মেহেরগড় সভ্যতার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। অথবা, প্রাক্-হরপ্পা যুগের মেহেরগড় সভ্যতার বিবরণ দাও।
মেহেরগড় সভ্যতার সংক্ষিপ্ত বিবরণ – নব্য প্রস্তর বা তাম্র প্রস্তর যুগে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম দিকে বোলান গিরিপথের কাছে মেহেরগড়কে কেন্দ্র করে যে গ্রামীণ সভ্যতার উন্মেষ হয় তা মেহেরগড় সভ্যতা নামে পরিচিত। মেহেরগড় সভ্যতা ভারতবর্ষের প্রাচীনতম সভ্যতা।
![]() |
মেহেরগড় সভ্যতার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। |
ভূমিকা :
নব্য প্রস্তর বা তাম্র প্রস্তর যুগে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম দিকে বোলান গিরিপথের কাছে মেহেরগড়কে কেন্দ্র করে যে গ্রামীণ সভ্যতার উন্মেষ হয় তা মেহেরগড় সভ্যতা নামে পরিচিত। মেহেরগড় সভ্যতা ভারতবর্ষের প্রাচীনতম সভ্যতা।
আবিষ্কার :
1974 খ্রিস্টাব্দে ও তার পরবর্তীকালে 1980 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ জাঁ ফ্রাঁসোয়া জারিজ ও মার্কিন প্রত্নতত্ত্ববিদ রিচার্ড মিডৌ বেলুচিস্তানে কাচ্চি সমভূমিতে মেহেরগড় সভ্যতা আবিষ্কার করেন।
অবস্থান :
বর্তমান পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের পশ্চিমে সিন্ধু উপত্যকার কাচ্চি সমভূমিতে বোলান গিরিপথের কিছু দূরে প্রায় পাঁচশো একর ব্যাপী এলাকায় মেহেরগড় অবস্থিত। বেলুচিস্তানের ঝোব নদীর দক্ষিণ উপত্যকা থেকে শুরু করে সিন্ধু নদীর সমগ্র পশ্চিম অংশ জুড়ে এই সভ্যতা বিস্তৃত ছিল।
বিভিন্ন কেন্দ্র :
মেহেরগড় সভ্যতার প্রধান প্রধান কেন্দ্রগুলি হল—মেহেরগড়, কিলে গুল মহম্মদ, রানা ঘুনডাই, গুমলা, আনজিরা, মুন্ডিগাক, নৌসেরা, কোটদিজি, নুন্দরা, কুল্লি প্রভৃতি।
সময়সীমা :
রেডিয়ো-কার্বন-14 পরীক্ষার পর জানা গেছে যে আনুমানিক 7000 খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই সভ্যতার বিকাশ ঘটে এবং 2500 খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই সভ্যতার পতন ঘটে।
বিকাশের নানা পর্যায় :
সাতটি পর্যায়ে মেহেরগড় সভ্যতার বিকাশ ঘটে—
i. প্রথম স্তর : 7000 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে 5000 (মতান্তরে 5500) খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
ii. দ্বিতীয় স্তর : 5000 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে 4000 খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
ii. তৃতীয় স্তর : 4000 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে 3500 (মতান্তরে 4300 থেকে 3800) খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
iv. চতুর্থ ও পঞ্চম স্তর : 3500 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে 3200 খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
V. ষষ্ঠ ও সপ্তম স্তর : 3200 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে 2500 খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
বৈশিষ্ট্য :
মেহেরগড় সভ্যতার বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
