ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ ও ফলাফলগুলি আলোচনা করো – আজকের পর্বে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ ও ফলাফলগুলি আলোচনা করা হল।
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ ও ফলাফলগুলি আলোচনা করো
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ ও ফলাফলগুলি আলোচনা করো। |
ভূমিকা
১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দকে বলা হয় বিপ্লবের বছর কেননা এই বছর ফ্রান্সে জুলাই রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে জুলাই বিপ্লব সংগঠিত হয়। এই বিপ্লবের লেলিহান শিখায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জাতীয়তাবাদী আক্রমণ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের অবসান হয় এবং প্রজাবিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের অবসান হয় এবং প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়। একটি মাত্র কারণে এই বিপ্লব সংগঠিত হয়নি এর পেছনে ছিল নানাবিধ কারণ। যেগুলি হল-
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ
ফেব্রুয়ারি বিপ্লব কেন ঘটে তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। আলফ্রেড কোব্বান লিখেছেন, “1848 in Franch was a revolution by accident. কিন্তু বেশির ভাগ ঐতিহাসিক তা মনে করেন না তাঁদের মতে এর পেছনে একাধিক কারণ লুকিয়ে ছিল।
(ক) সমস্ত রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা
লুই ফিলিপ প্রথম থেকেই কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থন পাননি। সমাজতন্ত্রীরা ধনী ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার দিকটির তীব্র বিরোধী ছিলেন। প্রজাতান্ত্রিক দল আবার সার্বজনীন ভোটাধিকার ও পূর্ণ প্রজাতন্ত্রের দাবিতে অটল ছিল। তাঁরা মনে করতেন লুই ফিলিপ গণতন্ত্রের বিরোধী। রাজতন্ত্রীদের একটা বড়ো অংশের সমর্থন ছিল বুরবোঁ রাজবংশের দিকে তারা লুই ফিলিপকে বিশ্বাসঘাতক মনে করতেন। বোনাপাটিস্ট দল আবার নেপোলিয়নের বংশধরদের সিংহাসনে বসানোর পক্ষপাতী ছিলেন। মধ্যপন্থীরা আবার মধ্যপন্থা নীতি ও শ্রমিক কল্যাণে লুই ফিলিপ হতাশ হন। অর্থাৎ তাঁর শাসনব্যবস্থা না ছিল রক্ষণশীল, না ছিল উদারপন্থী, না ছিল নরমপন্থী।
(খ) কৃষি ব্যবস্থার সংকট
বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতে ১৮৪৬-৪৭ ফ্রান্সে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। আলুতে পোকা লাগা, অনাবৃষ্টিতে গমের ফসল বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে ফ্রান্সে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দেয়। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেলে খেটে খাওয়া মানুষের দুর্দশা তীব্র হয়ে ওঠে। এর ফলে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে লুই ফিলিপের পতন ঘটে।
(গ) বুর্জোয়াদের প্রাধান্য
লুই ফিলিপ ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ ভাবে বুর্জোয়া-নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। লুই ফিলিপ ভোটাধিকার সম্প্রসারিত করলে বুর্জোয়া-শ্রেণির প্রায় প্রত্যেকেই ভোটাধিকার পেলেও শ্রমিক, কৃষকরা বঞ্চিত হন। ফলে ফ্রান্সের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ ও মধ্যবিত্তরা অসন্তুষ্ট হন।
(ঘ) অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র নীতিতে ব্যর্থতা
লুই ফিলিপ অভ্যন্তরীণ নীতির ক্ষেত্রে যেমন ব্যর্থ ছিলেন অন্যদিকে পররাষ্ট্র নীতির মূল লক্ষ্য ছিল যুদ্ধ এড়িয়ে চলা অর্থাৎ সামরিক গৌরবান্বিত পররাষ্ট্র নীতির বদলে লুই ফিলিপের শান্তিবাদী পররাষ্ট্র নীতি ও মধ্যপন্থা নীতি ফরাসিদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি করে।
