ যে-কোনো আবহাওয়ায় বসবাসের উপযোগী হয়ে ওঠে।
আগুনের ব্যবহার :
সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল আদিম মানুষের আগুনের আবিষ্কার। দাবানল ও আগ্নেয়গিরির আগুন থেকে তারা আগুনের ব্যবহার শিখে ছিল। এর অনেক পরে তারা আগুন আবিষ্কার করে। এর ফলে শিকারি মানুষ কাঁচা মাংসের পরিবর্তে আগুনে-পোড়া মাংস খায়। মাটির পাত্র তৈরি করে তারা আগুনে পোড়াত। আগুনের ভয় দেখিয়ে হিংস্র পশুকে তাড়িয়ে নিজেদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করে। আগুনের আবিষ্কার ও ব্যবহার শিকারি মানুষকে উন্নত করে তোলে।
জলযান তৈরি :
শিকারি মানুষ জলপথে যাতায়াতের ও পণ্য পরিবহণের জন্য কাঠের গুঁড়ি খোদাই করে নৌকা, ডিঙি, ভেলা তৈরি করে। ৪০০০ বছরের প্রাচীন এইরকম নৌকার নিদর্শন হল্যান্ডে পাওয়া গেছে।
পশুপালন :
শিকারি মানুষ প্রথম পোষ মানায় কুকুরকে। কুকুরের ঘ্রাণশক্তি কাজে লাগিয়ে তারা বহুদূরের শিকারের সন্ধান পেত। তা ছাড়া কুকুর পশুদের তাড়া করে শিকারি মানুষকে শিকার করায় সাহায্য করত। বরফে চলাচলের জন্য কুকুর স্লেজ গাড়ি টানত। কুকুরের পর শিকারি মানুষ গোরু, ছাগল, ভেড়া প্রভৃতি প্রাণীকে পোষ মানায়।
মাতৃতান্ত্রিক সমাজ :
শিকারি মানুষের সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। কারণ সমাজে পুরুষদের তুলনায় নারীদের প্রাধান্য বেশি ছিল বলে আধুনিক গবেষকরা মনে করেন।
শ্রম বিভাজন :
শিকারি মানুষের সমাজে শ্রম বিভাজন ছিল। পুরুষরা হাতিয়ার তৈরি, শিকার ও বাসগৃহ নির্মাণ করত। নারীরা সন্তান পালন ও বনের ফলমূল সংগ্রহ করত।
চিত্রকলা :
বিভিন্ন পশুর ছবি, তিরবিদ্ধ পশুর সামনে দলবদ্ধ মানুষের নৃত্যের ছবি শিকারি মানুষ দক্ষতার সঙ্গে গুহার দেয়ালে ফুটিয়ে তুলেছিল। স্পেন, ফ্রান্স ও আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানে এইরকম বহু চিত্রের নিদর্শন পাওয়া গেছে।
ধর্মবিশ্বাস :
আদিম শিকারি মানুষের ধর্মবিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যায় এই গুহাচিত্র থেকে। গুহার গভীরে এক ধরনের জাদু বিশ্বাস বা ধর্মীয় কোনো শক্তিকে তুষ্ট করার জন্য এই ছবিগুলি আঁকত। ভালো শিকার পাওয়া ও নিরাপদে ফিরে আসার জন্য তারা এই ছবিগুলির সামনে প্রার্থনা করত
মূল্যায়ন :
শিকারি মানব সমাজের উদ্ভব হয়েছিল 10 লক্ষ বছরেরও আগে এবং তার অবসান ঘটে আজ থেকে 10-12 হাজার বছর আগে। শিকারি সমাজ স্থায়ী হয় প্রায় 10 লক্ষ বছর। এই সমাজের অবলুপ্তির কারণগুলি হল—i. পশুর সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার ফলে শিকারে অপ্রতুলতা দেখা দেয়, ii. শিকারি সমাজে খাদ্যের অনিশ্চয়তা অধিকাংশ সময় মানুষকে বিপদে ফেলত, iii. কৃষিকাজের সূত্রপাতের ফলেই শিকারি মানব সমাজের অবলুপ্তি ঘটে।