i. প্রাগৈতিহাসিক যুগের সভ্যতা : মেহেরগড় সভ্যতা প্রাগৈতিহাসিক যুগের সভ্যতা। কারণ এই সভ্যতার কোনো লিখিত বিবরণ পাওয়া যায়নি। কেবল প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের ওপর ভিত্তি করেই এই সভ্যতার কথা জানা যায়।
ii. তাম্র-প্রস্তর যুগের সভ্যতা : মেহেরগড় সভ্যতার হাতিয়ার ও যন্ত্রপাতি ছিল পাথরের তৈরি। তবে এই সভ্যতার মানুষ তামার ব্যবহার জানত।
জীবিকা :
মেহেরগড় সভ্যতার অধিবাসীদের প্রধান জীবিকা ছিল শিকার ও পশুপালন। পরবর্তীকালে তারা কৃষিকাজ করতে শেখে। যব, গম, তুলো, খেজুর প্রভৃতি ছিল তাদের কৃষিজাত ফসল। তারা গোরু, ভেড়া, ছাগল, মহিষ, কুকুর প্রভৃতি পশুপালন করত।
বাসস্থান :
মেহেরগড় সভ্যতার অধিবাসীরা রোদে পোড়া ইট, মাটি, পাথর প্রভৃতি উপকরণ দিয়ে চারকোণা জানালাবিহীন গৃহ নির্মাণ করত। বাড়িগুলি বিভক্ত ছিল ছোটো ছোটো কামরায় । কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাটির দেয়ালও ছিল। আবার কখনো-কখনো একটির উপর একটি পাথর চাপিয়েও দেয়াল তৈরি হত। ঘরগুলি গরম রাখার জন্য আগুন জ্বালাবার নির্দিষ্ট স্থান ছিল।
শিল্প :
মেহেরগড় সভ্যতার মানুষ মৃৎশিল্প, ধাতুশিল্প, অলংকার শিল্প ও বস্ত্রবয়ন শিল্পে বিশেষ পারদর্শী ছিল। তারা কুমোরের চাকা ব্যবহার করে মাটির পাত্র তৈরি করত। আগুনে পুড়িয়ে নানা ধরনের রং করত। পোড়ামাটির নারীমূর্তি ও গবাদিপশুর মূর্তি তৈরি করত। তামা দিয়ে ছুরি, পুঁতি, আংটি তৈরি করত। নীলকান্ত মণি, বৈদুর্যমণি, মাদার অব্ পার্ল দিয়ে গলার হার তৈরি করত। কার্পাস তুলা দিয়ে সুতা তৈরি করে বস্ত্রবয়নের কাজেও তারা দক্ষ ছিল।
বাণিজ্য :
মেহেরগড়ের বণিকরা অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় ধরনের বাণিজ্যে পারদর্শী ছিল। মধ্য এশিয়া, পারস্য, আফগানিস্তানের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল।
ধর্মবিশ্বাস :
মেহেরগড়বাসী মৃতদেহ কবর দিত এবং মৃতদেহের পাশে তার ব্যবহৃত দামি অলংকারগুলি রেখে দিত। এ থেকে অনুমান করা হয় তারা পরলোকে বিশ্বাস করত।
পতন :
মেহেরগড় সভ্যতার পতনের কারণ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে—i. অনেকে মনে করেন বন্যা বা ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এই সভ্যতা ধ্বংস হয়। ii. কেউ কেউ বলেন বহিঃশত্রুর আক্রমণে এই সভ্যতা ধ্বংস হয়। iii. কিছু গবেষক মনে করেন হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে এই সভ্যতা মিশে গেছে।
মূল্যায়ন :
মেহেরগড় সভ্যতার প্রথম তিনটি পর্যায় ছিল প্রস্তর যুগের। কিন্তু চতুর্থ থেকে সপ্তম পর্যায়ে মেহেরগড় সভ্যতার দ্রুত উন্নতি ঘটে। গ্রামীণ মেহেরগড় সভ্যতা ধীরে ধীরে নগর সভ্যতার দিকে এগিয়ে যায়, যা পরবর্তী কালের হরপ্পা সভ্যতার চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। অধ্যাপক বি. এন. মুখার্জী, ড. দিলীপ চক্রবর্তী, ড. শিরিন রত্নাগর প্রমুখ বিখ্যাত ঐতিহাসিকরা হরপ্পা সভ্যতাকে মেহেরগড় সভ্যতার উত্তরসূরি বলে অভিহিত করেছেন।
আরও পড়ুন – সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী রচনা