(ঙ) শ্রমিকশ্রেণির অসন্তোষ
সরকার কর্তৃক শিল্পোদ্যোগের অভাব এবং শ্রমিক শ্রেণির উন্নয়নে সরকারের ব্যর্থতা। শ্রমিকদের কাজের কোনো সময়সীমা ছিল না মজুরি ছিল স্বল্প, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থেকে তাদের জীবন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল অথচ রাজা তাদের উন্নয়নে কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেননি ফলে শ্রমিকরা অসন্তুষ্ট হয়েছিল।
(চ) লুই ফিলিপের স্বৈরাচারী আকাঙ্ক্ষা
উদারপন্থী ভাব দেখালেও লুই ফিলিপ আন্তরিকভাবে উদারপন্থী ছিলেন না। জ্যাক্ ডুজের ভাষায় জেদি ও নীতিজ্ঞানহীন নাগরিক রাজা আপাত-ভাল মানুষির অন্তরালে স্বৈরাচারী, ক্ষমতা ভোগের তীব্র বাসনা পোষণ করতেন। তাঁর স্বৈরাচারী শাসনে জনগণ হতাশ হয়ে পড়েন এবং তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে।
(ছ) ক্যাথলিকদের বিরোধিতা
ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ফ্রান্সের প্রতি ক্যাথলিকদের বিরোধীতাও এই বিপ্লবের অন্যতম কারণ।
প্রত্যক্ষ কারণ ও বিপ্লবের সূচনা
১৮৪৮ খ্রি. ২২ ফেব্রুয়ারি লাসাতিন, তিয়ের, লুই ব্ল্যাঙ্ক প্রমুখ নেতৃবৃন্দগণ-তান্ত্রিক শাসন ও ভোটাধিকার সম্প্রসারণের দাবিতে একটি ভোজসভার আয়োজন করলে সরকার তাতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে জনতা প্যারিসের বিরাট জনসভায় উপস্থিত হয়ে প্রধানমন্ত্রি গিজোর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ক্ষুব্ধ জনতা গিজোর বাসভবন আক্রমণ করলে ২৩ জন জনতা দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন। বিক্ষুদ্ধ জনতা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে লুই ফিলিপের পদত্যাগ দাবি করেন। লুই ফিলিপ বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রি গিজোকে বরখাস্ত করেন। কিন্তু জনতা মিছিল ক্রমশ সশস্ত্র আকার ধারণ করলে ২৪ ফেব্রুয়ারি রাজা ভীত হয়ে সিংহাসন ত্যাগ করে ইংল্যান্ডে পলায়ন করলে জুলাই রাজতন্ত্রের অবসান হয়। প্রজাতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীরা মিলিত ভাবে ফ্রান্সকে প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করেন।
ফলাফল
১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের গুরুত্ব অপরিসীম। এর ফলাফল ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। যেগুলি নিম্নে আলোচনা করা হল-১ ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের অবসান হয় এবং প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়। ২ ফ্রান্সের জনগণের ভোটাধিকার সম্প্রসারিত হয়। ৩ সকলের কাজের অধিকার মেনে নেওয়া হয় এবং শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। (৪) কর্মহীন বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য জাতীয় কর্মশালা স্থাপিত। ৫ এই বিপ্লব ইউরোপের ভিয়েনা বন্দোবস্ত ও মেটারনিখতন্ত্রের সলিলসমাধি ঘটায়। ৬ এই বিপ্লবের ফলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অস্ট্রিয়া, ইটালি, হাঙ্গেরি, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড মিলান, রোম, বোহেমিয়ায় একের পর এক বিপ্লবী আন্দোলন শুরু হয়। ৭ ফ্রান্সের জন্য একটি প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান রচিত হয়।
উপসংহার
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অল্পকালের মধ্যেই নেপোলিয়নের বংশধর লুই নেপোলিয়ন ফ্রান্সের সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা আত্মসাৎ করে সিংহাসনে বসেন। তবে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব এটাই দেখিয়ে দেয় জনমতকে অগ্রাহ্য করে কোনো রাজত্ব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।